জনতুষ্টির রাজনীতি: নেতানিয়াহুর উত্থান-পতন
ধারণা করা হচ্ছে, প্রায় ২৫ বছর ধরে ইসরায়েলের রাজনীতিতে আধিপত্য বিস্তারকারী প্রভাবশালী নেতা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু যুগের অবসান ঘটতে চলেছে আগামী দুই দিনের মধ্যেই। গত দুই বছরে চারবার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে বিশ্বের একমাত্র ইহুদি রাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্যের ইসরায়েলে। কিন্তু বিগত ১২ বছর ধরে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বে থাকা লিকুদ পার্টি প্রধান নেতানিয়াহু নির্বাচনী ফলাফলে এগিয়ে থাকলেও অন্যান্য দলগুলো নিয়ে সরকার গঠনে ব্যর্থ হচ্ছেন বার বার। ফলে নির্ধারিত সময় অতিক্রম হওয়ায় উগ্র-জাতীয়তাবাদী নেতা নাফতালি বেনেট সরকার গঠনের সুযোগ পেয়েছেন। বেনেট ইতোমধ্যে ঘোষণাও দিয়েছেন, তিনি মধ্যপন্থী ইয়াইর লাপিদের সঙ্গে সরকার গঠনের ব্যাপারে আলোচনায় বসবেন। বেনেটের এমন ঘোষণা এবং বিরোধী দলগুলোর সাম্প্রতিক মনোভাবে নেতানিয়াহুর ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার ব্যাপারটা মোটামুটি স্পষ্টই হয়ে উঠেছে।
ইসরায়েলের সংবিধান অনুযায়ী কোনো রাজনৈতিক পদস্থ ব্যক্তির বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ প্রমাণ হলে তাকে পদত্যাগ করতে হয়। অথচ নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে ঘুষ গ্রহণ, বিশ্বাসভঙ্গ ও দুর্নীতির তিনটি আলাদা আলাদা মামলা বিচারাধীন থাকলেও তিনি নির্লিপ্তভাবে ক্ষমতায় বসে আছেন, যা ইসরায়েলের জনগণকে মারাত্মকভাবে ক্ষুব্ধ করে তুলেছে। গেলো বছর জুলাই-আগস্টের দিকে নেতানিয়াহুর বাড়ির সামনে তার পদত্যাগ চেয়ে সাধারণ জনগণ প্রতিবাদ চালাতে থাকে। এ বছরের শুরুতেও নির্বাচনের ঠিক দুইদিন আগে জনগণ একইভাবে নেতানিয়াহুর বাড়ির সামনে "বিবি বাড়ি যাও" (নেতানিয়াহুর ডাকনাম বিবি। তিনি ইসরায়েলে "কিং বিবি" হিসেবে অধিক পরিচিত) বলে স্লোগান দিতে থাকে। মোটকথা, ইসরায়েলের জনগণের একাংশ নেতানিয়াহুকে এখন তার তাদের নেতা হিসেবে দেখতে চায়না।
কিন্তু ইসরায়েলের তথাকথিত সম্মোহনী ক্ষমতাধারী নেতা নেতানিয়াহুকে কেনো তার জনগণ নেতৃত্বস্থানে আর দেখতে চাচ্ছেনা? যেখানে নেতানিয়াহু ইহুদি জাতীয়তাবাদকে একত্র করার জন্য সবকিছু করছেন, আরব-ফিলিস্তিনিদের চরমহস্তে দাবিয়ে রাখার সব ধরণের সম্ভাব্য নীতি গোপনে এবং প্রকাশ্যে গ্রহণ করেছেন, তারপরেও কেনো জনগণের একাংশের কাছে তিনি জনপ্রিয়তা হারালেন? কেনো বিরোধী দলগুলোকেও সরকার গঠনে চুক্তির টেবিলে বসাতে পারলেন না?
