ভারতের ইতোমধ্যেই দুর্বল রাজ্য বাজেটকে সঙ্কুচিত করবে ভ্যাকসিনের খরচ
বিশ্বের সবচেয়ে ভয়াবহ করোনাভাইরাস মহামারি নিয়ে যুঝছে প্রতিবেশী ভারত। এতে দেশটির অধিকাংশ রাজ্য সরকার পর্যায়ে আয়ের বেহাল দশা, তুলনায় খরচ বেড়েছে অনেকগুণ। ভাইরাসের আঘাত বাজেটের এই দুর্দশাকে আরও বাড়িয়ে তুলতে চলেছে। কারণ, স্থানীয় অর্থনীতি রক্ষার্থে প্রণোদনাসহ নানা প্রকার দরকারি সহায়তা দিতে, রাজ্য সরকারকে এখন আরও চড়া সুদে ঋণ নিতে হবে।
ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির কেন্দ্রীয় সরকার গত ১ মে থেকে টিকা ক্রয়ের ভার প্রাদেশিক সরকারগুলোর ওপর হঠাৎ করে চাপিয়ে দেয়, এতে দেশটির ২৮টি রাজ্য সরকারকে আরও পাঁচশ কোটি ডলার বরাদ্দ দিতে হবে। কিন্তু, সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবিলায় প্রয়োজনীয় টিকা ক্রয়ে বাজেটে আগে থেকে বরাদ্দ না থাকায়, এখন অতিরিক্ত অর্থ যোগাড়ে তাদের বিদ্যমান বাজেটের মূল কিছু ব্যয় কাটছাঁট করাসহ, সরকারি সম্পদ বিক্রি এবং ঋণ বৃদ্ধির মতো পদক্ষেপ নিতে হবে।
সাধারণ একটি হিসাবে দেখা গেছে, ১৮-৪৪ বয়স শ্রেণির ৫৯ কোটি ভারতীয় নাগরিকের জন্য দুই ডোজ টিকা ক্রয়ে রাজ্য সরকারগুলোকে বরাদ্দ দিতে হবে প্রায় ৩৫ হাজার কোটি রুপি বা ৪৮০ কোটি ডলার। জনপ্রতি খরচ করতে হবে ৬০০ রুপি। এরপর টিকাদানের বয়স সীমা ১৮ বছরের নিচে নামানো হলে টিকার খরচ মোট দেশজ পণ্য উৎপাদনের দশমিক ২৫ শতাংশে উন্নীত হতে পারে, বলে জানান এমকে গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস লিমিটেডের অর্থনীতিবিদ মাধবী আরোরা।
এদিকে, বাজেট ঘাটতির ব্যবধান অনেক বেশি হওয়ার ঝুঁকি থাকায়, চলতি বছর বাজার থেকে সরকারের ঋণ গ্রহণের খরচ বেড়েছে। এই মুহূর্তে ঋণ বৃদ্ধি রাজ্য সরকারগুলোর নাভিশ্বাস জন্ম দেবে।
গেল বছর ইতিহাসের বিরল এক মন্দায় পড়েছিল ভারত, সেখান থেকে উত্তরণ ব্যাহত করার হুমকি সৃষ্টি করেছে রাজ্য পর্যায়ে দরকারি অর্থ সংগ্রহ ও ব্যয়ে ব্যর্থতা। এর প্রধান কারণ কর্মসংস্থান এবং ভোক্তা চাহিদা সৃষ্টিতে অবদান রাখা মোট সরকারি ব্যয়ের ৬০ শতাংশই ব্যয় করে প্রাদেশিক সরকার। বাজেটে বরাদ্দ মূল ব্যয় থেকে সম্পদ সৃষ্টি এবং অবকাঠামো নির্মাণে যা খরচ করা হয়।
আবার কেন্দ্রীয় সরকার যে সুদে ঋণে নেয়, তার তুলনায় বেশি মুনাফা দিয়েও প্রদেশগুলো বিদেশি বিনিয়োগকারী আকর্ষণে হিমশিম খাচ্ছে। রাজ্য সরকারসমুহের জারিকৃত সঞ্চয়পত্র কেনার ক্ষেত্রে বিদেশি সংস্থাগুলোকে ৬৭৬ বিলিয়ন রুপির সীমা দেওয়া হলেও, গত ১০ মে নাগাদ বৈশ্বিক তহবিলগুলো এর মাত্র ১.২ শতাংশ কিনেছে। দুই বছর আগের ৪.৮ শতাংশ থেকে যা উল্লেখযোগ্য পরিমাণ কম বলে জানা যায় ক্লিয়ারিং কর্প অব ইন্ডিয়া লিমিটেডের প্রদত্ত তথ্যানুসারে।
