পানি সংকট নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে বিশ্বের বৃহৎ কোম্পানিগুলোর
নদীমাতৃক বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় আজ সুপেয় পানির সংকট। সবচেয়ে বেশি দুর্দশা উপকূলীয় অঞ্চলের বাসিন্দাদের। লোনা পানির অনুপ্রবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ঘন ঘন ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে সাতক্ষীরা, বাগেরহাটের মতো কিছু জেলার মানুষ প্রতিনিয়ত এ দূরাবস্থা মোকাবিলা করছেন।
শুধু বাংলাদেশ নয়, সুপেয় বা মিঠা পানির সংকট আজ এক বৈশ্বিক সমস্যা। বিশ্বের সবচেয়ে অমূল্য এই প্রাকৃতিক সম্পদের ঘাটতি নিয়ে বিশ্বের বড় বড় কিছু কোম্পানির কর্তৃপক্ষও উদ্বিগ্ন।
নদনদী বা ভূগর্ভস্থ উৎস থেকে যতদিন পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি পাওয়া যায় ততোদিন পানি সংকটের দিকটি গুরুত্ব পায় না। তবে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে পানি স্বল্পতা আরও বহুগুণে বাড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। বাণিজ্যিক খাতও এই প্রভাবমুক্ত থাকবে না। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যেসব কোম্পানি পানি নিরাপত্তার সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত নয়, সংকটের ফলে তাদের বাণিজ্যিক কার্যক্রমও বিঘ্নিত হবে।
এমন সময় এ হুঁশিয়ারি দেওয়া হলো যখন বিশ্বব্যাপী বাড়ছে মিঠা পানির মূল্য। খোদ যুক্তরাষ্ট্রের মতো উন্নত দেশের ৩০টি বৃহৎ শহরে শিল্প কারখানায় সরবরাহ করা পানির গড়মূল্য ২০১০ থেকে ২০১৯ সাল নাগাদ ৬০ শতাংশ বেড়েছে বলে জানিয়েছে বহুজাতিক ব্যাংক বার্কলেইজ। এমনকি বিগত কয়েক বছরে যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম খরাপ্রবণ রাজ্য ক্যালিফোর্নিয়ায় পানির বাজার সূচক ওয়াটার্স ফিউচার্স ৩০০ শতাংশ বেড়েছে।
গত ১৪ জুন প্রকাশিত এক গবেষণা নোটে ব্যাংকটির বিশেষজ্ঞরা পানি স্বল্পতাকে বৈশ্বিক প্রধান ভোক্তাপণ্য উৎপাদক খাতের জন্য 'সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পরিবেশগত উদ্বেগ' বলে উল্লেখ করেন। খাদ্য, পানীয়, তামাক থেকে শুরু করে কৃষি বাণিজ্য নির্ভর সব সংস্থাই এর আওতায় পড়েছে।
প্রধান ভোক্তাপণ্য উৎপাদনের খাতটি-ই সবচেয়ে বেশি ঝুঁকির সম্মুখীন বলে সেখানে উল্লেখ করা হয়। পানি স্বল্পতার প্রভাবে এ খাতটি ২০ হাজার কোটি ডলারের অভিঘাতের সম্মুখীন হবে বলে যুক্তরাজ্য ভিত্তিক ব্যাংকটির বিশ্লেষকরা জানান।
দুর্যোগটি বাস্তবে পরিণত হওয়ার কারণ; এখাতের কোম্পানিগুলোর কৃষিপণ্য নির্ভরতা, বিভিন্ন দেশে পানি সরবরাহের মূল্যে অস্থিরতা এবং এমন পরিবেশে ব্যবসা পরিচালনার ঝুঁকি থেকে। খরা, আকস্মিক বন্যা বা জলোচ্ছ্বাসের ফলেই এমন ঝুঁকিতে পড়তে পারে প্রতিষ্ঠানগুলো। তাছাড়া, স্থানীয় পানি সম্পদের অপরিমিত ব্যবহার ও দূষণের কারণে তাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের সম্ভাবনাও বাড়ছে, যা বিঘ্নিত করবে উৎপাদন ব্যবস্থাকে।
বার্কলেইজ জানায়, তারা বিশ্বের বড় বড় বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরীণ নথি নিরীক্ষা করে দেখেছে, গেল বছর এসব আয় বিবরণীতে পানি সংক্রান্ত মন্তব্য ২০১৯ সালের তুলনায় ৪৩ শতাংশ বেড়েছে। বিশুদ্ধ পানি ও নিস্কাশনের গুরুত্ব নিয়ে ক্রমবর্ধমান কর্পোরেট সচেতনতাই এর প্রধান কারণ। অর্থাৎ, কোম্পানিগুলো কারখানা অঞ্চলে পানি সংকটের গতি-প্রকৃতি প্রত্যক্ষ করেই এখন সতর্ক হয়ে উঠেছে।
তবে পরিবেশ সহযোগী টেকসই খাতের বিনিয়োগকারীরা একইসময় অন্যান্য পরিবেশগত প্রভাব প্রশমনের দিকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। অর্থাৎ, তারা এখনও সরাসরি পানি সংকট নিরসনে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ পুঁজি লগ্নী করছেন না। বার্কলেইজ জানায়, "বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে আমাদের সাম্প্রতিক আলোচনায় উঠে এসেছে যে তাদের অধিকাংশই কার্বন মূল্য বৃদ্ধির সম্ভাব্য প্রভাবে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন।"
