প্রথম বারের মতো ঋণদাতার কাতারে বাংলাদেশ
বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে ঋণগ্রস্ত শ্রীলঙ্কাকে ২০ কোটি ডলার ঋণ সহায়তা প্রদানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে, এ ধরনের বিনিয়োগের ক্ষেত্রে অভ্যন্তরীণ তহবিল বিনিয়োগ নীতিমালা অনুযায়ী আদর্শ মূল্যায়ন রেটিংয়ের শর্ত পূরণ না করেও ঋণ পেতে চলেছে প্রতিবেশী এই রাষ্ট্র।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রথমবারের মতো কোনো দেশের সাথে মুদ্রা বিনিময় বা কারেন্সি সোয়াপ চুক্তির মাধ্যমে এ ধরনের বিনিয়োগ করতে চলেছে।
শ্রীলঙ্কার তারল্য সহায়তা বা লিকুইডিটি সাপোর্টের অনুরোধ রক্ষার্থে সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ বিশেষ বিবেচনায় ঋণচুক্তির অনুমোদন প্রদান করে।
আন্তর্জাতিক মূল্যায়ন সংস্থাগুলো যখন শ্রীলঙ্কার ঋণ খেলাপী হওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করেছে, ঠিক তখন কেন্দ্রীয় ব্যাংক তখন এই বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
অভ্যন্তরীণ তহবিল বিনিয়োগ নীতিমালা অনুযায়ী, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে বাংলাদেশ ব্যাংক ইউএস ট্রেজারি বিলের মতো বিভিন্ন দেশের উচ্চমান সম্পন্ন ঝুঁকিমুক্ত বিল এবং বন্ডে বিনিয়োগ করতে পারবে।
বৈশ্বিক মূল্যায়ন সংস্থা এসঅ্যান্ডপির রেটিং অনুযায়ী, ২০২০ সালে দীর্ঘমেয়াদী বৈদেশিক মুদ্রা ঋণের রেটিংয়ে বি মাইনাস থেকে শ্রীলঙ্কার মান ত্রিপল সি প্লাসে নেমে আসে। দ্বীপরাষ্ট্রের জন্য এই রেটিং খেলাপী হওয়ায় ঝুঁকি প্রকাশ করছে।
শ্রীলঙ্কার ঋণ নেওয়ার যোগ্যতা নির্ণায়ক ক্রেডিট স্কোর বর্তমানে আর্জেন্টিনা, মোজাম্বিক এবং বেলিজের সমান।
অপর আন্তর্জাতিক মূল্যায়ন সংস্থা মুডি'জের হিসাবেও দীর্ঘমেয়াদী বৈদেশিক মুদ্রা গৃহীতা হিসেবে শ্রীলঙ্কার সরকারের অবস্থান নিচের দিকে নেমেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সাধারণত মুডি'জের মূল্যায়ন বিবেচনা করে থাকে। গত বছরের সেপ্টেম্বরে সংস্থাটি তাদের ঋণ সূচক সিনিয়র আনসিকিউরড রেটিংয়ে শ্রীলঙ্কার অবস্থান বি২ ধাপ থেকে সিএএ১ ধাপে নামিয়ে আনে।
শ্রীলঙ্কার ভঙ্গুর তহবিল ব্যবস্থা এবং বাহ্যিক অবস্থান মহামারি-চালিত বিপর্যয়ে আরও দুর্বল হওয়ার ইঙ্গিত দিচ্ছে এই মূল্যায়ন রেটিং।
মুডি'জের মূল্যায়ন অনুসারে, আসন্ন বছরগুলোতে শ্রীলঙ্কার প্রায় অরক্ষিত তহবিল উৎস থেকে সৃষ্ট উচ্চ তারল্য এবং বাহ্যিক ঝুঁকির সাথে বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ ব্যবস্থা মুখোমুখি হবে। বাজারে পুনঃবিনিয়োগের বিষয়টি তখনও বিনিয়োগকারীদের অস্থিতিশীল মনোভাবের কারণে ঝুঁকিপূর্ণ থাকবে।
বিনিয়োগ চুক্তি অনুসারে, বাংলাদেশ ব্যাংক দুই শতাংশ সুদে ঋণ প্রদান করবে। বর্তমানে প্রচলিত অন্যান্য আন্তর্জাতিক সুদহারের তুলনায় এই হার বেশ উচ্চ। চুক্তি অনুযায়ী এক বছর ধরে এই অর্থ সরবরাহ করা হবে। অর্থায়ন লাভের পর শ্রীলঙ্কাকে তিন মাসের মধ্যে ঋণ পরিশোধ করতে হবে।
চুক্তি অনুযায়ী, শ্রীলঙ্কা বাংলাদেশের সাথে ২০ কোটি ডলারের সমমূল্যের শ্রীলঙ্কান মুদ্রা বিনিময় করবে। এক্ষেত্রে সরকারি নিশ্চয়তাও প্রদান করা হবে।
দেশটি ভারত এবং চীনের কাছ থেকে একই ধরনের বিনিময় চুক্তির মাধ্যমে তহবিল সংগ্রহ করেছে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী এবং স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীর যৌথ উদযাপনকালে মার্চে শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দ রাজাপক্ষ বাংলাদেশে আসলে এই মুদ্রা বিনিয়োগ উদ্যোগ গৃহীত হয়।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, উচ্চ বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থাকায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক ঝুঁকিপূর্ণ এই বিনিয়োগে সম্মত হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, মে মাসের প্রথম সপ্তাহে দেশে বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ৪৪ বিলিয়ন ডলার, যা আট মাসের জন্য আমদানি ব্যয় মেটাতে যথেষ্ট।
