কল্যাণ রাষ্ট্রব্যবস্থা কি কোনো দেশকে সম্পদশালী করে তোলে?
বর্তমান বিশ্বের গুরুতর ও অতি জরুরি হয়ে ওঠা কিছু নীতিমালা সংক্রান্ত চ্যালেঞ্জ নিয়ে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের সিরিজ সাক্ষাৎকার নিচ্ছেন ব্লুমবার্গের মতামত কলাম লেখকেরা। তারই একটি পর্বে এবার জাস্টিন ফক্স কল্যাণ রাষ্ট্রের সুবিধা-অসুবিধা নিয়ে বিশেষজ্ঞ পিটার লিনডার্টের সাক্ষাৎকারটি নেন। মূল সাক্ষাৎকারটির আকার সার-সংক্ষেপ অনুসারে সাজাতে ও স্বচ্ছতা বজায় রাখতে পরিমার্জন করা হয়েছে।
জাস্টিন ফক্স: করোনাভাইরাস মহামারির কারণে বিশ্বের অনেক দেশে সরকারি সামাজিক কল্যাণ কর্মসূচি নাটকীয় হারে স্ফীতি লাভ করে। বিশ্বের শীর্ষ অর্থনীতি যুক্তরাষ্ট্রও তার আওতামুক্ত নয়। 'মেকিং সোশ্যাল স্পেন্ডিং ওয়ার্ক' শীর্ষক একটি নতুন বইয়ে আপনি এব্যাপারে আলোচনা করেছেন। এছাড়া, আপনার আগের কিছু পর্যবেক্ষণমূলক লেখনী ও গবেষণাতেও বলেছেন যে, কল্যাণ রাষ্ট্র মুফতে বিলি-বন্দোবস্তের আয়োজন। এই পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে আপনি আসলে কী বোঝাতে চেয়েছেন?
পিটার লিনডার্ট, ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ার অর্থনীতি বিভাগের সম্মানীয় এমিরেটস অধ্যাপক: এই ব্যবস্থা আমাদের গড় আয় কমায় না বটে, কিন্তু একইসঙ্গে সকলের জন্য আরও সমতা ও স্বচ্ছ সরকার ব্যবস্থা নিশ্চিত করে, মুফতে বিলি-বন্দোবস্ত বলতে সেই দিকটিতেই আলোকপাত করেছি। এমন রাষ্ট্রে; নাগরিকের গড় আয়ু দীর্ঘায়িত হয়, সরকারি বাজেটে বিশাল ঘাটতি থাকে না, দারিদ্রও কম থাকে।
ফক্স: তাহলে আপনার কাছে কল্যাণ রাষ্ট্রের সংজ্ঞা কী?
লিনডার্ট: যেসব রাষ্ট্র শিক্ষা বাদে জাতীয় আয়ের ২০ শতাংশের বেশি সামাজিক সুরক্ষা বেষ্টনীতে বরাদ্দ দেয়, তারাই হচ্ছে কল্যাণ রাষ্ট্র। শিক্ষাসহ হিসাব করলে আসলে কল্যাণ রাষ্ট্রের সংখ্যা অনেক বেশি হবে। কারণ, শিক্ষার প্রসার সমাজে বহু ইতিবাচক প্রভাব ফেলে।
তাই শিক্ষাসহ হিসাব করলে যুক্তরাষ্ট্রসহ অস্থায়ীভাবে অনেক দেশ এই সংজ্ঞাভুক্ত হয়ে পড়ে। সোজা কথায়, শিক্ষায় বরাদ্দ বাড়িয়ে সামাজিক কল্যাণ গতিশীল করাটা পরোক্ষভাবে বাধা অতিক্রম করারই প্রচেষ্টা। সেজন্যেই আমরা শিক্ষায় বরাদ্দকে উপেক্ষা করে প্রকৃত কল্যাণ রাষ্ট্রকে শনাক্ত করার চেষ্টা করেছি। এটি করা জরুরি ছিল, কারণ মহামারির কারণে আয়ে ধস নামায় সরকারের তরফ থেকে বিভিন্ন খাতে নাগরিকদের সহায়তা বৃদ্ধি করতে হয়েছে।
ফক্স: প্রায় সকল খাতেই কল্যাণ রাষ্ট্রকে বিপুল পরিমাণ অর্থ খরচ করতে হয় বলে ১৯৮০ ও ৯০'এর দশকে প্রকাশিত অনেক অর্থনৈতিক গবেষণা নিবন্ধে যুক্তি দেওয়া হয়। এসব গবেষকরা কী ভুল বলেছেন নাকি তারা ভিন্ন বিষয়ের ব্যাখ্যা করেছেন?
