কালজয়ী আঞ্চলিক গানের স্রষ্টা গফুর হালী
‘সোনাবন্ধু তুই আমারে করলিরে দিওয়ানা’, ‘দিলে বড় জ্বালারে পাঞ্জাবিওয়ালা’, ‘মনের বাগানে ফুটিল ফুলরে’, ‘বাইন দুয়ার দি ন আইস্য তুই নিশির কালে’, ‘রিকশা চালাও রসিক বন্ধুরে’, ‘ও শাম রেঙ্গুম নঅ যাইওরে’, ‘ঢোল বাজের আর মাইক বাজের’, ‘ন মাতাই ন বুলাই গেলিরে বন্ধুয়া’সহ অসংখ্য গান। আবদুল গফুর হালী বাংলা লোকসঙ্গীতের প্রবাদপুরুষ। গফুর হালী চাটগাঁইয়া (চট্টগ্রামের) গানের প্রধান দুই ধারা আঞ্চলিক ও মাইজভাণ্ডারী গানে নবযুগের স্রষ্টা, আঞ্চলিক নাটকের পথিকৃৎ রচয়িতা এবং ‘মোহছেন আউলিয়ার গানের’ প্রবর্তক।
৮০ বছরের বেশি সময় সুর-সঙ্গীতে এক আড়ম্বরপূর্ণ কিন্তু ব্যক্তি জীবনে সাদাসিধে জীবন কাটিয়ে ২০১৬ সালের ২১ ডিসেম্বর তিনি চলে যান অচিনপুরে। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি নিয়মিত লিখেছেন, সুর তুলেছেন এবং গেয়েছেন।
১৯৫৫-৫৬ সাল থেকে ২০১৬, দীর্ঘ ৬০ বছরের সাধনায় আবদুল গফুর হালী প্রায় আড়াই হাজার গান লিখেছেন, এর মধ্যে মাইজভাণ্ডারী, মরমী ও পীর আউলিয়ার গানের সংখ্যা প্রায় দেড় সহস্রাধিক। আর চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গানের সংখ্যা সহস্রাধিক।
জীবদ্দশায় আবদুল গফুর হালী স্বীকৃতি না পেলেও তার গান নিয়ে গবেষণা হয়েছে আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে। ২০০৪ সালে জার্মানির হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. হান্স হার্দার আবদুল গফুর হালীর জীবন ও কর্ম নিয়ে ‘ডার ফেরুখটে স্প্রিখট’ (পাগলা গফুর বলে) নামে একটি গবেষণাগ্রন্থ প্রকাশ করেছেন। সেই গ্রন্থে গফুর হালীর ৭৬টি মাইজভাণ্ডারী ও মরমী গান জার্মান ভাষায় অনূদিত হয়েছে।
ড. হান্স হার্দার আবুল গফুর হালীর এসব গানকে ‘পূর্ব বাংলার মরমী গান’ বলে সংজ্ঞায়িত করেছেন। আবদুল গফুর হালী সম্পর্কে ড. হান্স লেখেন, ‘আবদুল গফুর হালীর সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চ ডিগ্রি বা উপাধি না থাকলেও নিজের চেষ্টায় তিনি অসাধারণ জ্ঞানের অধিকারী হতে সক্ষম হয়েছেন। তিনি নিজেকে শুধু বাংলা সাহিত্যের দিকে সরাসরি ধাবিত করেননি। তার সাহিত্য ও দর্শন সাধনাকে চট্টগ্রামের একটি ধর্মীয় উৎসবকে কেন্দ্র করে গড়ে তোলেন আর তা সেই উৎসবে ক্রমাগত যাতায়াতের মাধ্যমে। প্রায় প্রতিদিনই তিনি মাইজভাণ্ডারী গান রচনা করেন। ভালোবাসার এক অলৌকিক শিল্প তাঁকে টালমাটাল করে তোলে। ঐশ্বরিক এক শক্তি তার নিজস্ব দর্শনকে পরিচালিত করে থাকে।’
১৯২৮ সালের ৬ আগস্ট চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলার রশিদাবাদে তার জন্ম। বাবা আবদুস সোবহান, মা গুলতাজ খাতুন। রশিদাবাদ আরেক সাধকশিল্পী আস্কর আলী পণ্ডিতের গ্রাম। স্থানীয় রশিদাবাদ প্রাথমিক বিদ্যালয় ও জোয়ারা বিশ্বম্বর চৌধুরী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে তিনি লেখাপড়া করেছিলেন। তবে ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা অর্জনের পর ইস্তফা দেন। কোনো বিদ্যায়তনে লেখাপড়া আর সংগীতের হাতেখড়ি নেই তার। তার নাম আবদুল গফুর, ‘হালী’ তার মুর্শিদের দেওয়া উপাধি। তিনি বলতেন, ‘যারা গান লেখেন, যারা কবিতা লেখেন, তাদের কোনো কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় নেই। এটা ভাবের জিনিস।’ তার মতে, ভাব আসে প্রকৃতি থেকে। প্রকৃতিই তার গুরু। এক স্মৃতিচারণায় তিনি জানিয়েছিলেন, ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষের কারণে লেখাপড়া করা হয়নি তার।
