চীন কেন জন্মহার বৃদ্ধি নিয়ে যুঝছে?
দম্পতিদের প্রতি অধিক পরিমাণ সন্তান নেওয়ার আহবান জানাচ্ছে চীন সরকার। কয়েক দশক ধরে পরিবারপ্রতি মাত্র এক সন্তান গ্রহণের নীতি ধরে রাখার পর, সাম্প্রতিক সময়ে এসে যা সম্পূর্ণ মোড় পরিবর্তন। কিন্তু, বেইজিংয়ের এই আকস্মিক অবস্থান বদলের কারণ কী?
আসলে চীনে বয়স্ক জনসংখ্যা বাড়ছে। সে তুলনায় কমছে কর্মক্ষম নাগরিকদের সংখ্যা। সাম্প্রতিক জনমিতির প্রাক্কালনে বলা হচ্ছে, ২০৩০ সাল নাগাদ মোট জনগণের এক-তৃতীয়াংশের বয়স হবে ৬০ বছর বা তার বেশি।
এই আভাসে হুমকিতে পড়েছে বিপুল ও সস্তা শ্রমের আধিক্যে অর্জিত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ভবিষ্যৎ। এটি বাস্তবে রূপ নিলে আগামীতে বয়স্কদের দেখাশোনার জন্য কর্মক্ষম তরুণ জনসংখ্যাতেও দেখা দেবে ঘাটতি। বেইজিংয়ের উদ্বেগ ও নীতিগত দিকপরিবর্তন এসব কিছু মিলিয়েই। চীনা নীতি-নির্ধারকরা মনে করছেন, জনসংখ্যার এই বয়সাধিক্য কমাতে অবিলম্বে কঠোর পদক্ষেপও নিতে হবে।
কী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে?
চীনের সমাজতন্ত্রী দলের সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষ পলিটব্যুরো গত ৩১ মে দম্পতিদের তৃতীয় সন্তান নেওয়ার অনুমতি দেয়। পাঁচ বছর আগে এক সন্তান নীতি বাতিল করে দুই সন্তান গ্রহণের অনুমতিও দেওয়া হয়।
চলতি বছর একটি নতুন আইনের মাধ্যমে পরিবার পরিকল্পনা বিষয়ক সাম্প্রতিক এই সিদ্ধান্ত মেনে চলা সকলের জন্য বাধ্যতামূলক করা হবে। পরবর্তীতে সন্তান গ্রহণ নিয়ন্ত্রণ সম্পূর্ণ রূপে বাতিলের সিদ্ধান্তও নিতে পারবে সরকার।
নতুন নীতিটি ঠিক কবে থেকে কার্যকর হচ্ছে, তা এখনও সুনির্দিষ্টভাবে জানা যায়নি। জনগণের মধ্যে এর প্রতিক্রিয়ার কেমন হবে- তাও অনিশ্চিত।
ইতঃপূর্বে দুটি সন্তান নেওয়ার অনুমতি চীনে প্রথম প্রথম বেশ ভালোই কাজ করেছিল। ফলস্বরূপ; ২০১৬ সালে নবজাতকের সংখ্যা আগের বছরের এক কোটি থেকে বেড়ে এক কোটি ৭৯ লাখে উন্নীত হয়। কিন্তু, তারপর আবারও প্রতিবছর কমতে থাকে জন্ম হার। ২০২০ সালে এসে নবজাতকের সংখ্যা ছিল এক কোটি ২০ লাখ, যা ১৯৬১ সালের পর সবচেয়ে কম। একইবছর, নারীপ্রতি সন্তান জন্মদানের হার কমে দাঁড়ায় ১.৩-এ। অথচ, জনসংখ্যা স্থিতিশীল রাখার জন্যেই এটি ন্যূনতম ২.১- এ থাকা দরকার। হিসাবটিতে অবশ্য অভিবাসনকে (বিদেশমুখী প্রবাহ) বাদ রাখা হয়েছে, সেটি সহকারে হিসাব করলে সঙ্কটের মাত্রা আরও ব্যাপক হবে।
তারপরও কী জনসংখ্যা বাড়ছে?