লিনডার্ট: ওই সময়ে সমাজতন্ত্রের সঙ্গে ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থার সংঘাত ছিল, তাই এসব অর্থনীতিবিদেরা অহেতুক ভয় দেখাতে ফাঁপা বুলি দিয়েছেন। তাছাড়া, 'কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং উৎপাদনশীলতার জন্য কল্যাণ রাষ্ট্র একটি অন্তরায়' বলাটা তখন ছিল হাল ফ্যাশনের অংশ। কিন্তু, এর স্বপক্ষে তাদের কাছে কোনো প্রমাণ ছিল না।
ফক্স: কিন্তু, ওই সময়ে সরকারি খরচ বৃদ্ধি এবং প্রবৃদ্ধির মধ্যে একটি নেতিবাচক সংযোগের অভিজ্ঞতালদ্ধ কিছু প্রমাণ কী মেলেনি?
লিনডার্ট: আসলেই এমন প্রমাণ মেলেনি। যতদূর মনে পড়ে এব্যাপারে অর্থনীতিবিদ বব ব্যারো একটি ইকোনোমেট্রিক বা অর্থনৈতিক পরিসংখ্যানমূলক তথ্য বিশ্লেষণের গবেষণা করেন। সেখানে তিনি, সরকারি ভোগ বা চাহিদার কারণে একটি দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ার যোগসূত্র দেখান। কিন্তু, এখানে একটি বড় তাত্ত্বিক ভুল হলো; সরকারি ভোগ আসলে সরকারের সামাজিক কল্যাণ কর্মসূচির ব্যয় নয়।
আসলে সরকারি ভোগ তখনই বাড়ে যখন সরকার নিজেই নিজের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সুযোগ-সুবিধা, বেতন-ভাতা ইত্যাদি বৃদ্ধি করে। এক্ষেত্রে, কঙ্গোর সাবেক সামরিক শাসক মোবুতু সেসে সেকো এবং ফিলিপাইনের ফার্ডিন্যান্ড মার্কোসের সরকারের উদাহরণ দেওয়া যায়। এসব দেশের দিকে তাকিয়ে সরকারি খরচকে প্রবৃদ্ধির অন্তরায় বলেই মনে হওয়াটা স্বাভাবিক। আসলে মূল কথাটা হচ্ছে, শাসন ব্যবস্থার পার্থক্য ও জনগণের ক্ষমতায়ন। সরকারি ব্যয় অনেকগুণ বেশি হওয়ার পরও তাই এই ব্যাখ্যাটি ডেনমার্ক বা সুইডেনের ক্ষেত্রে খাটে না।
ফক্স: তারপরও, সামাজিক কল্যাণ অর্থনীতির জন্য অন্তরায় বলে সংরক্ষণবাদী অর্থনীতিবিদদের যুক্তিকে বেশিরভাগ সরকার খুবই গুরুত্ব সহকারে গ্রহণ করে বলে আপনি নিজের সম্প্রতি প্রকাশিত বইয়ে লিখেছেন, আপনার আগের কাজগুলোতেও এমন মন্তব্য রয়েছে।
লিনডার্ট: কল্যাণ রাষ্ট্র মানেই কাউকে কাজ করার জন্য নিরুৎসাহিত করে সারা জীবন বসিয়ে বসিয়ে লালন-পালন করা নয়। যাদের এমন ধারণা রয়েছে, তারা ভুলে যান বাস্তব দুনিয়ায় সরকারি ব্যবস্থা এভাবে কোনোদিন কাজ করে না। সরকারসমূহ কর্ম প্রণোদনার সমস্যা সম্পর্কে জানে, তাই তারা নিছক দান-খয়রাতের পরিবর্তে স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও অন্যান্য গঠনমূলক খাতে বিনিয়োগ করে থাকে।
ফক্স: দিনশেষে এসব পদক্ষেপ কী ইতিবাচক প্রভাব ফেলে?
লিনডার্ট: পরিসংখ্যানের তথ্যে কাজের ওপর সামাজিক ব্যয়ের নেতিবাচক প্রভাব নিয়ে যতো বেশি তথ্য পাবেন, তার চেয়ে অনেকগুণ বেশি বাস্তব সুফল পাওয়া যায়।
ফক্স: যুক্তরাষ্ট্রের অনেক ব্যবসায়ী নেতা ও নির্বাচিত কর্মকর্তা বলেছেন, বেকারত্ব বীমার সম্পূরক প্রভাবে জনগণ কর্মস্পৃহা হারাচ্ছে। আপনি হয়তো একটু ধৈর্য ধরে এনিয়ে আগামী দিনের গবেষণাগুলোর ফলাফল দেখতে চাইবেন। কিন্তু, একইসঙ্গে বেকার ভাতার কল্যাণে সত্যিই যদি কিছু নেতিবাচক প্রভাব সৃষ্টির প্রমাণ মেলে তাহলে আপনি মোটেই বিস্মিত হবেন না। সত্যিই কী তাই?