সরকারি সম্পদ বিক্রি:
ছত্তিশগড় রাজ্যের স্বাস্থ্য ও বাণিজ্যিক কর বিষয়ক মন্ত্রী টি. এস. সিং দেও বলেন, "অর্থায়নের উদ্যোগ এবার নিশ্চিতভাবেই প্রভাবিত হবে। বাড়তি অর্থ সংস্থানের চাপ থাকায়, মূল ব্যয়ের ওপরেই সঙ্কোচনের কুঠারাঘাত পড়তে চলেছে।"
চলতি বছর নিজস্ব অর্থায়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়নে রাজ্য সরকারগুলোকে রাষ্ট্রীয় সম্পদ বিক্রিতে উৎসাহ দিচ্ছে মোদির কেন্দ্রীয় সরকার। রাজ্য পর্যায়ে দেনা কমানোর এটি অন্যতম একটি সমাধান, বলে মন্তব্য করেন সাবেক ওয়ালস্ট্রিট ব্যাংকার এবং তামিলনাড়ু রাজ্যের সদ্য নিয়োগকৃত অর্থমন্ত্রী পালানিভেল থিয়াগা রাজন।
তিনি বলেন, "সব রকমের সমাধান নিয়েই ভাবা হচ্ছে। তবে এই মুহূর্তে দরকারি নয় বলে মনে করা বেশ কিছু ব্যয় সঙ্কোচনে আমরা তৎপর হব। একইসঙ্গে, অর্থের নতুন উৎস সন্ধানও চলবে। দেনার পুনর্গঠনসহ সরকারি সম্পদ বিক্রি নিয়েও আমরা চিন্তা-ভাবনা করছি।"
ভারতের আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়া (কেন্দ্রীয় ব্যাংক) জানিয়েছে, মহামারি ভারতীয় রাজ্যগুলোর বাজেটকে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে পরিবর্তন করেছে। কোভিডের আগে প্রণীত রাজ্য পর্যায়ের বাজেটে গড় ঘাটতি ছিল ২.৪ শতাংশ, জাতীয় লকডাউনের পর গেল অর্থবছরের শেষ নাগাদ তা বেড়ে দাঁড়ায় ৪.৬ শতাংশে।
৩১ মার্চ সমাপ্ত অর্থবছরে ভারতের সবচেয়ে জনবহুল রাজ্য উত্তর প্রদেশে এই ব্যবধান সেখানকার মোট জিডিপির ৪.১৭ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। অথচ প্রদেশটির ৩ শতাংশ বাজেট ঘাটতির সীমা নির্ধারণ করেছিল আরবিআই। অন্যদিকে, ভারতের সবচেয়ে অস্বচ্ছল রাজ্য বিহারে এই ব্যবধান ৭ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধির অনুমান করা হয়েছে।
চলতি অর্থবছরেও তারা এই বড় ঘাটতি পূরণের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারবে না। এবার জাতীয় লকডাউন না দেওয়া হলেও, ভাইরাসের প্রাণসংহারী বিনাশ ঠেকাতে স্থানীয় পর্যায়ে চলাচলে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে বেশ কিছু রাজ্য। নিষেধাজ্ঞায় তাদের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড স্থবির হওয়ায়, রাজস্ব আয়ও কমেছে। এই দশা দেখে অর্থনীতিবিদদের অনেকেই কিছু রাজ্যের ক্ষেত্রে ইতঃপূর্বে তারা যে দুই অঙ্কের প্রবৃদ্ধির আভাস দিয়েছিলেন, তা সংশোধন করে কমিয়ে আনার কথা ভাবতে বাধ্য হচ্ছেন।
ব্লুমবার্গ ইকোনমিক্স যা বলছে...