কিন্তু, কার্বন সংক্রান্ত ঝুঁকির চাইতে পানি স্বল্পতায় বাণিজ্যিক খাত প্রভাবিত হওয়ার ঝুঁকি তিনগুণ বেশি বলে ব্যাংকটির গবেষণায় উঠে এসেছে।
নিস্ক্রিয় থাকার চড়ামূল্য:
এসঅ্যান্ডপি গ্লোবাল রেটিংসের টেকসই অর্থায়ন বিভাগের পরিচালক বেথ বার্কস মার্কিন গণমাধ্যম সিএনবিসি'কে টেলিফোনে বলেন, "পানির মজুদ বা যোগান একবার ফুরিয়ে ফেলে তখন তা বড় সমস্যায় রূপ নেয়, এজন্য পানি স্বল্পতা মোকাবিলায় সত্যিকার অর্থেই অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত।"
"এই সম্পদকে অত্যন্ত সাবধানী এবং সুচিন্তিত ব্যবস্থাপনার আওতায় আনতে হবে; তবে এক্ষেত্রে একটি বড় সমস্যা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের প্রকৃতি থেকে আহরিত পানিতে সব সময় মূল্য নির্ধারণ করা হয় না- যা সম্পদটি সংরক্ষণের উদ্যোগকে বাধাগ্রস্ত করছে।"
তাছাড়া, গুরুত্বপূর্ণ অনেক শিল্পকে ছাড় দিয়ে অনেক দেশই কম মূল্যে পানি সংগ্রহের সুযোগ দেয়, তাই সব দেশ ও অঞ্চলে পানির মূল্য সংকটের প্রকৃত দশা তুলে ধরে না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অত্যন্ত কম বা বিনামূল্যেই পানি ব্যবহারের সুবিধা পাচ্ছে তারা। অথচ পানির পর্যাপ্ত যোগান থাকার ওপরই নির্ভরশীল সামগ্রিক অর্থনীতির অধিকাংশ খাত। তাই মূল্যবৃদ্ধির ঘটনাই বিশ্বব্যাপী সম্পদটির ঘাটতি তুলে ধরছে বলে জানিয়েছে বার্কলেইজ।
তবে বাণিজ্যিক সংস্থাগুলো যে দরে পানি কিনছে প্রকৃত মূল্য তার চাইতে তিন থেকে পাঁচগুণ বেশি হওয়া উচিত বলেও ব্যাংকটি অনুমান করছে। এ মূল্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের পানি ব্যবহারের ফলে আর্থ-সামাজিক ও পরিবেশগত প্রভাবের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ উভয় দিককেই আমলে নেওয়া হয়।
বার্কলেইজের প্রাক্কালন অনুসারে যথাযথ পানি ব্যবস্থাপনা তৈরিতে বৈশ্বিক ভোক্তাপণ্য উৎপাদক খাতকে ১১শ কোটি ডলার বিনিয়োগ করতে হবে। কিন্তু, কোনো পদক্ষেপ না নিলে এ ব্যয় পরবর্তীতে ১৮ গুণ বেশি হবে।
ভোক্তাপণ্য খাতের কৃষি নির্ভরশীলতাকে প্রধান অর্থনৈতিক ঝুঁকি হিসেবে চিহ্নিত করে বলা হয়েছে এর ফলে এবিএফ ও টাইসন ফুডের মতো বৃহৎ কৃষি ব্যবসাগুলোর আয়; কর, সুদ, মূল্যস্ফীতিসহ সমন্বয়ের পূর্বে ২২ শতাংশ কমবে।
এছাড়া, সবচেয়ে বেশি আর্থিক ঝুঁকির মধ্যে থাকা কোম্পানি পর্যায়ে রয়েছে বৈশ্বিক কনজ্যুমার ফুড জায়ান্ট ইউনিলিভার, ভোক্তাপণ্য কোম্পানি কোলগেট এবং পরিস্কারক পণ্য প্রস্তুতকারক রেকিট-বেনকিজার। পানির সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত না করলে এসব কোম্পানির কর, সুদ পূর্ববর্তী আয় ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত কমতে পারে।
এ প্রতিবেদনের প্রতিক্রিয়ায় দেওয়া এক বিবৃতিতে রেকিট-বেনকিজার বলেছে, ২০৩০ সাল নাগাদ স্বল্পতা থাকা অঞ্চলগুলোতে তারা পানি সংরক্ষণে ইতিবাচক ভূমিকা রাখার লক্ষ্য নিয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশসহ পানি স্বল্পতা থাকা ২০টি অঞ্চলে কারখানা রয়েছে কোম্পানিটির। সঠিক ব্যবহার নিশ্চিতে পানি স্বল্পতায় প্রভাবিত মূল অংশীদারদের সঙ্গে জলবায়ু ঝুঁকি প্রশমন ও পানি সংকট নিরসনের আলোচনাও শুরু করা হয়েছে বলে কোম্পানিটি জানিয়েছে।
কোম্পানির এক মুখপাত্র সিএনবিসি'কে পাঠানো ইমেইল বার্তায় জানান, "পানির অভাব মানুষের জীবন-জীবিকায় যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে আমরা তার সম্পর্কে সচেতন আছি। এটি জনস্বাস্থ্য ও ব্যবসা উভয়ের জন্য বিপজ্জনক। তাই বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের পানি স্বল্পতায় ভোগা অঞ্চলে আমরা সুপেয় পানি প্রাপ্তি এবং স্যানিটেশন সুবিধা বৃদ্ধির উদ্যোগ নিয়েছি।"
তবে এব্যাপারে মন্তব্যের জন্য সিনএনবিসির পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হলেও ইউনিলিভার বা কোলগেট তাতে সাড়া দেয়নি।
- সূত্র: সিএনবিসি