লিনডার্ট: আপনি সঠিক কথাটিই বলেছেন। বেকারত্বের ক্ষতিপূরণমূলক উদার ভাতা আসলে কী প্রভাব ফেলেছে তা নিয়ে পরিসংখ্যানমূলক গবেষণার তথ্য জানার অপেক্ষাই করছি। কিন্তু, এই মুহূর্তে মার্কিনীদের কাজে উৎসাহী না হওয়ার পেছনে সম্ভবত অন্যান্য কারণও রয়েছে। কাজ পেলে নিজ সন্তানের খরচের ভার নিজেকেই নিতে হবে, রাষ্ট্র তখন আগের সহায়তা দেবে না। অথচ, বিদ্যালয় ব্যবস্থা এখনও মহামারির ধাক্কা কাটিয়ে উঠতে পারেনি। সেখানে সন্তানকে পাঠানোর সাহসও অনেকেই পাচ্ছেন না। আরও বহু মানুষ কাজে যোগ দিয়ে কোভিড আক্রান্ত হওয়ার ভয়ও করছেন, আর সেটা অমুলক নয়।
ফক্স: রাজস্ব আদায়ের দিক থেকে দেখলে বৃহত্তর কল্যাণ রাষ্ট্র কাঠামো থাকা অনেক দেশে অগ্রগামী রাজস্ব ব্যবস্থার অভাব লক্ষ্য করা যায়, এসব দেশে রাজস্বটা অনেকাংশে মূল্য সংযোজন কর আদায়ের ওপর নির্ভরশীল।
লিনডার্ট: সামাজিক কল্যাণে বেশি ব্যয় করা রাষ্ট্রের সঙ্গে কম ব্যয় করা ধনী রাষ্ট্র যেমন যুক্তরাষ্ট্র ও জাপানের রাজস্ব নীতিতে তেমন কোনো অগ্রগামী পার্থক্য নেই। কিন্তু, কল্যাণ রাষ্ট্র স্বাস্থ্য বিমাসহ নানা খাতে সমতা সৃষ্টির মাধ্যমে নাগরিকের নিজস্ব খরচ কমায়, মূলত একারণেই শুধুমাত্র সরাসরি রাজস্ব ব্যবস্থা নির্ভর করার পরিবর্তে ভ্যাটের ওপর গুরুত্ব বাড়ে।
ফক্স: কল্যাণ রাষ্ট্রের আলোচনায় আপনি অনেকবার এই ব্যবস্থাকে 'বিবর্তনবাদের সফলতা' (ডারউইনিয়ান সাকসেস) বলে অবিহিত করেছে। আপনি বলেছেন, বর্তমান দুনিয়ার দিকে নজর দিলে দেখা যাবে শুধুমাত্র কল্যাণ রাষ্ট্রগুলো টিকে গেছে এবং সফল হয়েছে।
লিনডার্ট: হ্যাঁ, কল্যাণ রাষ্ট্র আসলেই টিকে গেছে। তারপরও সাংবাদিকরা যখন কল্যাণ রাষ্ট্রের সঙ্কট নিয়ে নিঃসঙ্কোচে আলোচনা করেন তখন শুধু বিস্মিত হই। প্রকৃত অর্থেই আজ কল্যাণ রাষ্ট্রের ধারণা বিজয়ী, এমনকি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় পুঁজিবাদী ও বেসরকারিকরণের প্রবক্তা যুক্তরাষ্ট্রেও এ ধারণা ও চর্চা আজ জনপ্রিয়। ২০২০ সালের মার্চে সংরক্ষণপন্থী রিপাবলিকান আইনপ্রণেতারা পার্লামেন্টের উভয় কক্ষেই বেকার ভাতা, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ে সহায়তা এবং সামাজিক কল্যাণের অন্যান্য খাতে বিপুল খরচ বৃদ্ধির পক্ষে নিরঙ্কুশভাবে ভোট দেন। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প নিজেই চূড়ান্ত বিলটিতে স্বাক্ষর করে তাকে আইনে রূপদান করেন। তারপর থেকেই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছে পুঁজিবাজার। অর্থনীতির সঙ্কোচন তারপর বন্ধ হয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়।
প্রশ্ন করতে পারেন, এটা স্থায়ী প্রভাব কিনা? আসলে এই উন্নতির কিছুটা স্থায়ী হবে, কিছুটা হবে না- এটাই বাস্তবতা। দুই দুটি বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তীকালের অর্থনৈতিক উত্তরণের দিকে তাকালে দেখবেন, ওই সময়ে দেওয়া সামাজিক প্রণোদনা ছাড়া পুনরুত্থান অর্জন করা সম্ভব হতো না। আর পূর্ণ উত্তরণের পরও প্রবৃদ্ধির নতুন গতির কিছুটা অংশ থেকেই যায়। অর্থাৎ, সামাজিক কল্যাণে খরচ রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক বিকাশের জন্যও অতি-গুরুত্বপূর্ণ।
- লেখক: ব্লুমবার্গে ব্যবসা খাত নিয়ে মতামত কলাম লেখেন জাস্টিন ফক্স। হাভার্ড বিজনেস রিভ্যিউ- এর সম্পাদনা পরিচালকসহ ইতঃপূর্বে তিনি টাইম, ফরচুন ও আমেরিকান ব্যাংকার ম্যাগাজিনে লিখতেন। তার লেখা একটি সমাদৃত বই 'দ্য মিথ অব দ্য র্যাশনাল মার্কেট।'
- সূত্র: ব্লুমবার্গ থেকে অনূদিত