আমাজনের নতুন প্রজাতি হিসেবে আবিষ্কৃত হলো ‘জম্বি ফ্রগ’
আশেপাশের সবকিছু অন্ধকার, কোথাও কেউ নেই। আর এই অন্ধকারের মাঝেই খালি হাতে মাটি খুঁড়ে চলেছেন এক ব্যক্তি; কাদায় ঢেকে গেছে তার শরীর। লক্ষ্য একটাই, সেই বিভ্রান্তকর অদ্ভুত প্রাণীর মুখ দিয়ে সেই ডাক বের করা, যা আগে কেউ কখনো শোনেনি।
প্রথম দর্শনে এটিকে ভৌতিক কোনো থ্রিলার চলচ্চিত্রের দৃশ্য বলে মনে হলেও, আসলে তা নয়। এই ভুতুড়ে রহস্যের সঙ্গে চলচ্চিত্রের কোনো সম্পর্ক নেই। এভাবেই জার্মান হার্পেটোলজিস্ট (উভচর ও সরীসৃপ জাতীয় প্রাণী বিশেষজ্ঞ) রাফায়েল আর্নেস্ট আমাজন জঙ্গলে ব্যাঙ খোঁজার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করলেন। ঘন জঙ্গলে তার সেই প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়নি।
'জম্বি ফ্রগ' নামক নতুন এক ধরনের প্রাণী আবিষ্কারের মিশনের অংশ ছিলেন আর্নেস্ট। যদিও প্রাণীটির কমলারঙা শরীর দেখতে যথেষ্ট অদ্ভুত; কিন্তু ৪০ মিলিমিটারের এই উভচর প্রাণী আসলে সেরকম ক্ষতিকর কিছু নয়।
আর্নেস্ট জানালেন, 'আমরা ব্যাঙটাকে এই নাম দিয়েছি, কারণ গবেষকরা যখন ব্যাঙটাকে মাটি খুঁড়ে তুলে আনেন, তখন ওর চেহারাটাই জম্বির মতো হয়ে যায়।'
এই ধরনের প্রাণী সাধারণত রাতের বেলাই বেশি চলাফেরা করে এবং আলাদা এক ধরনের শব্দ করে। তাই একবার সেই শব্দ শুনেই মাটি থেকে তুলে আনতে হয় ওদের। আর এই কাজ করতে গেলে যে আপনি কাদামাখা ভূত হয়ে উঠবেন, তা আবারও স্মরণ করিয়ে দিলেন আর্নেস্ট। কারণ শুধুমাত্র বৃষ্টির সময়েই এইসব ব্যাঙ বাইরে বের হয়।
নতুন প্রজাতির প্রাণী খুঁজে পাওয়া
আর্নেস্ট নিজের পিএইচডির মাঠপর্যায়ের গবেষণার জন্য দক্ষিণ আমেরিকার গুয়ানায় আমাজন জঙ্গলে দুই বছর সময় কাটিয়েছেন। অধিকাংশ সময়ই তিনি একা থেকেছেন ষেখানে। তার মূল লক্ষ্য ছিল মানুষের মাধ্যমে জীববৈচিত্র্য কতটা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে তা অনুসন্ধান করা এবং এ কাজের উদাহরণ হিসেবে তিনি উভচর প্রাণীদের পর্যবেক্ষণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। আর তখনই এই বিশেষ প্রজাতির ব্যাঙ খুঁজে পান।
সেই মুহূর্তকে 'কী করতে হবে, কোথায় খুঁজতে হবে তা বুঝতে পারার এবং অতিশয় ভাগ্যবান মুহূর্ত' বলে অভিহিত করেছেন আর্নেস্ট।
সেই থেকে আর্নেস্ট একদল আন্তর্জাতিক গবেষক দলের সাথে ভিড়ে গেছেন এই প্রাণী সম্পর্কে আরও বেশি জানতে। তারা 'সিন্যাপচিউরেনাস' নামক একই গোত্র থেকে ৩টি প্রজাতি চিহ্নিত করেছেন।
উভচর প্রাণীদের 'গিয়ানা শিল্ড' বলে চিহ্নিত করা হয়েছে যারা গুয়ানা, ফ্রেঞ্চ গুয়ানা ও ব্রাজিলের ক্রান্তীয় রেইনফরেস্ট অঞ্চলে থাকে। এত দূরবর্তী অঞ্চলে পাওয়া যায় বলে এই ব্যাঙগুলো সম্পর্কে খুব বেশি তথ্য জানা যায়নি।
