কোভিডের উৎস হিসেবে বিজ্ঞানীদের কাছে ল্যাব-লিকেজ তত্ত্বই কেন জোরাল?
দেশের অর্ধেক জনসংখ্যাকে টিকাদান করা এবং আরোপিত বিধিনিষেধ তুলে নেওয়ার মাধ্যমে কোভিড মহামারি নামের বিভীষিকাকে মোকাবিলার প্রায় দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।
কিন্তু জনজীবন প্রায় স্থবির করে দেওয়া এই সর্বনাশা ভাইরাসের প্রকৃত উৎস সম্পর্কে আমরা এখনো নিশ্চিত হতে পারছি না। তবে ভাইরাসটি যে স্রেফ প্রাকৃতিকভাবে ছড়ায়নি, সেদিকেই বিজ্ঞানীদের মতের পাল্লা ভারি।
ভাইরাসের উৎস সন্ধানের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের তৎপরতাই সবচেয়ে বেশি। ভবিষ্যতে আবারও মহামারি মোকাবিলার জন্য বারবার গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছে তারা। চীনা ল্যাব থেকেই যেকোনো ভুলের কারণে ভাইরাস ছড়িয়েছে- এখন পর্যন্ত এমনটাই ধারণা যুক্তরাষ্ট্রের।
কিন্তু চীনা সরকার ইতোমধ্যেই এই ব্যাপারে অনুসন্ধান বন্ধ করে দিয়েছে।
নতুন কিছু পাওয়া গেছে কী?
যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা বিভাগের এক প্রতিবেদনে জানা গেছে, চীনের উহান ইনস্টিটিউট অব ভাইরোলজির বেশ কিছু চীনা গবেষক ২০১৯ সালের নভেম্বরে অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং তাদের হাসপাতালে নিতে হয়। তাদের অসুস্থতার উপসর্গের বিস্তারিত তথ্য এখানে উঠে এসেছে। গবেষকরা কোভিড-১৯-এই আক্রান্ত হয়েছিলেন কি না, তা এখনো স্পষ্ট নয় এবং ল্যাব এই তথ্য সম্পূর্ণ অস্বীকার করেছে। তাদের দাবি, এই প্রতিবেদনের উদ্দেশ্যই হলো ভাইরাসের উৎস হিসেবে জোর করে তথাকথিত 'ল্যাব-লিকেজ তত্ত্ব'কে প্রতিষ্ঠা করা।
ইনস্টিটিউটের সঙ্গে যুক্ত অন্য বিজ্ঞানীরাও জানিয়েছেন, ২০১৯ সালের ৩০ ডিসেম্বরের আগ পর্যন্ত ইনস্টিটিউটের কেউ কোভিড-১৯-এর সংস্পর্শে আসেননি।
ভাইরাসটির পাশাপাশি বাদুড়ের মাধ্যমে এ ভাইরাস ছড়ানোর সম্ভাবনা নিয়ে গবেষণার জন্য অর্থ বরাদ্দ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। এর অংশ হিসেবেই উহান ইনস্টিটিউট অব ভাইরোলজিতে হাজির হয়েছেন মার্কিন গবেষকরা।
গত মঙ্গলবার ক্যাপিটল হিলে যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব অ্যালার্জি অ্যান্ড ইনফেকশাস ডিজিজের পরিচালক ডা অ্যান্থনি ফসি বলেন, ''চীনে বাদুড় থেকে ভাইরাস ছড়ানো নিয়ে গবেষণার বরাদ্দ না দেওয়া হলে তা 'কর্তব্যে অবহেলা' করা হতো। আপনি নিশ্চয়ই ভার্জিনিয়া কাউন্টিতে বসে বাদুড় এবং ভাইরাস সংক্রমণে প্রাণী-মানুষের মিথস্ক্রিয়ার তথ্য খুঁজবেন না। এর জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে মূল ঘটনাস্থলে যেতেই হতো।''
হোয়াইট হাউসে আলাদা এক অনুষ্ঠানে ফসি আরও জানান, 'অনেক বিজ্ঞানীই এখনো ভাবছেন, এই ভাইরাস প্রাকৃতিকভাবেই ছড়িয়েছে। কিন্তু আমাদের উচিত সঠিক তদন্তের মাধ্যমে তা খতিয়ে দেখা।'
