চামড়া শিল্পের জন্য কি আরেকটি হতাশাজনক ঈদ অপেক্ষা করছে? সম্ভবত হ্যাঁ
আন্তর্জাতিক ও দেশীয় বাজারে টানা দরপতনের কারণে বছরের পর বছর সংকুচিত হচ্ছে চামড়া শিল্প। বর্তমানে দেশীয় বাজারে যে দামে চামড়া বিক্রি হচ্ছে তা গত এক দশকের মধ্যে সর্বনিম্ন বলে জানিয়েছেন এই খাতের ব্যবসায়ীরা।
আসন্ন কোরবানির ঈদে চামড়া সংগ্রহ ও বাজার নিয়ে অনিশ্চয়তায় পড়েছে দেশের চামড়া ব্যবসায়ীরা।
বাংলাদেশ ট্যানার্স এসোসিয়েশনের সভাপতি শাহীন আহমেদ বলেন, "করোনার কারণে ট্যানারি মালিকরা মূলধন সংকটে আছে। চামড়া নিয়ে অনিশ্চয়তা কতটা কমানো যায়, সে বিষয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও আমরা কাজ করছি। পাশাপাশি অন্যান্যবারের মতো এবার যেন চামড়া নিয়ে বড় কোনো সংকট তৈরী না হয়, সে বিষয়ে কাজ করছি।"
কোরবানিতে চামড়া নিয়ে অনিশ্চয়তার মধ্যেই রপ্তানি বাড়ার তথ্য জানিয়েছে বাংলাদেশ রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি)। সদ্য শেষ হওয়া ২০২০-২১ অর্থবছরে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি বেড়েছে ২.৩ শতাংশ আর ২০১৯-২০ অর্থবছরের তুলনায় বেড়েছে ১৮% শতাংশ।
তবে ২০২০-২১ অর্থবছরে লেদার ও লেদার ফুটওয়্যার রপ্তানি যথাক্রমে বেড়েছে ৩.৬ শতাংশ ও ৫.৫৩ শতাংশ। আর লেদার পণ্য রপ্তানি কমেছে ৪.৬৬ শতাংশ।
এদিকে ২০১৭ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত চার বছরের ঋণের সুদ মওকুফ চেয়ে বাংলাদেশ ব্যাংককে চিঠি দিয়েছে ট্যানারি মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ ট্যানার্স এসোসিয়েশন।
এ বিষয়ে শাহীন আহমেদ বলেন, "ট্যানারি মালিকদের প্রায় এক হাজার ৭০০ কোটি টাকার ঋণ, যা ৪ বছরে সুদ প্রায় ৫০০ থেকে ৫৫০ কোটি টাকা। আমরা এই সুদ মওকুফ চাই। কারণ ২০১৭ সালে সাভার ট্যানারি পল্লীতে যাওয়ার পর থেকে তেমন ব্যবসা হয়নি। বরং নানান সংকটের মধ্য দিয়ে চলেছি। আবার করোনা মহামারিতে ব্যবসার অনেক ক্ষতিও হয়েছে।"
তিনি বলেন, "দফায় দফায় লকডাউনের কারণে ইউরোপে চামড়ার বাজার স্বাভাবিক হয়নি। এই বাজার স্বাভাবিক হলে, চামড়া রপ্তানি বাড়বে। আর ক্রেতারা পণ্য নিলে ট্যানারি মালিকরাও আটকে যাওয়া মূলধন বিনিয়োগ করতে পারবে।"
"চামড়া কিনতে নগদ টাকা প্রয়োজন, ব্যাংক ঋণ পেলে উদ্যোক্তারা পর্যাপ্ত চামড়া কিনতে পারবে। পাশাপাশি এবার কোরবানি কম হওয়ার সম্ভাবনা আছে, কাজেই চামড়া নিয়ে খুব বেশি সমস্যা হওয়ার কথা নয়," যোগ করেন তিনি।
সূত্র জানায়, সারাদেশে দুইশ'র বেশি ট্যানারি রয়েছে। যার মধ্যে বাংলাদেশ ট্যানার্স এসোসিয়েশনের সদস্য ১৮১।
ট্যানারি মালিকরা চামড়া দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারে বিক্রির পাশাপাশি বিদেশেও রপ্তানি করে। ব্যবহার উপযোগী করার পর একটি অংশ সরাসরি রপ্তানি হয় আর একটি অংশ দিয়ে চামড়াজাত পণ্য তৈরী হয়। যা দেশে বিক্রির পাশাপাশি বিদেশেও রপ্তানি করা হয়।
