বাংলাদেশে দুর্নীতি উন্মোচনকারী সাংবাদিক গ্রেপ্তার: এপি
"প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি নিয়ে দৃঢ় লেখনীর জন্য সুপরিচিত এক সাংবাদিককে গ্রেপ্তার করেছে বাংলাদেশের প্রশাসন, তাকে ঔপনেবেশিক আমলে প্রণীত কুখ্যাত 'অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্টের আওতায় গ্রেপ্তার করা হয়। কতৃত্ববাদী এই আইনে আসামীর সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড দেওয়ারও বিধান রয়েছে।"
আজ মঙ্গলবার যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী দৈনিক ওয়াশিংটন পোস্টের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত বার্তা সংস্থা অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসের (এপি) প্রতিবেদনে ঠিক এভাবেই দৈনিক প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক রোজিনা ইসলামের গ্রেপ্তারের ঘটনা তুলে ধরা হয়।
সেখানে বলা হয়, "রোজিনার বিরুদ্ধে কর্তৃপক্ষের অভিযোগ, তিনি অনুমতি ছাড়া নিজের মুঠোফোনের ক্যামেরায় সরকারের ভ্যাকসিন ক্রয় সংক্রান্ত আলোচনার নথিপত্রের ছবি তুলেছেন। আলোচনা প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তার ঘরে বসে তার অপেক্ষা করার সময়েই রোজিনা এমন কাজ করেন। বার্তা সংস্থা এপি রোজিনার বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলার অভিযোগপত্র দেখে এব্যাপারে নিশ্চিত হয়। অথচ, রোজিনা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়সহ সরকারের অন্যান্য বিভাগের অসাধুতা নিয়ে সম্প্রতি বেশকিছু প্রতিবেদন লেখেন। বাংলাদেশে করোনাভাইরাস মহামারি চলাকালে লাখ লাখ ডলার মূল্যের চিকিৎসা উপকরণ এবং সুরক্ষা সামগ্রী কেনার অনিয়ম তার অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা ও সাবলীল লেখনীর গুণে জনসম্মুখে প্রকাশ পায়।"
গত সোমবার পেশাগত দায়িত্ব পালনে সচিবালয়ে গেলে তাকে স্বাস্থ্য সচিবের এক ব্যক্তিগত সহকারীর কক্ষে পাঁচ ঘন্টার বেশি সময় আটকে রাখা হয়, বলে জানিয়েছেন তার বোন সাবরিনা পারভিন। রোজিনার পরিবার জানিয়েছে, আটক রাখার সময় তাকে শারীরিক ও মানসিকভাবে হেনস্থা করা হয়।
এরপর, পুলিশের হাতে সোপর্দ করে তার বিরুদ্ধে অফিসিয়াল সিক্রেটস আইনের ধারায় মামলা করা হয়। সংবেদনশীল রাষ্ট্রীয় নথিপত্রের ছবি তোলার জন্যেই এই মামলা বলে জানান ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত ডেপুটি কমিশনার হারুন অর রশীদ।
সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ রাজশক্তির আমলে প্রণীত এই আইন জনগণের কাছে সরকারি নীতি গোপন রাখার স্বার্থেই করা হয়, রোজিনার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ প্রমাণিত হলে মৃত্যুদণ্ড বিধানের সম্ভাবনাও রয়েছে, বলে এক বিবৃতিতে জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক ভিত্তিক গণমাধ্যম অধিকার গোষ্ঠী-কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্টস (সিপিজে)।
অন্যদিকে, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একজন মুখপাত্র মঈদুল ইসলাম প্রধানও জানান যে, রোজিনা বেশকিছু 'গুরুত্বপূর্ণ' নথির ছবি তুলেছেন।
"তিনি কিছু নথি (ছবি) নিয়ে চলে যাচ্ছিলেন, তখন একজন অতিরিক্ত সচিব এবং একজন পুলিশ কর্মকর্তা তাকে আটকান, পরবর্তীতে নারী পুলিশ সদস্যদের ডেকে আনা হয়," এমনটাই দাবি করেন মঈদুল।
এদিকে আজ মঙ্গলবার (১৮ মে) রোজিনাকে ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালতে হাজির করার পর জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তাকে পাঁচদিনের রিমান্ডে নেওয়ার আবেদন করে পুলিশ, অন্যদিকে আসামী পক্ষের আইনজীবীরা জামিনে মুক্তি দেওয়ার আপিল করে। আদালত উভয় আপিল খারিজ করে দেন, তবে তার জামিনের ব্যাপারে আগামী বৃহস্পতিবার শুনানি হবে বলে জানান আসামীপক্ষের আইনজীবী এহসানুল হক সমাজী।
নিউইয়র্কের সিপিজেসহ বাংলাদেশের সাংবাদিক সংগঠনগুলো অবিলম্বে রোজিনার মুক্তি দাবি করেছে।
সিপিজের জ্যেষ্ঠ এশিয়া গবেষক আলিয়া ইফতেখার বলেন, "বাংলাদেশের কর্মকর্তারা একজন সাংবাদিককে আটকে রাখেন, এরপর আবার তার নামে ঔপনেবেশিক আমলের কুখ্যাত আইনে মামলা করেছেন। এই আইনে তাকে কঠোর সাজা দেওয়া যেতে পারে। এসব ঘটনায় আমরা ভীষণ উদ্বিগ্ন।
তিনি আরও বলেন, "রোজিনা ইসলাম একজন সাংবাদিক, তার পেশা জনসেবামূলক। বাংলাদেশের পুলিশ ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে এই সত্য অনুধাবন করে তার বিরুদ্ধে মামলা প্রত্যাহার করাসহ অবিলম্বে তাকে মুক্তি দিতে হবে।"
চলতি মাসের শুরুতেই নিউইয়র্ক ভিত্তিক মানবাধিকার গোষ্ঠী হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ) জানায়, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বহুল ব্যবহারের কারণে বাংলাদেশের সাংবাদিকরা গ্রেপ্তার, নির্যাতন এবং হেনস্তার ঝুঁকি নিয়েই পেশাগত দায়িত্ব পালন করছেন।
২০২০ সালে বাংলাদেশে সরকারি কর্মকর্তা এবং তাদের সহযোগী অন্যান্যদের হাতে মোট ২৪৭ জন সাংবাদিক শারীরিক আগ্রাসন, হেনস্তা এবং হুমকি-ধামকির শিকার হন বলে জানায় এইচআরডব্লিউ। এছাড়া, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হয় ৯০০টি, যেখানে মোট ১,০০০ জনকে অভিযুক্ত করা হয়, যাদের অনেকেই ছিলেন সাংবাদিক।
- সূত্র: ওয়াশিংটন পোস্ট