তার গানে চট্টলার জল-হাওয়ায়, মাঝির সাম্পান বাওয়ায় কিংবা কর্ণফুলী-শঙ্খের স্রোতধারায়। এই বাংলার আনাচে-কানাচে কান পাতলেই শোনা যায় আবদুল গফুর হালীর গান, আঞ্চলিক গানের রাণী শেফালী ঘোষের কণ্ঠে যে গান পেয়েছে অমরত্ব-‘ও শাম রেঙ্গুম ন যাইওরে/হনে হাইব রেঙ্গুমর হামাই...।’ ‘সোনাবন্ধু তুই আমারে করলিরে দিওয়ানা/মনে তো মানে না দিলে তো বোঝে না’ গানের সুরে গ্রামের মেঠোপথে মধু ছড়ায় রাখালিয়া। নাগরিক মনকে উদাস করে গফুর হালীর সেই গান, ‘মনের বাগানে ফুটিল ফুলরে/রসিক ভ্রমর আইল না/ফুলের মধু খাইল না,’ কিংবা ‘রসিক তেলকাজলা ওই লাল কোর্তাওয়ালা/দিলে বড় জ্বালারে পাঞ্জাবিওয়ালা’।
আবদুল গফুর হালী বলতেন, তিনি গাইতে গাইতে গায়েন, তার যা কিছু সৃষ্টি-গান, তা সবই মাইজভান্ডারের দান। সেই মাইজভাণ্ডারী ও মরমী গানে আবদুল গফুর হালী গড়েছেন ‘অলৌকিক ভালোবাসার এক অপরূপ শিল্প’। কল্যাণী ঘোষের গাওয়া গফুর হালীর সেই মাইজভান্ডারী গান ‘দেখে যারে মাইজভাণ্ডারে হইতেছে নুরের খেলা’ কিংবা চাটগাঁইয়া সংগীতের নবতর ধারা যা একান্তই আবদুল গফুর হালীরই সৃষ্টি সেই মোহছেন আউলিয়ার গান ‘চলরে জিয়ারতে আউলিয়া দরবার/মোহছেন আউলিয়া বাবার বটতলী মাজার’-শিমুল শীলের কণ্ঠে আলোড়ন তুলে সারা বাংলা, সারা বিশ্বে।
আবদুল গফুর হালীর প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা ৫টি। ১৯৬৯ সালে প্রকাশিত হয় তার প্রথম গীতিকাব্য ‘তত্ত্ববিধি’। ১৯৮৯ সালে প্রকাশিত হয় ‘জ্ঞানজ্যোতি’। এরপর পিএইচপি ফ্যামিলির পৃষ্ঠপোষকতা ও সুফী মিজান ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে ২০১২ সালে মাইজভান্ডারী গান নিয়ে নাসির উদ্দিন হায়দারের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় গীতিকাব্য ‘সুরের বন্ধন’। ২০১৪ সালে আঞ্চলিক গান নিয়ে মোহাম্মদ আলী হোসেনের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় ‘শিকড়’। দুটি বইয়ে স্বরলিপিসহ ২০০ গান স্থান পেয়েছে।’ এরপর ২০১৫ সালে নাসির উদ্দিন হায়দারের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়েছে ‘আবদুল গফুর হালীর চাটগাঁইয়া নাটকসমগ্র’।
চট্টগ্রামের লোকসঙ্গীত গবেষক নাসির উদ্দিন হায়দার। তিনি বলেন, ‘কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছাড়াই সঙ্গীত সাধনার মাধ্যমে তিনি অসামান্য জ্ঞানের অধিকারী হয়েছেন। চাটগাঁইয়া গানের নবযুগের স্রষ্টা। টানা ৬০ বছর সংগীত সাধনার মাধ্যমে তার সৃষ্ট গান দেশ ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সমাদৃত হয়েছে। এ কারণে আন্তর্জাতিক পর্যায়ের গবেষকরা তার কাজ নিয়ে গবেষণা করেছেন ও বই বের করেছেন। কিন্তু দেশে এ সঙ্গীত প্রতিভা ছিল অবহেলিত। জাতীয় পর্যায়ে মৃত্যুর পরও তার কোনো মূল্যায়ন হয়নি। আমরা মনে করে তিনি একুশে পদক পাওয়ার মতো সঙ্গীতজ্ঞ। তাকে একুশে পদক দেওয়া হোক।’
গফুর হালি রিচার্স সেন্টার এবং সুফি মিজান ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে কালজয়ী এ শিল্পীর স্মৃতি রক্ষার জন্য নেওয়া হচ্ছে বিভিন্ন উদ্যোগ। এর অংশ হিসেবে তার গ্রামের বাড়িতে তার দেওয়া জায়গায় প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো দেওয়া হবে রিসার্চ সেন্টারের। গড়ে তোলা হবে একটি জাদুঘর। প্রণয়ন করা হয়েছে সেন্টারের নকশাও। এছাড়াও তার লেখা আরও সহস্রাধিক গানের পাণ্ডুলিপি সংগ্রহ করে বই আকারে বের করার পরিকল্পনা করেছে এ রিসার্চ সেন্টার। পাশাপাশি তার লেখা নাটকও বই আকারে বের করার পরিকল্পনা রয়েছে।