পিল খেলেই সারবে কোভিড! বিশ্ববাসীকে আশার আলো দেখাচ্ছে ফাইজারের নতুন গবেষণা
কবে মহামারির অবসান হবে, সেই অপেক্ষায় আছেন বিশ্ববাসী। প্রাণঘাতী কোভিড-১৯ মোকাবিলার আলোচনায় প্রাধান্য পাচ্ছে টিকার প্রসঙ্গ। কিন্তু, মার্কিন ফার্মা জায়ান্ট ফাইজার ইঙ্ক এমন একটি পিল উদ্ভাবনের চেষ্টা চালাচ্ছে যার চূড়ান্ত সফলতা হয়তো পরিস্থিতিতে নাটকীয় উন্নতি যোগ করবে।
বৈশ্বিক তথ্য-পরিসংখ্যান ওয়েবসাইট ওয়ার্ল্ডোমিটার সূত্রে জানা যায়, আজ রোববার (৬ জুন) নাগাদ ৩৭ লাখের বেশি মানুষের প্রাণ কেড়েছে কোভিড। এমন সঙ্কেটের দিনে তাই মামুলি পিলের কল্যাণে রোগমুক্তির সংবাদটি কেউ সহজে বিশ্বাস করতে চাইবেন না।
তারপরও, পিল নিয়ে গবেষণার সফলতা এপর্যন্ত প্রাথমিক পর্যায়ের হলেও, এটি সম্ভাবনায় এক পথ। আর সেজন্যেই বিজ্ঞানীদের উৎসাহে কমতি নেই।
কোভিড-১৯ সংক্রমণের প্রদাহের কারণে বা রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার প্রতিক্রিয়ার ফলে তৈরি হওয়া শারীরিক উপসর্গগুলো চিকিৎসায় এখন বিভিন্ন রকম অ্যান্টি-ভাইরাল এজেন্ট ব্যবহৃত হচ্ছে। কিন্তু, ফাইজারের পিলটি সরাসরি সার্স কোভ-২ ভাইরাসের বিরুদ্ধে কাজ করবে, অন্তত এমনটাই লক্ষ্য মার্কিন ফার্মাসিউটিক্যাল জায়ান্টটির বিজ্ঞানীদের।
গবেষণা সফলভাবে শেষ হলে চিকিৎসা বিজ্ঞানেও যোগ হবে নতুন দিগন্ত।
কোভিড চিকিৎসায় এপর্যন্ত অন্যান্য ওষুধের কার্যকারিতা:
সংক্রমণের পর রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার অতিরিক্ত প্রতিক্রিয়া রুখতে কিছু ওষুধের প্রয়োগ এপর্যন্ত সবচেয়ে সফল হয়েছে। যেমন; রোগের প্রাথমিক পর্যায়ে 'কর্টিকস্টেরয়েড বুডেসোনাইড' নিঃশ্বাসের সাথে গ্রহণ করলে মারাত্মক অসুস্থতা অনেকটাই হ্রাস পায়।
আবার, হাসপাতালে গুরুতর অসুস্থতা নিয়ে ভর্তি রোগী যাদের অক্সিজেন সরবরাহের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে, তাদেরকে সেবনযোগ্য 'কর্টিকস্টেরয়েড ডেক্সামেথাসোন' মুখের মাধ্যমে দেওয়া হলে মৃত্যুর ঘটনা কমতে দেখা গেছে।
আর সবচেয়ে গুরুতর আক্রান্ত বা আইসিইউ'তে থাকা মরণাপন্ন রোগীদের শিরায় প্রদাহরোধী 'টোকলিজুমাব' দেওয়া হলেও তাদের বেঁচে যাওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে।
তবে ওষুধগুলি সংক্রমণের পর তৈরি হওয়া সমস্যা দূর করতে ব্যবহার হয়, সরাসরি সার্স কোভ-২ ভাইরাসকে তারা আক্রমণ করে না। ভাইরাসকে সরাসরি আক্রমণ করাটাই সবচেয়ে কষ্টসাধ্য বলে প্রমাণিত হয়েছে।
তাহলে ফাইজারের পিল কীভাবে সার্স কোভ-২'কে টার্গেট করবে?