গত বছর কোরবানির কাঁচা চামড়া নিয়ে বিশৃঙ্খল অবস্থার সৃষ্টি হয়। কাঁচা চামড়ার দাম আগের বছরের চেয়ে প্রায় ৩০ শতাংশ কমানো হলেও কম দাম ও ক্রেতা না থাকায় অনেকে মাটিতে পুঁতে ফেলে।
গত বছর ঢাকায় গরুর চামড়া প্রতিবর্গ ফুট ৩৫ থেকে ৪০ টাকা এবং ঢাকার বাইরে ২৮ থেকে ৩২ টাকা দাম নির্ধারণ হয়েছে। এছাড়া প্রায় ২৭ শতাংশ দাম কমিয়ে প্রতি বর্গফুট খাসির চামড়ার দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ১৩ থেকে ১৫ টাকা।
এমবি ট্যানার্স লিমিটেডের পরিচালক মোহাম্মদ রিন্টু টিবিএসকে বলেন, "গত তিনবছর ধরে চামড়া নিয়ে যে সংকট ছিল, এবার হয়তো তা হবে না। তবে চামড়া নিয়ে উদ্যোক্তাদের যে প্রস্তুতি ছিল, করোনার কারণে তা সম্ভব হবে না। কারণ উৎপাদিত পণ্য কারখানায় পড়ে আছে। মূলধনের সংকটও রয়েছে"।
বাংলাদেশ ট্যানার্স এসোসিয়েশনের সাবেক এই সিনিয়র কাযনির্বাহী সদস্য বলেন, "করোনার কারণে ইউরোপের বাজার কঠিন অবস্থার মধ্যে রয়েছে। ক্রেতা পণ্য ঠিক মতো নিচ্ছে না। এ অবস্থায় আগামী ঈদে চামড়ার বাজার ভালো-খারাপের মধ্য দিয়েই যাবে।"
প্রস্তুতি আছে কিন্তু মূলধনের সংকট জানিয়ে এবিএস ট্যানারি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোঃ ইমাম হোসেন বলেন, "মহামারির কারণে ব্যবসা চলেনি, কোনোমতে কারখানা চলেছে। তবে উৎপাদিত পণ্য এখনো গোডাউনে পড়ে আছে। কারণ যেসব দেশে রপ্তানি করা হয়, ওইসব দেশে লকডাউনের কারণে পণ্য নেয়নি।"
"পণ্য পাঠানো সম্ভব না হওয়ায় বেশির ভাগ উদ্যোক্তাই মূলধন সংকটে। ব্যাংক নতুন করে ঋণ দিতে চাইছে না। এখন পণ্য দিতে না পারলে টাকাও তো আসছে না। এই অবস্থায় মূলধনের সহায়তা না পেলে ঈদের চামড়া কেনা সম্ভব হবে না।"
তিনি আরও বলেন, "লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপের সার্টিফিকেট না থাকায়, বিশ্বের বড় বড় ক্রেতারা পণ্য কিনতে আসছে না। মূলত, চামড়া শিল্পনগরী পুরোপুরি কমপ্লায়েন্স না হওয়ায় এই সর্টিফিকেট পাচ্ছে না।"
চামড়া নিয়ে অনিশ্চয়তায় চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীরা
দেশের চামড়া শিল্পের কাঁচামালের বড় যোগান আসে চট্টগ্রাম থেকে। ফলে গত তিন দশকে চট্টগ্রামে ২২টি ট্যানারি প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। কিন্তু গত কয়েক বছরের চামড়ার টানা দরপতনে ব্যবসায় লোকসান ও ইটিপি স্থাপন করতে না পারায় ২১টি প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে। বর্তমানে শুধুমাত্র একটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে যেটি শতভাগ ইটিপি চালু করে চামড়ার ব্যবসা পরিচালনা করছে। এতে চট্টগ্রামের চামড়ার ব্যবসা এই একটি প্রতিষ্ঠানের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। প্রতিযোগিতামূলক বাজার না থাকায় ঢাকার ট্যানারি মালিকদের কাছে কম দামে ও বাকিতে চামড়া বিক্রিতে বাধ্য হচ্ছেন চট্টগ্রামের চামড়া ব্যবসায়ীরা।