আপাতত জনসংখ্যা বাড়ছে বটে, কিন্তু খুব শিগগির তা সর্বোচ্চ সীমায় উপনীত হবে। যার অর্থ; তারপর দ্রুত পতন ঘটবে অবশ্যম্ভাবী রূপেই।
সরকারি আভাস অনুযায়ী, ২০৩০ সাল নাগাদ জনসংখ্যা বৃদ্ধি সর্বোচ্চ আকার নিয়ে ১৪৫ কোটি হবে। কিন্তু, সরকার সংশ্লিষ্ট একটি থিঙ্ক ট্যাঙ্কের ধারণা, ২০২৭ সালেই সর্বোচ্চ মাত্রাটি দেখা যেতে পারে। দেশটির রাষ্ট্রায়ত্ত গণমাধ্যম বলছে, আগামী বছরই এমনটি ঘটতে পারে।
২০২০ সালে চীনে ১৫- ৫৯ বছরের কর্মক্ষম নাগরিকরা মোট জনসংখ্যার মাত্র ৬৩.৪ শতাংশে নেমে আসে, এক দশক আগে যা ছিল ৭০ শতাংশ। এছাড়া, ২০১০ থেকে ২০২০ নাগাদ এক দশকে চীনের বার্ষিক জনসংখ্যা বৃদ্ধির গড় ছিল খুবই আশঙ্কাজনক বা শূন্য দশমিক ৫৩ শতাংশ। ১৯৫৩ সালের পর এতো ধীরগতি আর কখনোই দেখা যায়নি।
'এক-সন্তান' নীতিটি কেন নেওয়া হয়?
১৯৪৯ সালে গৃহযুদ্ধ অবসানের পর বিজয়ী পক্ষ চীনা সমাজতন্ত্রী দল দেশটির মূল ভূখণ্ডে গণচীন রাষ্ট্র গঠন করে। ওই সময় দেশটির প্রত্যন্ত এলাকায় স্বাস্থ্য সেবা ব্যবস্থা ছিল না বললেই চলে। পরিস্থিতির উন্নয়নে হাজার হাজার চিকিৎসককে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। তাদের বেশিরভাগই দুর্গম অঞ্চলে পায়ে হেঁটে স্বাস্থ্য সেবা দান করতেন। ফলস্বরূপ; মৃত্যুহার কমে এবং জনসংখ্যা স্ফীতি ১৯৪৯ সালের প্রতি হাজারে ১৬ জন থেকে পাঁচ বছর পর ২৫ জনে উন্নীত হয়।
পরিস্থিতি মোকাবিলায় ১৯৫৩ সালে প্রথমবারের মতো পরিবার পরিকল্পনা উৎসাহিতকরণের পদক্ষেপ নেয় কর্তৃপক্ষ। তারপরও, ১৯৬০- এর দশকের শেষ নাগাদ জনসংখ্যা ৮০ কোটি ছাড়িয়ে যায়। ফলস্বরূপ; ১৯৭০- এর দশকে খাদ্য ও আবাসন সঙ্কট দেখা দেয়।
সম্পদ অনুসারে আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের কথা মাথায় রেখে ১৯৭৯ সালে চীনের তৎকালীন রাষ্ট্রপ্রধান দেং জিয়াওপিং দম্পতিপ্রতি 'এক সন্তান' গ্রহণের নীতি ঘোষণা করেন। তবে গ্রামীণ কৃষক পরিবার, জাতিগত সংখ্যালঘু এবং বিশেষ কিছু পরিস্থিতিতে যেখানে এক সন্তান নীতি কোনো সম্প্রদায়কে বা উৎপাদনশীলতাকে হুমকির মুখে ফেলতে পারে, সেখানে কিছুটা ছাড় দেয় বেইজিং। নীতিটি জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে উচ্চ সফলতা লাভ করে। তবে এর মাধ্যমেই পরবর্তী দশকের জন সঙ্কটের বীজ প্রথিত হয়।
এক-সন্তান নীতি যেভাবে কার্যকর করা হয়?