"মার্চের শেষ সপ্তাহ থেকে ভারতে দৈনন্দিন কর্মকাণ্ডের সূচক ধারাবাহিকভাবে পতনের মুখ দেখেছে। দেশটির নানা অংশে আরোপিত কঠোর লকডাউনের সঙ্গে সঙ্গতি রেখেই এমন ঘটনা লক্ষ্য করা গেছে"
নোমুরার ভারতে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের সূচক- বিজনেস রিসাম্পশন ইনডেক্স গত ১৬ মে'তে সমাপ্ত সপ্তাহে ৬১.৯ পয়েন্টে নেমে আসে। গেল বছরের জুনের পর এত বড় মাত্রায় পতনের এটাই প্রথম ঘটনা। অথচ সাত দিন আগেও এটি ৬৬.১ পয়েন্ট অবস্থানে ছিল। আর্থিক সেবা দাতা ও বিশ্লেষক সংস্থা নোমুরার গ্রাহকদের- প্রতিষ্ঠানটির অর্থনীতিবিদ সোনাল ভার্মা এবং অরোদ্বিপ নন্দী গবেষণা নোটে জানিয়েছেন, জনজীবনের গতিশীলতা উল্লেখযোগ্য মাত্রায় হ্রাস পাওয়ার ঘটনাই আসলে এই সূচক পতনের মূল চালিকাশক্তি।
বৈশ্বিক রেটিংস সংস্থা মুডিসের ভারতীয় শাখা আইসিআরএ লিমিটেডের প্রধান অর্থনীতিবিদ অদিতি নায়ার জানান, "স্বল্পমেয়াদি অর্থনীতির আভাসে আবারও উঁকি দিচ্ছে অনিশ্চয়তার কালো মেঘ। দুঃসহ এই পরিস্থিতি রাজ্য সরকারের পরোক্ষ রাজস্ব আদায়কে যথেষ্ট পরিমাণে সীমিত করবে।"
ঘাটতি পূরণে এরমধ্যেই অব্যবহৃত সরকারি সম্পত্তি বিক্রি বা ইজারা দেওয়ার পরিকল্পনা করছে ভারতের পশ্চিমাঞ্চলীয় প্রদেশ রাজস্থান। দক্ষিণের তেলেঙ্গানা রাজ্য সরকারি জমির অংশ বিশেষ বিক্রি করে সাড়ে ১৪ হাজার কোটি রুপি সংগ্রহের পরিকল্পনা করছে বলে স্থানীয় গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ সূত্রে জানা যায়।
কিন্তু, এসব পরিকল্পনা ও বিক্রির উদ্যোগ সফল হবে তার গ্যারান্টি দেওয়া যায় না। গত দুই বছর ধরে এমনকি কেন্দ্রীয় সরকারও রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান এয়ার ইন্ডিয়া লিমিটেড এবং ভারত পেট্রোলিয়াম কর্পকে বিক্রির লক্ষ্যমাত্রা পূরণে ব্যর্থ হয়। স্থগিত এসব বিক্রির প্রক্রিয়া বাধ্য হয়েই আবার চলতি বছরে নিয়ে আসা হয়েছে।
উত্তরের রাজ্য পাঞ্জাবে বাজেটের মূল খরচ কমিয়ে- তার পরিবর্তে স্বাস্থ্য সেবা খাতে খরচ বৃদ্ধির উদ্যোগ নিয়েছে বলে জানিয়েছেন প্রাদেশিক অর্থমন্ত্রী মনপ্রিত সিং বাদল।
"রাজ্যগুলোকে নিজেদের অর্থ সংস্থান করতে হচ্ছে। চলতি বছর আমরা নিজেদের স্বাস্থ্য বাজেট ১৮ শতাংশ বাড়ালেও, এই জরুরি অবস্থার কারণে সেটির পরিধি আরও অনেক বাড়বে। এছাড়া অন্য কোনো উপায়ও নেই," তিনি যোগ করেন।
- সূত্র: ব্লুমবার্গ