করোনা মহামারির কারণে কক্সবাজার ও তিন পার্বত্য জেলাসহ চট্টগ্রামে প্রায় ৪ লাখ পশুর চামড়া সংগ্রহ হবে এবারের কোরবানির ঈদে। গত বছরও প্রায় ৪ লাখ চামড়া সংগ্রহ হয়েছিল। তবে ২০১৯ সালের কোরবানির ঈদে চামড়া সংগ্রহ হয়েছিল ৫ লাখের বেশি। কিন্তু চট্টগ্রামের একমাত্র ট্যানারি প্রতিষ্ঠান রিফ লেদারের বছরে চামড়ার চাহিদা মাত্র এক লাখ পিস। এতে চট্টগ্রামের চামড়া ব্যবসায়ীদের বাকি তিন লাখ চামড়া বিক্রির জন্য ঢাকার ট্যানারি মালিকদের উপর নির্ভর করতে হবে। কিন্তু ঢাকার ট্যানারি মালিকদের কাছে চামড়া বিক্রি করে সুবিধা করতে পারেন না চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীরা।
কারণ হিসেবে চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীরা বলেন, ঢাকা নির্ভর হলে চামড়ার দাম পাওয়া যায় না। যা দাম পাওয়া যায় তার আবার বেশির ভাগ টাকা বাকি রাখতে হয়। তিন-চার মাসের জন্য বাকিতে চামড়া বিক্রি করে এই টাকা আদায়ে ৮ থেকে ১০ মাস এমনকি এক বছর পর্যন্ত লেগে যায়। এতে ব্যাংক ঋণ বা চড়া সুদে টাকা নিয়ে ব্যবসায় থাকা এমন ব্যবসায়ীদের অনেক বড় লোকসান হয়।
ব্যবসায়ীরা জানান, বর্তমানে চট্টগ্রামের আড়তগুলোতে লবনযুক্ত প্রতি বর্গফুট গরুর চামড়া ২৫-৩০ টাকা, মহিষ ২০-২৫ টাকা, ছাগল (খাসি) ১৮-২০ টাকা এবং ছাগল (ছাগি) ১২-১৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ২০১৯ সালে একই সময়ে এই চামড়ার দাম ছিল গরু ৩৫-৪০ টাকা, মহিষ ২৫-৩০ টাকা এবং ছাগল ২০-২৫ টাকা। এর আগের বছরগুলোতে এসব চামড়ার দাম আরো বেশি ছিল।
চট্টগ্রামের চালু থাকা একমাত্র প্রতিষ্ঠান রিফ লেদার লিমিটেড'র পরিচালক (অপারেশন অ্যান্ড সেলস) মোখলেসুর রহমান বলেন, "দেশের চামড়ার প্রায় ৯৫ ভাগ বিদেশে রপ্তানি হয়। বাকি মাত্র ৫ শতাংশই দেশে জুতাসহ চামড়া পণ্য তৈরিতে ব্যবহার হয়। কিন্তু আন্তর্জাতিক বাজারে চামড়ার দাম টানা নিম্নমুখী। করোনা মহামারির কারণে গত বছর থেকে চামড়ার দাম আরো কমেছে।"
তিনি আরো বলেন, "গত কয়েক বছর ধরে চট্টগ্রামসহ সারা দেশে চামড়া শিল্পে ভালো ব্যবসা যাচ্ছে না। সামনে কোরবানির ঈদ ঘনিয়ে আসছে। সারা বছরের সিংহভাগ চামড়াই সংগ্রহ হয় এই কোরবানির ঈদকে ঘিরে। কিন্তু এই চামড়া শিল্পের দুর্দিনে অনেকেই ব্যবসা ছেড়ে চলে যাচ্ছেন। ফলে এই অবস্থায় শিল্পটিকে বাঁচাতে শিল্প মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে উদ্যোগ নিতে হবে"।