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার উপদেষ্টা জেমি মেটজল বলেন, 'আরও কার্যকরী ভ্যাকসিন তৈরির ইতিবাচক মনোভাব নিয়ে যেখানে বিজ্ঞানীরা ভাইরাসের সঠিক উৎস বের করতে ক্রমাগত খেটে যাচ্ছেন, গবেষণা করছেন, তাতে ল্যাব-লিক তত্ত্ব সঠিক প্রমাণিত হওয়া অসম্ভব কিছু নয়। আমার বিশ্বাস, অপরাধমূলক কোনো কাজ ঢাকা দিতে গিয়েই সেখানে দুর্ঘটনাবশত একটি লিকেজ হয়েছিল।'
সংক্রামক রোগ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ বিশেষজ্ঞ ফসিও এ সপ্তাহে আরও জানিয়েছেন, তিনি মনে করেন না ভাইরাসটি প্রাকৃতিকভাবেই ছড়িয়েছে; তাই তিনি আরও অধিকতর তদন্ত করতে চান।
কোভিডের উৎস নিয়ে কর্তৃপক্ষের মন্তব্য সন্তোষজনক নয়
গত মার্চ মাসে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং চীনা সরকারের সম্মিলিতভাবে পরিচালিত একটি পূর্ণাঙ্গ গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়, যেখানে কোভিডের সম্ভাব্য সব উৎসের অনুসন্ধান করা হয়। যেহেতু রোগটি কীভাবে ছড়িয়েছে তা এখন প্রমাণ করা সম্ভব নয়, তাই খুব সম্ভবত সরাসরি বাদুড় কিংবা বাদুড়ের কাছ থেকে সংক্রমিত অন্য প্রাণীর দেহ হতে এ ভাইরাস মানবদেহে প্রবেশ করেছে বলে গবেষণার ইতি টানা হয়।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিবেদনে ল্যাব থেকে ভাইরাস ছড়ানো তত্ত্বকে 'অসম্ভব' বলে উল্লেখ করা হয়, যদিও তারা ২০১৯ সালের ডিসেম্বরের আগে সংক্রমণের শিকার হওয়া ল্যাবকর্মীর ঘাটতিকে এই তত্ত্বের বিপরীত যুক্তি হিসেবে উল্লেখ করেছে।
কিন্তু এই মুহূর্তে যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা বিভাগের প্রতিবেদন দাবি করেছে, ল্যাবকর্মীরা ডিসেম্বরের আগেই অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। প্রতিবেদন প্রকাশিত হওয়ার পর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা পুনরায় তদন্ত করার এবং চীনাদের আরও উদারভাবে তথ্য দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে।
শুরুতেই ধামাচাপার চেষ্টা
মহামারির শুরুর দিকে চীন বিশ্বকে সঠিকভাবে সতর্ক করেনি এবং চীনা কর্মকর্তারা উহানের একটি সী ফুড বাজারকে সংক্রমণের স্থান হিসেবে দায়ী করেছিলেন। কিন্তু মেটজল মনে করছেন, সেটি একটি ডাহা মিথ্যা ছিল।
বরং গোড়ার দিকেই ভাইরাসটির অস্তিত্বকে চীনা সরকারের ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করার যথেষ্ট প্রমাণাদি রয়েছে।
গত ফেব্রুয়ারিতে সিএনএন হুইসেলব্লোয়ার ও ট্রুথটেলাদের নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সেখানে দেখা যায়, যারা আগেই ভাইরাস সম্পর্কে সতর্ক করেছিলেন, তাদের সবাইকেই এর মূল্য চুকাতে হয়েছে। তাদের কেউ কেউ নিখোঁজ হয়েছেন, কাউকে আটক করা হয়েছে, আবার অনেকে কোভিডে আক্রান্ত হয়ে মারাও গেছেন।
চীনা সরকারের তুলনায় চীনা ডাক্তাররা বেশি সতর্কবার্তা দিয়েছেন, এমনটাও বলা হয়েছে ওই প্রতিবেদনে।
