ব্যক্তিগত উদ্যোগে ৪ কোটি টাকা ব্যয়ে নদীভাঙন রোধে কাজ করছেন হাতিয়াবাসী
- নদীর ভাঙন রোধে প্রাথমিক পর্যায়ে ৭শ মিটার এলাকায় জিও ব্যাগ দেওয়া হচ্ছে
- প্রতিটি জিও ব্যাগের মূল্য ৫০০ টাকা
- ব্যাংক একাউন্টের মাধ্যমে জনসাধারণের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হচ্ছে টাকা
- ২৪ হাজার জিও ব্যাগ নিয়ে কাজ শুরু করা হয়েছে
- প্রতিদিন কাজ করছেন ৫০ জন শ্রমিক
- ব্যয় আরও বাড়তে পারে, বলছে পানি উন্নয়ন বোর্ড
নোয়াখালীর মূল ভূখন্ড থেকে বিচ্ছিন্ন একটি দ্বীপ উপজেলা হাতিয়া। মেঘনার বুকে থাকা দ্বীপটির বর্তমান জনসংখ্যা প্রায় ৭ লাখ। মেঘনার ভাঙাগড়া নিয়ে তাদের জীবন। স্বাধীনতার পর থেকে মেঘনা নদীর অব্যাহত ভাঙনে বিলীন হয়েছে উপজেলার হাজার হাজার বাড়ীঘর, শত শত বাজার, বিদ্যালয়, মাদ্রাসা, মসজিদসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। এছাড়াও হাতিয়ার তিনটি ইউনিয়ন নদীগর্ভে সম্পূর্ণ বিলীন হয়ে গেছে।
সম্প্রতি হাতিয়ার উত্তর পাশে সুখচর, নলচিরা ও চানন্দি ইউনিয়নের বড় একটি অংশ নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। নদীভাঙন এই দ্বীপের সবচেয় বড় সমস্যা। তাই নদীভাঙন রোধ করতে এবার নিজেরাই নেমে পড়েছেন হাতিয়াবাসী। সাধারণ লোকজনের সহযোগিতায় প্রাথমিকভাবে ৭শ মিটার নদীতীরের ভাঙন রোধে কাজ শুরু করা হয়েছে। আর তাতে ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ৪ কোটি টাকা, তবে সরকারি হিসেবে এ কাজে ব্যয় হতে পারে প্রায় ৭ কোটি টাকা। সাধারণ লোকজনের পাশাপাশি এই কাজে জনপ্রতিনিধিরাও এগিয়ে এসেছেন, সহযোগিতা করছে পানি উন্নয়ন বোর্ড।
জানা গেছে, গত বছর পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃক হাতিয়ার নদীভাঙন প্রবণ এলাকায় ২৯৭ মিটার জায়গায় পরীক্ষামূলক কিছু জিও টেক্সটাইলের ব্যাগ (জিও ব্যাগ) ফেলা হয়। তাতে দেখা যায়, এক বছরে ওই জায়গায় নদীর ভাঙন অনেকটা রোধ হয়েছে।
সম্প্রতি মেঘনা নদীর অব্যাহত ভাঙন উপজেলার সবচেয়ে বড় ব্যবসায়িক কেন্দ্র আফাজিয়া বাজারের কাছাকাছি চলে আসে। এতে আতংকিত হয়ে পড়েন স্থানীয়রা। গত বছরের জিও ব্যাগে ভাঙন রোধ হওয়া তাদের আশা দেখায় এবং এ ব্যবসাকেন্দ্রকে বাঁচিয়ে রাখতে ব্যবসায়ীরা একত্রিত হয়ে নদীতীর ভাঙন রোধে কাজ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। তাদের উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে এ কাজে সহযোগিতা করার আগ্রহ প্রকাশ করেন সাবেক সাংসদ ও হাতিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোহাম্মদ আলীসহ স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা।
উদ্যোক্তাদের তথ্যমতে, মেঘনার অব্যহত ভাঙনে যুগযুগ ধরে নিজেদের অনেক সম্পদ হারিয়েছে দ্বীপবাসী। তাই ভাঙন রোধে সম্প্রতি স্থানীয় ব্যবসায়ী, পল্লী চিকিৎসক, পরিবহন মালিক-শ্রমিক, প্রবাসী, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও রাজনৈতিক ব্যক্তিরা নিজেরা উদ্যোগ নেন। এ কাজের জন্য গঠন করা হয় ৫১ সদস্য বিশিষ্ট একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। এর নাম দেওয়া হয়েছে 'হাতিয়া নদী শাসন ও তীর সংরক্ষণ স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন'। সংগঠনটির সভাপতি করা হয়েছে উপজেলা আ.লীগের সাধারণ সম্পাদক মহিউদ্দিন আহম্মদকে। সাধারণ সম্পাদক করা হয়েছে সেচ্ছাসেবক লীগ সভাপতি মহিউদ্দিন মুহিন, সাবেক ইউপি সদস্য আজহার উদ্দিনকে করা হয়েছে অর্থ সম্পাদক। সবার সহযোগিতার অর্থ জমা নেওয়ার জন্য খোলা হয়েছে একটি ব্যাংক হিসেব।