এসব প্রশ্নের উত্তরের জন্য নেতানিয়াহুর উত্থান ইতিহাস সম্পর্কে সামান্য ধারণা নিতে হবে। ১৯৪৮ সালে ইসরায়েল রাষ্ট্রের জন্মের কিছুদিন পরেই ১৯৪৯ সালে জন্ম নেন ইসরায়েলের ইতিহাসে সবচেয়ে জনতুষ্টবাদী চতুর নেতা বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু। ১৯৬৭ সালে যখন ইসরায়েল আরবদের পরাজিত করে ফিলিস্তিনের অধিকাংশ ভূমি দখল করে নেয়, ঠিক সেই সময়ে নেতানিয়াহু ইসারায়েলের সামরিক বাহিনীতে যোগদান করেন।
সেনাবাহিনীতে থাকাকালে সুয়েজ খাল অপারেশন, ১৯৭৩ সালের আরব-ইসরায়েল যুদ্ধ সহ বেশকিছু সম্মুখ যুদ্ধে অংশ নেয়ারও অভিজ্ঞতা রয়েছে তার। মূলত জন্মলগ্ন থেকে আরব-ইসরায়েল সমস্যা, দেশের জনগণের চাহিদা ও মনোভাব খুব ভালোভাবে অবলোকন করতে পেরেছিলেন তিনি। কোথায় কী ধরণের কৌশলে নিজের জায়গা শক্ত করতে পারবেন, সেটা বিশ্লেষণেও দক্ষতার পরিচয় দিয়ে প্রায় দুই যুগ সময় রাজনৈতিক অঙ্গনে আধিপত্য বিস্তার করতে সমর্থ হয়েছেন তিনি।
১৯৮৪ সালে নেতানিয়াহু জাতিসংঘে ইসরায়েলের রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালনে নিযুক্ত হন। এর চার বছর পর ১৯৮৮ সালে দেশে ফিরে তিনি ইসরায়েলি আইনসভা 'নেসেট'-এর আসন পেতে নির্বাচনে অংশ নেন। সে সময়ে সংবাদমাধ্যমে তাঁর বাকপটুতায় মুগ্ধ হয় জনগণ। ১৯৯৩ সালে তিনি লিকুদ পার্টির নেতা হয়ে ওঠেন। এই দীর্ঘ অভিজ্ঞতা, বাকপটুতা ও দূরদৃষ্টতাকে কাজে লাগিয়ে ১৯৯৬ সালে প্রধানমন্ত্রীর আসন দখল করেন তিনি। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনের ঠিক আগের বছর ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী আইজ্যাক রবিন গুপ্তহত্যার শিকার হয়েছিলেন। এ ঘটনা ইসরায়েলের পরবর্তী সম্ভাব্য প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নেতানিয়াহুকে সামনে নিয়ে আসে। ১৯৯৯ সালের নির্বাচনে হেরে গেলেও ২০০২ সালে পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন তিনি।
ইসরায়েলের রাজনীতিতে পপুলিজম বা জনতুষ্টবাদের উপর ভর করে নেতানিয়াহু যে এক অপরিহার্যতা তৈরি করেছেন সেই অপরিহার্যতার জায়গা থেকেই জনগণ তাকে ২০০৯ সালে আবারও প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নির্বাচিত করেছিলো এবং সেই থেকে এখন পর্যন্ত তিনি ক্ষমতায় আছেন। তবে এই এক প্রজন্মের, ১২ বছর সময়ের মধ্যে জনগণ ধীরে ধীরে নেতানিয়াহুর ঠুনকো জনতুষ্টবাদী নীতিকে ঠিকই চিনে ফেলেছে। দুর্নীতি, বেকারত্ব বৃদ্ধি, করোনাভাইরাস মোকাবিলায় অদক্ষতা, অর্থনৈতিক মন্থরতা, কঠোর হস্তে ভিন্নমত দমন এই সবকিছু মিলিয়ে জনগণ এখন প্রধানমন্ত্রীর আসনে নতুন মুখ দেখতে চায়।
নেতানিয়াহুর রাজনৈতিক মতবাদকে গভীরভাবে বিশ্লেষণ করলে সেখানে দুটি প্রধান কৌশল দেখা যায়, যার উপর ভর করেই তিনি ক্ষমতা টিকিয়ে রেখেছেন।
এক, তিনি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ক্ষমতা গ্রহণ করলেও রাষ্ট্রের অন্যান্য মন্ত্রণালয় যেমন যোগাযোগ, স্বাস্থ্য, কৃষি, এমনকি সমাজকল্যাণ ইত্যাদি মন্ত্রণালয় ও অফিসগুলোয় সরাসরি তদারকি করতেন। পরে অবশ্য ২০১৯ সালে তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ আনা হলে তিনি এসব দায়িত্ব থেকে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন।
দুই, তিনি বিচার বিভাগসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সরকারের অফিসে নিজের আনুগত্য ব্যক্তিদের নিয়োগ নিশ্চিত করে ব্যক্তিগত রাজনৈতিক ক্ষমতাকে আরও প্রশস্ত করেছেন।
