ঝুঁকিতে কিনব্রিজ, আটকে আছে সংস্কার কাজ
দীর্ঘদিন ধরে জরাজীর্ন অবস্থায় রয়েছে ৮৭ বছরের পুরোনো সিলেটের ঐতিহ্যবাহী কিনব্রিজ। সুরমা নদীর উপর নির্মিত এই সেতুকে ইতোমধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। তবে একাধিকবার এই সেতুর সৌন্দর্যবর্ধন ও সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হলেও বাস্তবায়ন হচ্ছে না।
সর্বশেষ গত জানুয়ারিতে এই সেতুর সংস্কারে ২ কোটি ৮১ লাখ টাকা বরাদ্দ দেয় সড়ক ও জনপথ মন্ত্রণালয়। সংস্কারের কার্যাদেশও হয়। এরপরও সংস্কার কাজ শুরু হয়নি। ফলে ঝুঁকি নিয়েই এই সেতু দিয়ে চলছে যানবাহন।
জানা যায়, সুরমা নদীর উত্তর ও দক্ষিণ পাড়কে সংযুক্ত করা কিনব্রিজ ঘিরে বিকল্প পরিকল্পনা করেছিল সিলেট সিটি করপোরেশন (সিসিক)। তারা 'ঝুঁকিপূর্ণ' এই সেতু দিয়ে সব ধরনের যান চলাচল বন্ধ করে এটিকে পদচারী সেতুতে পরিণত করার উদ্যোগ নিয়েছিল। সিসিকের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, এটি হবে দেশের দীর্ঘতম পদচারী সেতু।
এই উদ্যোগের অংশ হিসেবে সেতুর দুই পাশে লোহার বেষ্টনী লাগিয়ে বন্ধ করে দেয়া হয় যান চলাচল। তবে স্থানীয় লোকজনের আপত্তির মুখে সেই উদ্যোগ বাধাগ্রস্ত হয়। এ সময় সিসিকের পক্ষ থেকে কিনব্রিজ সংস্কারের কথা বলা হলেও কোনো সংস্কারকাজ করা হয়নি।
এরপর গত বছর কিনব্রিজ সংস্কারের বিষয়ে সিলেট বিভাগীয় কমিশনার কার্যালয়ে বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের সমন্বয় সভায় আলোচনা করা হয়। সেখানে সেতু সংস্কারের বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে তিন সদস্যের একটি কমিটি করে দেওয়া হয়। পরবর্তীতে সওজের পক্ষ থেকে সেতুটি সংস্কারে মন্ত্রণালয়ের কাছে অর্থ বরাদ্দ চেয়ে আবেদন করা হয়। গত জানুয়ারিতে এই টাকা বরাদ্দ পেয়েছে সওজ সিলেট অফিস। তবে এর সংস্কার কাজ করবে রেলওয়ে মন্ত্রণালয়। দুই মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়হীনতার কারণে বরাদ্ধ আসার পরও কাজ শুরু হচ্ছে না।
এ ব্যাপারে সওজ সিলেটের নির্বাহী প্রকৌশলী মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, কিনব্রিজ সংস্কারের জন্য আমরা বরাদ্ধ পেয়ে গেছি। কার্যাদেশও হয়ে হয়ে গেছে।
তিনি বলেন, "এই সেতু রেলওয়ে বিভাগ নির্মাণ করেছিলো। দেশে এধরণের সেতুগুলো তারাই সংষ্কার করে থাকে। এক্ষেত্রে তারা দক্ষ। তাই কিনব্রিজও রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ সংস্কার করবে। তবে কিছু জটিলতার কারণে তাদের কাছে টাকা হস্তান্তর করতে ৩/৪ মাস সময় লেগে গেছে। তবে এখন জটিলতা কেটে গেছে। আগামী সপ্তাহেই আমি টাকা হস্তান্তর করবো। এরপর তারা কাজ শুরু করবেন।"
১৯৩৩ সালে নির্মিত হয় ১ হাজার ১৫০ ফুট দৈর্ঘ্যের ও ১৮ ফুট প্রস্থের কিনব্রিজ। এটি চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হয় ১৯৩৬ সালে। ভারতের আসাম প্রদেশের তৎকালীন গভর্নর মাইকেল কিনের নামে এটি নামকরণ করা হয়। ধনুকের মতো বাঁকানো লৌহনির্মিত এই লালরঙা সেতুটি পর্যটকদের কাছেও আকর্ষণীয়। দীর্ঘদিন ধরে সংস্কার না হওয়ায় নড়বড়ে হয়ে পড়েছে পুরনো এই সেতুটি। যানবাহনের ভারে প্রায়ই কেঁপে ওঠে। ঝুঁকির কারণে রিকশা-অটোরিকশা ছাড়া এই সেতু দিয়ে সব ধরণের যান চলাচল বন্ধ করা হয়েছে। এ অবস্থায়ও সেতুটিতে সবসময় যানবাহনের জট লেগে থাকে। এছাড়া সেতুর উপর খানাখন্দের সৃষ্টি হয়েছে।
সওজ সূত্রে জানা যায়, মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানিরা সেতুটি ধ্বংস করে দিয়েছিলো। এরপর সেতুটির বড় ধরনের সংস্কার কাজ করা হয়। পরবর্তীতে আর বড় আকারে সংস্কার হয়নি।
সিসিক কর্মকর্তারা জানান, সুরমা নদী, কিনব্রিজ, আলী আমজাদের ঘড়ি ঘিরে পর্যটকদের আনাগোনা থাকে। তাই এই এলাকা পর্যটকবান্ধব হিসেবে গড়ে তোলার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল। এই অঞ্চলে যান চলাচল কমিয়ে পুরো এলাকার সৌন্দর্য বর্ধনেরও উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। এই উদ্যোগের অংশ হিসেবে ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বেরে সেতুর দুইপাশে 'ঝুঁকিপূর্ণ' লেখা সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে লোহার বেস্টনি লাগিয়ে সব ধরনের যান চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়। সিসিকের পরিকল্পনায় তখন সায় দিয়েছিল সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদপ্তরও।
তবে কিনব্রিজ দিয়ে যান চলাচল বন্ধ করে দেয়ার পর সেতুর দক্ষিণ পাড়ের বাসিন্দারা বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। তাদের যাতায়াত সুবিধার জন্য এ সেতু দিয়ে যান চলাচল অব্যাহত রাখার দাবি জানান। কিছুদিন পর কিনব্রিজের উভয় প্রবেশপথে লাগানো লোহার বেষ্টনী ভেঙে রিকশা চলাচল শুরু হয়। এরপর ধীরে ধীরে প্রায় পুরো বেষ্টনীই গায়েব হয়ে যায়। 'ঝুঁকিপূর্ণ' ঘোষিত এই সেতু দিয়ে এখন চলছে সব ধরনের যানবাহন।
এ প্রসঙ্গে সিসিকের প্রধান প্রকৌশলী নূর আজিজুর রহমান বলেন, "কিনব্রিজ সড়ক ও জনপথের অধীনে। ফলে আমরা উদ্যোগ নিলেও সংস্কারকাজ সওজকেই করতে হবে। এ জন্য বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়ে সমন্বয় সভায় কমিটিও করে দেওয়া হয়েছে। এখন সংস্কারের বিষয়টি সওজই ভালো বলতে পারবে।"
ওই কর্মকর্তা বলেন, "কিনব্রিজ দিয়ে যান চলাচল করতে দেওয়া হবে কি না, এ বিষয়ে সংস্কারকাজ শেষে সিদ্ধান্ত নেয়া হতে পারে।"