মানবাধিকার গোষ্ঠী হিউম্যান রাইটস ওয়াচের মতে, ওই সময়ে চীনে নারীদের জোরপূর্বক গর্ভপাতে বাধ্য করা হয়। রাষ্ট্রীয় অনুমোদনের বাইরে জন্ম নেওয়া শিশুদের 'হকু' বলে পরিচিত জন্মনিবন্ধনে অন্তর্ভুক্ত করা হতো না, ফলে তারা বেশ কিছু সুবিধাও পেতো না। সব মিলিয়ে 'এক-সন্তান নীতি' চীনা সমাজে গভীর রেখাপাত করে।
ঐতিহ্যগতভাবে দেশটিতে ছেলে সন্তান কাম্যতা বেশি থাকায়, অনেক বাবা-মা কন্যা সন্তানের ভ্রূণ গর্ভপাতের মাধ্যমে নষ্ট করেছেন। একারণে, কিছু কিছু প্রদেশে পুরুষ ও নারীর অনুপাত ১২০:১০০- এ নেমে আসে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সন্তান জন্মদানের ক্ষেত্রে লিঙ্গ বৈষম্য অনেক কমেছে, এখন জাতীয় পর্যায়ে এই অনুপাত ১০৫:১০০। তবে গুয়ানডং এবং হাইনান দ্বীপের মতো কিছু এলাকায় এখনও নারীর তুলনায় পুরুষ সন্তান জন্মদানের আধিক্য রয়েছে, যা ১১০:১০০।
সঙ্কট সমাধানের উপায় কী?
বর্তমান যুগে এসে চীনা দম্পতিদের দুইয়ের অধিক সন্তান গ্রহণে উৎসাহিত করাটা বেশ কঠিন হতে পারে। পরিবারের সঙ্গে কাটানোর মতো সময় স্বল্পতা এবং আর্থিক সামর্থ্য নিয়ে উদ্বিগ্ন অনেকে দম্পতিই এখন মনে করেন, তারা মাত্র একটি সন্তানই প্রতিপালনে সক্ষম।
অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় চীনে এখন নারী কর্মীদের অংশগ্রহণও অনেক বেশি। "তাদের অনেকেই একাধিক সন্তান জন্মদান এবং সফল ক্যারিয়ার গড়াকে পারস্পরিক সাংঘর্ষিক অবস্থা হিসেবে দেখেন," বলে যুক্তরাষ্ট্রের ব্রাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ইয়ান ঝৌ'র একটি গবেষণায় জানানো হয়।
অন্যদিকে, মার্কিন কংগ্রেস কমিশনের তদন্ত সূত্রে জানা গেছে, চীনা নারীদের ধারণাটি বাস্তব বঞ্চণার ফলেই সৃষ্টি হয়েছে। কারণ, তারা গর্ভধারণ বা মাতৃত্বকালীন সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার ক্ষেত্রে তাদের কর্মদাতাদের থেকে বিপুল বৈষম্যের শিকার হন।
এসব বঞ্চণা দূর করা না হলে, স্বাভাবিকভাবেই নারীরা অধিক সন্তান জন্মদানে আগ্রহী হবেন না।
দুইয়ের অধিক সন্তান নেওয়া উর্বরতার হারে নিশ্চিত উন্নতি আনবে, কিন্তু তার আগে জনস্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের দেশজুড়ে স্বাস্থ্য সেবা ব্যবস্থার উন্নতি সাধন করতে হবে। দরকার হবে নতুন শিশুদের জন্য মানসম্মত শিক্ষার অবকাঠামোগত সম্প্রসারণ। তাছাড়া, সন্তান জন্মদানে উৎসাহিত করতে কর ছাড় দেওয়ার মতো সুবিধাও দিতে হবে।
রাষ্ট্রায়ত্ত বার্তা সংস্থা শিনহুয়ার একটি প্রতিবেদনে জানানো হয়, তিন সন্তান নীতি প্রণয়নের সঙ্গে সঙ্গে 'সরকারি সহায়তাগুলোও' কার্যকর করা হবে। একইসঙ্গে, চীনে অবসরগ্রহণের বয়স সীমাও বিবেচনাপূর্বক ধাপে ধাপে প্রত্যাহারের কথা জানানো হয়।
বিদেশি কর্মী গ্রহণে চীনে কঠোর নীতি বজায় থাকায় অভিবাসনের (অন্তর্মুখী) মাধ্যমে জনসংখ্যা ঘাটতি পূরণ সম্ভাব্য সমাধান হবে না। তবে সস্তা শ্রমের চাহিদা পূরণে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ছে চীনের কারখানাগুলোয়। ইতোমধ্যেই, শ্রমিক সঙ্কটে চীনের পার্ল নদীর অববাহিকায় অবস্থিত দেশটির বৃহৎ রপ্তানিমুখী শিল্পকেন্দ্র স্বয়ংক্রিয় উৎপাদন ব্যবস্থা স্থাপনসহ রোবট ব্যবহারে বিপুল বিনিয়োগ করছে।
- সূত্র: ব্লুমবার্গ