আর্নেস্ট জানান, ওইসব ব্যাঙের জীবনের সংক্ষিপ্ত কার্যক্রমের ফলে ওগুলো সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। তাদের গবেষণার ভিত্তিতে বিজ্ঞানীরা একই গোত্রের ৬টি প্রজাতি থাকতে পারে বলে জানিয়েছেন, যেগুলো এখনো চিহ্নিত করা যায়নি।
সাত বছর বয়সে প্রথম সাপের কামড় খেলেও, প্যাশন কমেনি আর্নেস্টের। তিনি জানান, এরকম পেশার সাথে যুক্ত যে কারও জন্য নতুন এক প্রজাতির ব্যাঙ খুঁজে বের করা খুবই রোমাঞ্চকর ব্যাপার। তবে উভচর প্রাণীদের ক্ষেত্রে নতুন প্রজাতির উদ্ভব ঘটা অস্বাভাবিক কিছু নয়।
কিন্তু মেরুদণ্ডি প্রাণীদের মধ্যে উভচররা সবচেয়ে ঝুঁকির মধ্যে থাকায়, এই আবিষ্কার নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া রয়েছে। আর্নেস্ট বলেন, 'যখনই নতুন কোনো প্রজাতি আবিষ্কার করছি, আমাদের এও মনে রাখতে হবে, আমরা প্রজাতি হারাচ্ছি; যতটা আবিষ্কার করছি, হারাচ্ছি তারচেয়ে বেশি।' এমনকি এও সম্ভব যে, জম্বি ফ্রগও একটি বিপন্ন প্রাণী।
একাধিক ঝুঁকি
আমাজন রেইনফরেস্টকে বলা হয় বিশ্বের সর্ববৃহৎ জীববৈচিত্র্যের জায়গা, বিশেষ করে উভচরদের জন্য। বিশ্বের অধিকাংশ উভচর প্রাণীর উৎপত্তিই এখান থেকে।
আমাজনে রয়েছে কয়েক হাজার ধরনের ব্যাঙ। নিজের চামড়ার মাধ্যমে শ্বাস নেয় বলে উভচররা পানির মান ও পরিবেশগত অবনতি, দূষণ, দূষিত কেমিক্যাল ও রোগবালাইয়ের প্রতি অত্যন্ত সংবেদনশীল।
বৈশ্বিক উভচর প্রাণী হ্রাসের হিসাব অনুযায়ী, ৭০ শতাংশ উভচর প্রাণী বিলুপ্ত হওয়ার ঝুঁকিতে আছে। আমাদের বাস্তুতন্ত্র যে ভারসাম্য হারাচ্ছে, সে বিষয়ে একটি ইঙ্গিত দেয় এই হিসাব।
আমাজনের কথা বলতে গিয়ে আর্নেস্ট জানালেন, খনন করা, কাঠ কেটে নেওয়া, দখল ও বড় পরিসরে অবকাঠামোগত প্রকল্পের মতো মানবসৃষ্ট নানা অবৈধ কার্যক্রমের ফলে এ অঞ্চলে চাপ বৃদ্ধি পাচ্ছে। সেইসঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তনের সমস্যা তো থাকছেই।
নজিরবিহীন ক্ষতি
মে থেকে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত আমাজনে শুষ্ক মৌসুম থাকে এবং এ সময়ই বৃক্ষনিধনের ঘটনা ঘটে সবচেয়ে বেশি। অবৈধ নানা কাজের ফলে বনে আগুন লেগে যায়। অনেকেই বনকে কৃষিকাজের কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করেন।
ব্রাজিলের জাতীয় মহাকাশ গবেষণা ইনস্টিটিউট সূত্র জানায়, ২০২১ সালের মে মাস পর্যন্ত টানা তৃতীয় মাসের মতো রেকর্ড হারে বন নিধন হয়েছে। শুধু মে মাসেই বন নিধন হয়েছে ১১৮০ বর্গ কিলোমিটার।
প্রেসিডেন্ট বলসোনারোর শাসনে ব্রাজিলে পরিবেশ সুরক্ষা এজেন্সি ও আইনের দুর্বলতা নিয়ে প্রতিবাদ করেছেন দেশটির পরিবেশবাদীরা। আর্নেস্ট বলেন, 'ব্রাজিলে নজিরবিহীনভাবে জীববৈচিত্র্য নষ্ট হচ্ছে এবং এজন্য বর্তমান সরকার অনেকটাই দায়ী।'
-
সূত্র: ডয়চে ভেলে