চট্টগ্রাম ওয়াসায় বছরে অপচয় ১৩১ কোটি লিটার পানি
তিনটি প্রকল্প ও গভীর নলকূপের মাধ্যমে দৈনিক ৩৯১ মিলিয়ন লিটার পানি উৎপাদন করে চট্টগ্রাম ওয়াসা। তবে সিস্টেম লস বাদ দিলে নগরবাসীকে মাত্র ২৮২ মিলিয়ন লিটার পানি সরবরাহ করতে পারে সংস্থাটি। এ পানি দিয়ে মাত্র ৫৭ শতাংশ নগরবাসীর চাহিদা পূরণ করা সম্ভব। যদিও নগরের চাহিদা রয়েছে ৫৫০ মিলিয়ন লিটার।
ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেমের (এমআইএস) গত জুনের রিপোর্ট অনুযায়ী চট্টগ্রাম ওয়াসার দৈনিক উৎপাদিত পানির ১০৯ মিলিয়ন লিটার অর্থাৎ ২৮ শতাংশ অপচয় হয়। যার মূল্য ২০ লাখ ৮০ হাজার ১২০ টাকা, অর্থাৎ বছরে ক্ষতি হচ্ছে ৭৫ কোটি টাকা।
এক হাজার লিটার পানি উৎপাদন করতে ওয়াসার খরচ হয় (অপচয় ও ঋণের টাকা ছাড়া) ১৯ টাকা। সেই হিসাবে দৈনিক গচ্ছা যায় ২০ লাখ ৮০ হাজার ১২০ টাকা। এক মাসে ৬ কোটি ২৪ লাখ টাকা। এভাবেই সিস্টেম লসের কারণে মাসে কোটি টাকা জলে যাচ্ছে ওয়াসার।
তবে আগামী তিন বছরের মধ্যে সিস্টেম লসের হার সিঙ্গেল ডিজিটে এসে শতভাগ পানির চাহিদা পূরণ করতে পারবে বলে দাবি করছে সেবা সংস্থাটি। ২০২১ সালের মধ্যে নগরবাসী শতভাগ পানি পাবে বলে স্বপ্ন দেখাচ্ছে তারা।
চট্টগ্রাম ওয়াসার চলতি বছরের ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেম (এমআইএস) বিশ্লেষণ করে জানা গেছে, ২০১৯ সালের জুনের এমআইএস রিপোর্টে দেখানো হয়েছে- ওয়াসার নন রেভেনিউ পানি বা সিস্টেম লস হচ্ছে ২৮ শতাংশ। আবার ২০১৮ সালের এ হার ছিল ২৫ শতাংশ। ওই মাসের হিসাব অনুযায়ী ওয়াসার পানির উৎপাদন ৩৯১ মিলিয়ন লিটার। মোট কাভারেজের হার ছিল ৫৭ শতাংশ। প্রতি ইউনিট বা এক হাজার লিটার পানি উৎপাদনের জন্য ওয়াসার খরচ হয় ১৯ টাকা করে (অপচয় ও ঋণের টাকা ছাড়া)।
অংকের হিসাবে ওয়াসার সিস্টেম লসের কারণে প্রতিদিন অপচয় হয় ১০ কোটি ৯০ লাখ লিটার পানি। টাকার অংকে তা ২০ লাখ ৮০ হাজার ১২০ টাকা। এক মাসে তা গিয়ে দাঁড়ায় ৬ কোটি ২৪ লাখ টাকায়। বছরে অপচয় ১৩০ কোটি ৮০ লিটার পানি । ফলে বছরে ৭৪ কোটি ৮৮ লাখ টাকার পানি অপচয় ঘটে।
শতভাগ পানির চাহিদা পূরণে বর্তমানে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে কর্ণফুলী পানি সরবরাহ প্রকল্প ফেজ-২। বর্তমানে ওয়াসার শেখ রাসেল পানি সরবরাহ প্রকল্প থেকে দৈনিক ৯০ মিলিয়ন লিটার, শেখ হাসিনা পানি শোধনাগার প্রকল্প থেকে ১৪৩ মিলিয়ন লিটার, মোহরা পানি সরবরাহ প্রকল্প থেকে ৯০ মিলিয়ন লিটার উৎপাদন করা হয়। এছাড়াও গ্রাউন্ড ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট এবং ৪৩টি গভীর নলকূপ থেকে ৬৮ মিলিয়ন এবং ৩৭ মিলিয়ন লিটার পানি উৎপাদন করা হয়।
কোন মাসে কতো সিস্টেম লস