কোনো দেশের বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ তিন থেকে আট মাসের আমদানি ব্যয় মেটাতে সক্ষম হলে তা যথাযথ হিসেবে গণ্য করে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)।
বিনিময় চুক্তির জন্য বিনিয়োগ নীতিমালা থেকে সরে আসার বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে দীর্ঘ সময় ধরে বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে থাকা ডেপুটি গভর্নর কাজী সাইদুর রহমান কোনো মন্তব্য করতে চাননি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র এবং নির্বাহী পরিচালক মোহাম্মদ সিরাজুল ইসলাম বলেন, "এই বিনিয়োগে কোনো ঝুঁকি নেই, কেননা বৈদেশিক মুদ্রার মজুদে আমাদের অবস্থান ভালো।"
এছাড়া, অন্যদের তুলনায় এই বিনিয়োগ থেকে উচ্চহারে সুদ পাওয়া যাবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ডক্টর জাহিদ হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি এই বিনিয়োগে লাভের চেয়ে ঝুঁকির সম্ভাবনাই বেশি বলে মন্তব্য করেন।
"শ্রীলঙ্কার সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক উন্নত করার লক্ষ্যে আমি এরকম আর্থিক প্রতিশ্রুতি প্রদানের কোনো কারণ দেখি না," বলেন তিনি।
বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা যথেষ্ট হলেও উচ্চ নয় বলে মন্তব্য করেন তিনি।
আমদানির পরিমাণ এরই মধ্যে বাড়তে চলেছে এবং কিছুদিনের মধ্যে ভোগ্যপণ্যের মূল্যও বৃদ্ধি পাওয়ায় আমদানি ব্যয় বাড়বে বলে উল্লেখ করেন ড. জাহিদ হোসেন।
"বর্তমান বৈদেশিক মুদ্রা মজুদ দিয়ে আট মাসের আমদানি খরচ পূরণ করা যাবে। স্বাভাবিক সময়ে, মাসিক আমদানিতে পাঁচ থেকে ছয় বিলিয়ন ডলার ব্যয় হয়। জ্বালানি তেলসহ বৈশ্বিক ভোগ্যপণ্যের মূল্য বৃদ্ধি পেলে রিজার্ভের ওপর চাপ সৃষ্টি হবে," বলেন তিনি।
করোনা ভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউ আসার আগে অর্থনৈতিক কার্যক্রম কয়েক মাসে স্বাভাবিক হতে শুরু করায় আমদানি বাড়তে শুরু করে।
ফলস্বরূপ, চলতি হিসাবের অতিরিক্ত জমাখরচ কমতে থাকে। মার্চ মাসে চাল এবং শিল্প প্রতিষ্ঠানের কাঁচামাল আমদানির ফলে উদ্বৃত্ত অর্থের পরিমাণ হঠাৎ করেই হ্রাস পায়।
চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে মার্চ পর্যন্ত সময়কালে, উদ্বৃত্ত অর্থের পরিমাণ কেবল জুলাই থেকে ফেব্রুয়ারি নাগাদ ১.৩৬ বিলিয়ন ডলার থেকে ১২৫ মিলিয়ন ডলারে নেমে আসে। ফেব্রুয়ারি মাসে ৬৫২ মিলিয়ন ডলার উদ্বৃত্ত অর্থ হ্রাস পায়।
বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ ব্যাংক প্রকাশিত এক প্রতিবেদনের হালনাগাদে দেখা যায় যে, গত অর্থ বছরের তুলনায় চলতি অর্থবছরের জুলাই-মার্চ মাস পর্যন্ত সময়ে আমদানি ৬ শতাংশ বা ৪২.৭৬ বিলিয়ন ডলার পর্যন্ত বৃদ্ধি পায়।
খাদ্য মজুদ বাড়াতে সরকার চাল আমদানিতে ব্যয় বৃদ্ধি করায় আমদানি বাড়ে। এছাড়া, খনিজ তেলসহ শিল্পোৎপাদনে ব্যবহৃত অন্তর্বর্তীকালীন কাঁচামাল আমদানিও উল্লেখজনক হারে বৃদ্ধি পায়।
চলতি অর্থ বছরের প্রথম নয় মাসে সরকার চাল আমদানিতে ২০০ কোটি ডলার অর্থ ব্যয় করে। গত বছর একই সময়ের তুলনায় আমদানি ৪১ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পায়।
একই সময়ে, ভোক্তা সামগ্রীর আমদানির পরিমাণ ৪ দশমিক ৩৯ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে ২৮৬ কোটি ডলারে গিয়ে দাঁড়ায়।
- সংবাদটি ইংরেজিতে পড়ুন: Bangladesh becomes a lender for first time