মেটজল বলেন, 'মহামারির উৎস যা ই হোক না কেন, প্রথম এক মাসে চীনা সরকার সমস্যা ঠিক করার চেয়ে তাদের সব শক্তি ব্যয় করেছে ভাইরাসের সংক্রমণ ধামাচাপা দেওয়ার পেছনে। আর সে কারণেই ছোট্ট স্টোভের আগুন থেকে প্রথমে রান্নাঘরে এবং তারপর গোটা বিশ্বে ছড়ানোর মতো করে ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়েছে।'
এমনকি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গবেষণার জন্যও প্রাথমিকভাবে খোলামেলাভাবে তদন্তের অনুমতি দেয়নি চীন। মার্কিন প্রশাসনসহ অন্যরাও চীনের এই অস্পষ্টতার সমালোচনা করেছে এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা আরও তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে।
ট্রাম্প বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা থেকে সরে এলেও বাইডেন প্রশাসন পুনরায় এর সঙ্গে যোগ দিয়েছে।
প্রয়োজন আরও গবেষণা
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ল্যাব-লিক তত্ত্বকে গুরুত্ব না দেওয়ায় সংস্থাটির প্রতিবেদনের সমালোচনা করেছেন অভিজ্ঞতাসম্পন্ন একদল খ্যাতনামা বিজ্ঞানী। তারা বলেন, ১০০ পৃষ্ঠার একটি প্রতিবেদনে এই তত্ত্ব নিয়ে আলোচনাকে হাতে গোনা কয়েক পৃষ্ঠায়ই সমাপ্ত করা হয়েছে।
সায়েন্স ম্যাগাজিনে বিজ্ঞানীরা লিখেছেন, 'আমাদের প্রাকৃতিক ও ল্যাবরেটরি থেকে ছড়ানো- এই দুই হাইপোথিসিসকেই গুরুত্ব দিতে হবে।'
ভাইরাসের ব্যাপারে চীনের অস্পষ্টতার ফলে ষড়যন্ত্রমূলক তত্ত্বও বেশ মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। আরকানসাসের সিনেটর টম কটনের মতে, চীন ইচ্ছাকৃতভাবে এই ভাইরাস তৈরি করেছে একটি বায়োওয়েপন হিসেবে। কিন্তু বিজ্ঞানীরা এর কোনো ভিত্তি নেই বলে জানিয়েছেন। কটনের মতো অনেকেই এ ধরনের সন্দেহ বা প্রশ্ন তোলার ফলেই বাইডেন প্রশাসন ভাইরাসের উৎস খোঁজায় বেশি তৎপর হয়েছে বলে জানায় দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট।
আসবে আরও মহামারি?
এদিকে করোনাভাইরাস সম্পর্কে চীন যথাসম্ভব হাত গুটিয়ে বসে থাকলেও এবং খোলামেলা তদন্ত করতে অনিচ্ছুক হলেও, যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব পেনসিলভানিয়া পেরেলমান স্কুল অব মেডিসিনের সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ ডা. পল অফিট বলেন, আরও একটি মহামারি মোকাবিলার জন্য প্রস্তুত থাকা উচিত বিশ্বের।
তিনি বলেন, 'গত ২০ বছরে এই নিয়ে তৃতীয়বার মহামারির স্ট্রেইন এলো। প্রথমে SARS 1, তারপর দ্বিতীয়টি এবং তারপর MERS। আমার মনে হয় না এটা এখানেই শেষ হবে। আরেকবার এই বিপদ সংঘটিত হবার সঙ্গে সঙ্গেই আমাদের তা শনাক্ত করতে হবে। উহানে ভাইরাসে মানুষ মারা যাচ্ছে তা জানতে হুইসেলব্লোয়ারের ওপর নির্ভর করা ঠিক না, এতে অনেক দেরি হয়ে যায়। এর কারণে আমরা দ্রুত পদক্ষেপ নিতে পারিনি এবং এটা তাদের দোষ।'
-
সূত্র: সিএনএন