চট্টগ্রাম ওয়াসায় প্রতি মাসে নন রেভিনিউ ওয়াটার বা সিস্টেম লসের পরিমাণ প্রতিমাসেই বাড়ছে। ২০১৮ সালের জুন ও জুলাই মাসে এ সিস্টেম লসের পরিমাণ ছিল ২২ শতাংশ, আগস্টে ১৮ শতাংশ, সেপ্টেম্বরে ১৫ শতাংশ, অক্টোবরে ১৫ শতাংশ, নভেম্বরে ২৪ শতাংশ, ডিসেম্বরে ৩০ শতাংশ, চলতি বছরের জানুয়ারিতে এ হার ৩০ শতাংশ, ফেব্রুয়ারিতে ২৬ শতাংশ, মার্চে ২৮ শতাংশ, এপ্রিলে ৩০ শতাংশ, মে মাসে ২৮ শতাংশ এবং সর্বশেষ জুন মাসে এ হার ২৮ শতাংশ। এক বছরে গড়ে সিস্টেম লসের পরিমাণ ২৪ দশমিক ৪ শতাংশ।
যে কারণে পানির অপচয়
চট্টগ্রাম ওয়াসার রয়েছে ৬১০ কিলোমিটার দীর্ঘ পাইপ লাইন। এসব পুরানো পাইপ লাইনে পানির চাপ নিতে না পেরে দেখা দিচ্ছে লিকেজের। অবৈধ সংযোগ ও বাইপাস সংযোগের কারণেও তৈরি হচ্ছে সিস্টেম লস। চট্টগ্রাম ওয়াসার মোট রেজিস্ট্রার কানেকশন হলো ৭৪ হাজার ৩৩০টি। বিল করা যায় এমন সংযোগ হচ্ছে ৬৮ হাজার ৬৯০টি। আর বিল হয় না এমন সংযোগ ৫ হাজার ৫৩২টি। তাছাড়াও গড় বিল হয় এমন মিটারের সংখ্যা ১০ হাজার ৬৩৫। ফলে হিসাবের বাইরে থাকায়ও পানির অপচয় হয়ে থাকে।
পাইপ লাইনের ছিদ্রে পানি অপচয়
ওয়াসার সূত্র জানায়, ২০১৫ সালের জুলাই থেকে চলতি বছরের মে পর্যন্ত চার বছরে ১৪ হাজার ২৩৪টি ছিদ্র মেরামত বা সংস্কার করেছে ওয়াসা। এ কাজে খরচ হয়েছে ৫ কোটি ৭০ লাখ টাকা। চট্টগ্রাম মহানগরে ওয়াসার পানির পাইপলাইনের ছিদ্র কিছুতে বন্ধ হচ্ছে না। পানির চাপ বাড়লেই পুরোনো ছিদ্র আবার সচল হওয়ার পাশাপাশি দেখা দেয় নতুন ছিদ্র। প্রতি মাসে গড়ে ৩০০টি ছিদ্র মেরামত করা হয়ে থাকে। ফলে একদিকে পানির যেমন অপচয়, তেমনি ময়লা ও জীবাণু মিশে দূষিত হচ্ছে পানি।
এ প্রসঙ্গে কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সভাপতি নাজের হোসাইন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, ‘‘পানি অপচয়ের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় টাকা নষ্ট করছে ওয়াসা। তাই এ অপচয় রোধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া উচিত। পাশাপাশি পানির চাহিদা কখনোই শতভাগ মেটাতে পারবে না ওয়াসা। কারণ তারা বর্ধিত জনসংখ্যার অনুপাতে প্রকল্প প্রণয়ন করছে না।’’
প্রতি মাসে গড়ে ২৫ শতাংশ সিস্টেম লসের কথা স্বীকার করে ওয়াসার প্রধান প্রকৌশলী মাকসুদ আলম বলেন, ‘‘পাইপ লাইন লিকেজ, অবৈধ সংযোগ এবং মানবসৃষ্ট ভুলের কারণে এ অপচয় হচ্ছে। এ অপচয় কমানোর জন্য আমরা একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছি। ডিস্ট্রিক্ট মিটারিং এরিয়া (ডিএমএ) নামের এ প্রকল্পের জন্য ৬০০ কিলোমিটার এলাকায় পাইপ লাইন বসানোর কাজ চলছে। ২০২১ সালে শেষ হবে এ প্রকল্প। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে পানির অপচয় সিঙ্গেল ডিজিটে নেমে আসবে।’’