অর্থ্যাৎ, জনগণের সামনে ইসরায়েলি ইহুদিবাদের অখণ্ডতা রক্ষায় নিজেকে অপরিহার্য হিসেবে উপস্থাপন করে তিনি এতকাল যাবত ক্ষমতা ধরে আছেন এবং ক্ষমতা পাকা করার কৌশল হিসেবে তলে তলে তিনি অসংখ্য অবৈধ পন্থা অবলম্বন করে নিজের ব্যক্তিগত লাভের দিকটিও ঠিকই বুঝে নিয়েছেন, যা প্রায় একযুগ পরে এসে জনগণের সামনে চোখে কিছুটা ধরা পড়লো।
বিশ্লেষকদের মতে, নেতানিয়াহু দেশের অভ্যন্তরে ভিন্নমতকে কঠোর হস্তে দমন করার সাথে সাথে গণমাধ্যমে নিজের নেতৃত্ব ও তার দলের ব্যাপারে নিয়মিত ইতিবাচক প্রোপাগ্যান্ডাও ছড়িয়ে থাকেন। এছাড়া নিজের একচেটিয়া ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য ইসরায়েলের অখন্ডতা ও নিরাপত্তার নামে প্রায়শই তিনি ষড়যন্ত্রমূলক তত্ত্বের (Conspiracy Theory) মাধ্যমে ভীতি ছড়িয়ে থাকেন, এমনটাও ধারণা করেন অনেক বিশ্লেষক।
ইসরায়েলের আইনসভার একজন সাবেক স্পিকার আব্রাহাম বার্গ বলেছিলেন, "নেতানিয়াহু, সমস্ত জায়গায় ভয়ের বিস্তার ঘটিয়ে, হঠাৎ এককোণা থেকে উদ্ভব হবেন এবং বলবেন, 'এই সমস্যার সমাধান আমার কাছে আছে'।" বোঝাই যাচ্ছে, নেতানিয়াহু সাপ হয়ে কেটে, ওঝাঁ হয়ে ঝেড়ে এতদিন নিজের ক্ষমতা ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছেন।
এরপর আবার দেশজুড়ে আরব বিদ্বেষ ছড়িয়ে ক্ষণে ক্ষণে ফিলিস্তিনে হামলা চালিয়ে কট্টর জায়নবাদীদের মনও তিনি জয় করতে ভুল করেন না। সম্প্রতি নির্বাচনের পর দল গঠন করতে ব্যর্থ হয়ে রমজান মাসে আল-আকসায় অযাচিত নিষেধাজ্ঞা দিয়ে আরবদের উপর হামলা চালায় নেতানিয়াহুর সামরিক বাহিনী। হয়ত উগ্র জাতীয়তাবাদী দলগুলোর সমর্থন আদায়ের মাধ্যমে নতুন করে সরকার গঠনের ফন্দি এঁটেছিলেন, যা এখনো পর্যন্ত সাফল্যের মুখ দেখতে সক্ষম হয়নি এবং দেখতে পারার আশাও ক্ষীণ।
রাজনীতিতে সক্রিয় হওয়া এবং ক্ষমতায় বসার পর থেকেই নেতানিয়াহু দক্ষতার সাথে তার পররাষ্ট্রনীতি সাজিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রের নিরবচ্ছিন্ন সমর্থন যেভাবে ইসরায়েল পায় তা বিশ্বের অন্য কোনো দেশকে এ পর্যন্ত পেতে দেখা যায়নি। সাম্প্রতিক সময়ে শক্তিশালী বিশ্ব নেতাদের তালিকায় নেতানিয়াহু নিজের নামও লেখাতে সক্ষম হয়েছেন। ইসরায়েলকে বিশ্ব শক্তির কাতারে ওঠানোর দৌড়ে তিনি অনেকটা সফলও হয়েছেন। তবে নেতানিয়াহু যুগের অবসান ঘটলে নতুন নেতৃত্বে ইসরায়েলের শক্তির মূল ভিত্তি যুক্তরাষ্ট্রের ইসরায়েল নীতিতে কোনো পরিবর্তন আসবে কিনা সেটাও বোধহয় খানিকটা ভেবে দেখার বিষয়। লিকুদ পার্টির ব্যর্থতায় সরকার গঠনের প্রবল সম্ভবনা রয়েছে যৌথভবে উগ্রজাতীয়তাবাদী নাফতালি বেনেট ও মধ্যপন্থী ইয়াইর লাপিদের। চার বছরের প্রধানমন্ত্রীত্বকে দুই নেতার মাঝে দুই দুই বছর করে ভাগ করে দেয়ার গুঞ্জন শোনা গেছে ইতোমধ্যেই। অর্থ্যাৎ, গত একযুগ ধরে ইসরায়েলের রাষ্ট্র ক্ষমতায় যে নিরবচ্ছিন্ন গতি ছিলো তার কিছুটা ছন্দ পতন হতে যাচ্ছে সামনে। এই ছন্দ পতনের ফলে দেশটি ইতিবাচক নাকি নেতিবাচক ফল পাবে সেটা তো সময়ই বলে দিবে।
তবে নেতানিয়াহুর ক্ষমতা ধরে রাখার এই সংকট প্রমাণ করে দিলো যে, শোভিনিজম, পপুলিজম, প্রোপাগ্যান্ডা এবং আইওয়াশ বা জনগণের চোখে ধুলো দিয়ে ক্ষমতায় কিছু সময় বেশি থাকা গেলেও তা চিরস্থায়ী করা যায়না। এইসব ঠুনকো নীতির উপর ভর করে পাওয়া ক্ষমতা যখন হারায় তখন তা প্রচন্ড রকম অসম্মানজনকভাবে এবং ঘৃণাভরেই হারায়; ইতিহাসে এমন ক্ষমতাচ্যুতির সবচেয়ে বড় উদাহারণ জার্মানীর এডলফ হিটলার। তবে নেতানিয়াহুর ভাগ্যে কী আছে তা জানার জন্য অপেক্ষা করতে হবে আর মাত্র কয়েক ঘণ্টা।
- লেখক: সাবেক শিক্ষার্থী, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
- ইমেইল: [email protected]