প্রিয়জনের লাশের অপেক্ষায় তারা
ছেলের খোঁজে ঢাকা মেডিকেল কলেজের মর্গে এসেছেন কবির হোসেন। বলেন, "রক্ত জমা নিয়েছে, বলেছে টেস্টে মিললে লাশ ফেরত দিবে"।
কবির হোসেনের মতো অনেকেই স্বজনদের খোঁজে গতকাল ছুটে আসেন ঢাকা মেডিকেলের মর্গে। তাদের কেউ স্ত্রী, মেয়ে, মা, আবার কেউবা ভাগ্নের খোঁজে আসেন। কবির হোসেনের ছেলে (১৮) মো. রাকিব তিন বছর যাবত কাজ করছিল হাশেম ফুড অ্যান্ড বেভারেজ লিমিটেডের কারখানায়।
শুক্রবার রাতে কবির হোসেন টিবিএসকে বলেন, "দুপুর তিনটা থেকে অপেক্ষা করছি। আমাদের লাশ দেখায় নি। বলেছে দেখলে চিনতে পারব না। সন্ধার পর রক্ত নিয়েছে। ২১ দিন অথবা একমাস সময় লাগবে রিপোর্ট দিতে । রিপোর্ট মিললে লাশ ফেরত দিবে"।
নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে নিহত ৪৯ জনের মরদেহ শনাক্তে নমুনা সংগ্রহের জন্য অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) ফরেনসিক ডিএনএ ল্যাবের টিম কাজ শুরু করেছে। ডিএনএ পরীক্ষার মাধ্যমে মরদেহ শনাক্ত করতে অন্তত ২১ থেকে ৩০ দিন সময় লাগতে পারে বলে সাংবাদিকদের জানিয়েছেন সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার (ফরেনসিক) রোমানা আক্তার।
মেয়েকে খুঁজতে ঢাকা মেডিকেল কলেজের মর্গের সামনে ছিলেন সীমা আক্তার। তিনি বলেন, "আমি মেয়েকে কাজে দিতে চাইনি, জোর করে কাজে গিয়েছে। কাজে যেতে চাওয়ায় দুই দিন মেরেছিও"।
সীমা আক্তারের মেয়ে শান্তা মনি (১৪) তিন দিন যাবত চাকরিতে ঢুকেছিল। সীমা কান্নাজড়িত কন্ঠে বলেন, "সীমার বাবা মারা গেছে যখন ওর ৮ বছর। বাবাহারা মেয়েকে আমি এত বড় করেছি। আমি শুধু মেয়ের লাশটা চাই"।
পরবান্দ বর্মন ঢাকা মেডিকেলের মর্গের এদিক সেদিক ঘুরছিলেন। কাঁদতে কাঁদতে বলেন, "কেন মেয়েকে কাজে দিলাম। আমার মেয়েকে এনে দিন"।
চলতি মাসেই ৪৮০০ টাকা বেতনে কারখানাটিতে যোগ দেয় পরবান্দ বর্মনের মেয়ে কম্পা রানী (১৪)।
মাহফুজুর রহমান আসেন তার ভাগিনা সাজ্জাদ হোসেকে (২২) খুঁজতে। তিনি বলেন, "৪র্থ তলায় কাজ করতো । আমি ভাগিনার লাশটা অন্তত ফেরত চাই"।
এদিকে স্বজনদের খোঁজে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে সজীব গ্রুপের হাশেম ফুড অ্যান্ড বেভারেজ লিমিটেডের কারখানার সামনে ভিড় করে আছে শত শত মানুষ।
কিশোরগঞ্জ মিঠামইন এলাকার আরেকজন কিশোর শ্রমিক ১৬ বছরের রাবেয়াও বৃহস্পতিবার রাত থেকে নিখোঁজ রয়েছে। মেয়ের খোঁজে দাঁড়িয়ে ছিলেন বাবা বাচ্চু মিয়া। মাত্র এক মাস আগে কারখানায় যোগদান করেছিলেন রাবেয়া, কারখানার চতুর্থ তলায় চকোলেট তৈরির ইউনিটে কাজ করত সে।
বৃহস্পতিবার রাতে টেলিভিশনের মাধ্যমে অগ্নিকাণ্ডের খবর পাওয়ার পর বাচ্চু মিয়া আর সারারাত ঘুমাতে পারেন নি। ফজরের পরপরই মিঠামইন থেকে নারায়ণগঞ্জের উদ্দেশ্যে রওনা দেন।
চলমান লকডাউনের মধ্যে ৬৫ বছরের এই বৃদ্ধ কখনো রিকশা, কখনো ভ্যান আবার কখনো অন্য কোন যানবাহনের মাধ্যমে ৫ ঘন্টার যাত্রা শেষে গন্তব্যস্থলে পৌঁছান।
চোখে সমস্যা থাকায় ৫-৬ ফুট দূরত্বের বাইরে ঠিকমত দেখতে পান না বাচ্চু মিয়া। টিবিএসকে জানালেন, তিনি মেয়ের লাশটা অন্তত চান। তিনি জানেন, ভবনের চার তলাটিই অগ্নিকাণ্ডে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
"তার লাশ না পেলে আমি বাড়ি ফিরে গিয়ে কী জবাব দেব। জোরে কাঁদবার শক্তিও হারিয়ে ফেলেছি, হয়তো আল্লাহ এটাই আমার ভাগ্যে লিখে রেখেছিলেন"।
এই প্রতিবেদক বাচ্চু মিয়ার সাথে কারখানা থেকে নিয়ন্ত্রণ কক্ষ হয়ে হাসপাতাল পর্যন্ত যান। কিন্তু প্রতিবেদনটি লেখা পর্যন্ত তার মেয়ের কোন খোঁজ পাওয়া যায় নি।
৭ বছরের নয়ন নানীর সাথে মা নাজমা বেগমকে খুঁজছিলেন৷ নয়নকে দুর্ঘটনার দিন সকালেও তার মা ভাত খাইয়ে কারখানায় আসেন।
কিশোরগঞ্জ থেকে চাঁন মিয়া আসেন ছেলে নাজমুলের (১৭) খোঁজে। নাজমুল দুইমাস ধরে কাজ করছিলেন জুস কারখানাটিতে। এখন পর্যন্ত কোনো বেতন পায়নি। ৬ হাজার টাকা বেতন ছিল তার। ঈদে বেতনের টাকা নিয়ে বাড়িতে যাবে এমনটাই বলেছিলেন। দুর্ঘটনার দিন সকালে সর্বশেষ নাজমুলের সাথে কথা হয় বাবা চাঁন মিয়ার। একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে পাগলপ্রায় চাঁন মিয়া।
ডিএনএ টেস্টের জন্য রক্ত দিয়েছেন আমেনা আক্তারও। তার মেয়ে সেলিনা (১৪) ললিপপ কারখানায় কাজ করত, তিনি নিজেও একই প্রতিষ্ঠানের লাচ্ছি কারখানায় কর্মরত। ঘটনার দিন তার নাইট ডিউটি ছিল। উভয়েরই বেতন ছিল ৫৬০০ টাকা। তাদের চার মাসের ওভারটাইমের টাকা আর একমাসের বেতন এখনো বাকি।
গত বৃহস্পতিবার নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলার সজীব গ্রুপের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান সেজান জুস কারখানায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে অর্ধশতাধিক মানুষের প্রাণহানি ঘটে।
স্বজনদের সন্ধানে কারখানার পোড়া ভবনটির সামনে দুইদিন যাবত ভিড় করে আছেন শত শত মানুষ।