বংশবিস্তারের জন্য পোষক কোষের মধ্যে প্রবেশ করতে হয় সার্স কোভ-২ ভাইরাসকে, আর এজন্য কোষের সঙ্গে যুক্ত হতে নিজ দেহের বহিরাবরণে থাকা স্পাইক প্রোটিন ব্যবহার করে ক্ষতিকর অনুজীবটি। এসময় সে কোষের নিজস্ব প্রোটিনকে কাজে লাগিয়ে অনুপ্রবেশ করে।
কোষের অভ্যন্তরে প্রবেশের পর নিজ দেহের কাঁটাসদৃশ বহিরাবরণ সরিয়ে ফেলে সংক্রামক আরএনএ (রাইবোনিউক্লিক এসিড- এক ধরনের জেনেটিক উপাদান) অবমুক্ত করে। এই আরএনএ'কে মাপদন্ড ধরে নিয়েই ভাইরাস কোষের ভেতরে নিজের কপি তৈরি করা শুরু করে, যা পরবর্তীতে অন্যান্য সুস্থ কোষকে আক্রান্ত করে। জীবন চক্রের এই ধাপে ভাইরাসের প্রতিরোধ অনেকটা দুর্বল অবস্থায় থাকে, এবং তখন সেখানে বাধা দিলে তার বংশবিস্তার রোধ করা সম্ভব হয়।
সার্স কোভ-২ ভাইরাস বহন করে থ্রি-সি প্রোটিয়েজ নামক এক প্রকার এনজাইম। এনজাইমটি ভাইরাসের পুনঃউৎপাদন চক্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এটি আবার পূর্বসূরি সার্স কোভ-১ –এর প্রোটিয়েজের অনুরূপ। ইতঃপূর্বে, করোনাগোত্রের আরেক ভাইরাস মিডল ইস্ট র্যাসপেরটরি সিনড্রোম বা মার্স ভাইরাসেও একইরকম এনজাইম ছিল।
কোনো ওষুধ যদি এই এনজাইমকে ফলপ্রসূভাবে টার্গেট করতে পারে, তাহলে ইতোমধ্যেই বিজ্ঞানের পরিচিত অনেকগুলো করোনাভাইরাসের পুনঃউৎপাদন বা বংশবিস্তার ঠেকানো সম্ভব হবে। এমনকি আগামীতে দেখা দেওয়া একই গোত্রের নতুন ভাইরাসকেও হয়তো প্রতিহত করা যাবে।
অর্থাৎ, বৈজ্ঞানিক সম্ভাবনার নতুন এক দিগন্ত দেখা যাচ্ছে।
এর আগে এইচআইভি ও হেপাটাইটিস সি'র জীবাণুর সংক্রামক প্রদাহের বিরুদ্ধে প্রোটিয়েজ ইনহিবিটরের ব্যবহার সফলতা লাভ করে। এখানে ইনহিবিটর হচ্ছে এনজাইমের স্বাভাবিক বিস্তারে বাধা দানকারী কৃত্রিম ওষুধ।
মহামারির প্রথম দিকে এইচআইভি'র ইনহিবিটর জাতীয় কিছু ওষুধ কোভিড-১৯- এর বিরুদ্ধে সম্ভাব্য চিকিৎসা হিসেবে সুপারিশ করা হয়। দুটি ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে এইচআইভির ইনহিবিটর ওষুধ লোপিনাভির- রিটনোভির ফলপ্রসূ বলে প্রমাণিত হলেও সার্স কোভ-২ সফলভাবে প্রতিরোধে সেগুলো খুব একটা কাজে দেয়নি, বরং অনাকাঙ্ক্ষিত পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার ঝুঁকিই ছিল বেশি।
তারপর, ইবোলার চিকিৎসায় ব্যবহৃত অ্যান্টি-ভাইরাল ওষুধ রেমডেসেভির ব্যবহারের পরামর্শ দেন বিজ্ঞানীরা। রেমডেসেভির ভাইরাসের পুনঃউৎপাদন চক্র কিছুটা দুর্বল করতে পারে বলে প্রমাণিত হয়েছে।
তবে এসব ওষুধের কোনটাই সার্স কোভ-২ মোকাবিলায় তৈরি করা হয়নি। আর সেজন্যেই অতীতের সীমিত সফলতা থেকে শিক্ষা নিয়ে ২০২০ সালে সার্স কোভ-২ ভাইরাসের বংশবিস্তারে বাধা দেবে এমন ওষুধ তৈরির চেষ্টা শুরু করেন ফাইজারের বিজ্ঞানীরা।
বিজ্ঞানীরা ওই সময় পিএফ- ০০৮৩৫২৩১ নামের একটি ক্ষুদ্র মলিকিউল বা ক্ষুদ্র রাসায়নিক কণা আবিষ্কার করেন যা সার্স কোভ-২-র পূর্বালোচিত থ্রিসি প্রো-প্রোটিয়েজকে বাধা দেয়। এটি সার্স কোভ-১ ভাইরাসের বিরুদ্ধে তৈরি করা হলেও, দুই ভাইরাসের এনজাইমে মিল থাকায় কার্যকারিতায় কোনো পার্থক্য হবে না।
পিএফ- ০০৮৩৫২৩১'কে এককভাবে বা রেমডেসিভিরের সঙ্গে যৌথভাবে প্রয়োগ করলে সার্স কোভ-২ সহ বিভিন্ন করোনাভাইরাসের সেলের পুনঃউৎপাদন ব্যাহত হয় বলে ল্যাবরেটরিতে করা পরীক্ষায় দেখা গেছে। মানুষ ছাড়া অন্যান্য প্রাণীদেহে করা পরীক্ষাতেও ভাইরাস সংক্রমণ রুখতে সাহায্য করেছে ওষুধটি। উপরি লাভ হিসেবে এখনও কোনো মারাত্মক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করেননি বিজ্ঞানীরা।
আর সেখানেই জেগেছে আশার আলো। কারণ, পিল জাতীয় ওষুধ বিপুল পরিমাণে সহজে উৎপাদন করা যায়, যা টিকাবঞ্চিত দেশগুলোতে সহজে সরবরাহ করা যাবে। সার্বিকভাবে তাতে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে অভাবনীয় উন্নতির আশা দেখছে বিজ্ঞান।
- সূত্র: স্ক্রল ডটইন