আর্থিক আয় ব্যয়ে স্বচ্ছতা আনার জন্য সংগঠনের নামে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ফেসবুকে খোলা হয়েছে একটি পেইজ। এতে প্রতিদিন অনুদান দেওয়া লোকজনের নাম, পরিচয় ও টাকার পরিমাণ উল্লেখ করে তথ্য দেওয়া হচ্ছে এবং এ কাজে এগিয়ে আসতে সাধারণ মানুষকে অনুরোধও করা হচ্ছে।
ইতোমধ্যে বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষ তাদের ভিটেমাটি রক্ষায় এই সংগঠনের একাউন্টে টাকার অনুদান জমা দেওয়া শুরু করেছেন। গত মে মাসে এ একাউন্টে জমা হয়েছে প্রায় ৭০লাখ টাকা। প্রাথমিকভাবে দুই দফায় গাজীপুরের একটি কারখানা থেকে গত ৩০ মে ২৪ হাজার জিও ব্যাগ এনে নলচিরা ঘাটের পশ্চিম পাশে ২০০ মিটার ও পূর্ব পাশে ৫০০ মিটার ভাঙন রোধে কাজ শুরু করা হয়েছে। যা শেষ হতে প্রায় ৬ থেকে ৭ মাস লাগতে পারে। প্রতিদিন ব্যাগগুলোতে বালু ভর্তি ও ডাম্পিং এর কাজ করছেন রংপুর জেলা থেকে আসা অভিজ্ঞতা সম্পন্ন ৫০ জন শ্রমিক। তাদের সহযোগিতা করছেন স্থানীয় লোকজন। দ্বীপের লাখো মানুষের স্বপ্ন বাস্তবায়ন এখন দ্বারপ্রান্তে বলে মনে করছেন উদ্যোক্তারা।
সংগঠনের তথ্যমতে, গত ৩০ এপ্রিল স্থানীয় আফাজিয়া বাজারে বিভিন্ন পেশার প্রায় সহস্রাধিক মানুষের উপস্থিতিতে টাকা সংগ্রহের কার্যক্রম শুরু করা হয়। এরপর থেকে বিভিন্ন পেশার মানুষ তাদের আর্থিক অবস্থানুযায়ী অনুদান জমা দিতে শুরু করে। হাতিয়ায় বসবাস করা লোকজন ছাড়াও দেশের বিভিন্ন অঞ্চল ও বিদেশ থেকে অনেকে এ কাজে আর্থিক সহযোগিতা করছেন।
স্থানীয় বাসিন্দা সর্দার আলতাফ হোসেন বলেন, আর্থিক সংকট থাকায় তিনি টাকা দিয়ে সহযোগিতা না করতে পারলেও তিনি এবং তার লোকজন জিও ব্যাগে বালু ঢুকানোর কাজে স্বেচ্ছায় সহযোগিতা করছেন।
নদীভাঙন কবলিত নলচিরা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান হু্মায়ুন কবির বাবলু জানান, 'নদীভাঙন রোধ করা আমাদের প্রাণের দাবি। করোনার কারণে সরকারিভাবে না হওয়ায় আমরা নিজেরা এই উদ্যোগ নিয়েছি। আমরা আমাদের ইউনিয়নের প্রতিটি বিত্তবান পরিবারের কাছে আর্থিকভাবে সহযোগিতা চেয়েছি। অনেকে করেছেন আবার অনেকে আর্থিক অনুদান দিবেন বলে আশ্বাস দিয়েছেন। তবে সবচেয়ে বেশি সহযোগিতা করছেন প্রবাসীরা ভাইয়েরা'।
সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক মহি উদ্দিন মুহিন জানান, 'আমাদের এই প্রকল্প বাস্তবায়নে সবচেয়ে বেশী উৎসাহ পেয়েছি সাবেক সাংসদ মোহাম্মদ আলীর কাছ থেকে। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে সবচেয়ে বড় আর্থিক সহযোগীতাটি তিনি করেছেন। ইতোমধ্যে এই প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য তিনি ৪ লাখ ফুট বালু ও নগদ ২০ লাখ টাকার অনুদান দিয়েছেন। এটি আমাদের প্রকল্পের জন্য এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বড় সহযোগিতা। আমাদের প্রকল্পটি বাস্তবায়নে পানি উন্নয়ন বোর্ড নোয়াখালীও সহযোগিতা করছে'।
পানি উন্নয়ন বোর্ড নোয়াখালীর নির্বাহী প্রকৌশলী মো. নাছির উদ্দিন জানান, 'হাতিয়া নদী শাসন ও তীর সংরক্ষণ কমিটির লোকজন তাদের কাজে আমাদের সাথে যোগাযোগ করছেন। ইতোমধ্যে সরকারিভাবে তাদের কাজের জন্য ১০ হাজার জিও ব্যাগ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। তীর সংরক্ষণে কাজ শুরু করা নলচিরা ঘাটে পানির গভীরতা অনেকটা কমে গেছে। তাতে জিও ব্যাগ ফেললে তার সুফল পাওয়া যেতে পারে। পানি উন্নয়ন বোর্ড থেকে তাদের একটি ডিজাইন ঠিক করে দেওয়া হয়েছে। আমাদের একজন প্রতিনিধি এ কাজে সার্বক্ষণিক তদারকি করছেন'।
তিনি আরও জানান, মাটি ভর্তি ও ডাম্পিংসহ প্রতিটি জিও ব্যাগে খরচ পড়বে ৫০০ টাকা করে। প্রতি মিটারে খরচ পড়বে প্রায় ১ লাখ টাকা করে। সেই হিসেবে ৭০০ মিটার কাজ সম্পূর্ণ করতে তাদের খরচ পড়তে পারে প্রায় ৭ কোটি টাকা।