চট্টগ্রামের কাঁচা চামড়ার আড়তদার মোহাম্মদ সেকান্দার হোসেন বলেন, গত বছর কোরবানির ঈদে সরকার নির্ধারিত দামে লবনযুক্ত প্রতিবর্গ ফুট গরুর চামড়া ২৮ থেকে ৩০ টাকা, মহিশ ২৫ টাকা, ছাগল ১৩-১৫ টাকা, বকরি ১০-১২ টাকা দামে ক্রয় করি। কিন্তু পরবর্তী সময়ে সেই চামড়া বিক্রি করতে হয়েছে কেনা দামেরও কম দামে। এমনকি অনেক চামড়া দীর্ঘদিন ধরে অবিক্রিত রয়ে গেছে।
তিনি আরো বলেন, "গত বছর চট্টগ্রামে শুধু একটি প্রতিষ্ঠান (রিফ লেদার) ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে মাত্র ৮০ হাজার পিস চামড়া সংগ্রহ করেছে। যা কোরবানির মৌসুমে চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীদের সংগ্রহ করা চামড়ার মাত্র ২০ শতাংশ। বাকি চামড়াগুলো বিক্রি করতে ব্যবসায়ীদের ঢাকার ট্যানারি মালিকদের দ্বারে দ্বারে ঘুরতে হয়েছে। এতে অনেক ব্যবসায়ী কেনা দামের চেয়ে কম দামে চামড়া বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছে। ফলে আসন্ন কোরবানির ঈদে চামড়ার বাজার নিয়ে শঙ্কায় রয়েছে দীর্ঘদিন ধরে এই পেশায় থাকা বিভিন্ন স্তরের ব্যবসায়ীরা"।
ট্যানারি মালিক ও চামড়া ব্যবসায়ী সমিতির নেতারা জানিয়েছেন, বাংলাদেশের চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের বড় বাজার হলো জার্মানি, ইতালি, ফ্রান্স, নেদারল্যান্ডস, স্পেন, রাশিয়া, ব্রাজিল, জাপান, চীন, সিঙ্গাপুর, তাইওয়ান, দক্ষিণ কোরিয়া, যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশ। কিন্তু এসব দেশে চামড়া ও চামড়া জাতীয় দ্রব্য বিক্রি হচ্ছে আগের চেয়ে শতকরা ২০ শতাংশ কম দামে। এর প্রভাব পড়েছে দেশীয় চামড়া শিল্পেও। গত বছর বিদেশের বাজারে প্রতি বর্গফুট গরুর প্রক্রিয়াজাত চামড়া রপ্তানি হয়েছে ২ ডলারেরও বেশি দামে। এক বছরের ব্যবধানে এখন দেড় ডলার দামে রপ্তানি হচ্ছে।
চট্টগ্রাম কাঁচা চামড়া আড়তদার ব্যবসায়ী সমবায় সমিতি লিমিটেড'র সভাপতি মুসলিম উদ্দিন বলেন, "এবার কোরবানির ঈদে চট্টগ্রামে প্রায় ৪ লাখ পশুর চামড়া পাওয়া যেতে পারে। এরমধ্যে গরুর ৩ লাখ ও ছাগলসহ অন্যান্য প্রাণীর এক লাখ। সমিতির অধীনে ১১২ জন নিবন্ধিত পাইকারি চামড়া ব্যবসায়ী রয়েছেন। এর বাইরেও ৭০ থেকে ৮০ জন পাইকার চামড়া কেনেন। কিন্তু বছর বছর লোকসান গুনে গত কয়েক বছরে অনেকই চামড়া ব্যবসা ছেড়ে অন্য পেশায় চলে গেছেন।"
তিনি বলেন, "ট্যানারি মালিকরা আমাদের জানিয়েছেন, চামড়া শিল্পের দীর্ঘদিনের মন্দা ও করোনার কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে চামড়ার দাম কম। বেশি দামে চামড়া কিনলে গত বছরের মতো বিপদে পড়তে হবে। তাই এবারে চামড়া কেনা নিয়ে সতর্ক অবস্থানে রয়েছে তারা। এবারে মাঠ পর্যায়ে প্রতিটি গরুর চামড়া ২০০ থেকে সর্বোচ্চ ৪০০ টাকার মধ্যে হতে পারে বলে ইঙ্গিত দিয়েছেন কয়েকজন ব্যবসায়ী"।