রেকর্ড সংক্রমণের মধ্যেই শিথিল হচ্ছে কঠোর বিধিনিষেধ
দেশে কোভিড রোগী শনাক্তের নতুন রেকর্ডের মধ্যেও চলমান কঠোর বিধিনিষেধ শিথিল করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। মঙ্গলবার (১৩ জুলাই) এ বিষয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করা হবে।
গত ২৪ ঘন্টায় মৃত্যুও হয়েছে দুই শতাধিক। এরমধ্যে এ মাসের অর্ধেক না পেরুতেই এপ্রিলে সবেচেয়ে বেশি মৃত্যুর যে রেকর্ড হয়েছিল- তা আগামী দুই-এক দিনের মধ্যেই ভাঙতে যাচ্ছে। সোমবার সরকারের স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দেয়া তথ্য বিশ্লেষণে এমন তথ্য মিলেছে।
অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, গত ২৪ ঘন্টায় দেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত শনাক্ত হয়েছে ১৩ হাজার ৭৬৮ জন। এদিন পরীক্ষা হয়েছে ৪৪ হাজার ৬৬৭টি নমুনা। মৃতের সংখ্যা ২২০ জন। এমাসে এপর্যন্ত মৃত্যুবরণ করেছেন মোট ২ হাজার ১৩৬ জন।
এর আগে এক মাসে সর্বাধিক মৃত্যুর রেকর্ড করা হয়েছিল ২ হাজার ৪০৪ জন। চলতি মাসের এখনও অর্ধেক সময় না পেরুলেও, ইতোমধ্যেই সর্বোচ্চ মৃত্যুর সেই সংখ্যাটি ছুঁই ছুঁই করছে। প্রতিদিন শনাক্ত রোগীর সংখ্যাও দশ হাজার ছাড়িয়ে যাচ্ছে। তার মধ্যেই কঠোর বিধিনিষেধ উঠিয়ে নেওয়ার এ সিদ্ধান্ত আসছে।
এব্যাপারে তথ্য অধিদপ্তরের প্রধান তথ্য কর্মকর্তা সুরথ কুমার সরকার টিবিএসকে জানিয়েছেন, চলমান বিধিনিষেধ শর্ত-সাপেক্ষে ১৫ থেকে ২২ জুলাই পর্যন্ত শিথিল করা হবে। এরপর ২৩ জুলাই থেকে আবারো কঠোর বিধিনিষেধ জারি করবে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ।
এরমধ্যে রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন জানিয়েছেন ১৫ জুলাই থেকে অর্ধেক যাত্রী নিয়ে ট্রেন চলাচল করবে।
মন্ত্রিপরিষদ সূত্র বলছে, ঈদকে সামনে রেখে শর্তসাপেক্ষে এই ৮ দিন সীমিত আকারে গণপরিবহন চলাচল ও কিছু দোকানপাঠ খোলা রাখার সিদ্ধান্ত আসতে পারে।
সবমিলিয়ে দেশের করোনাভাইরাসের পরিস্থিতি যখন ভয়াবহ, তখন সরকারের পক্ষ থেকে ১৪ জুলাইয়ের পর ঈদ উপলক্ষ্যে লকডাউন শিথিল করার প্রস্তুতিতে উদ্বেগ জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
কোভিড-১৯ বিষয়ক জাতীয় কারিগরি কমিটির সদস্য ও বিশিষ্ট ভাইরোলজিস্ট অধ্যাপক নজরুল ইসলাম টিবিএস'কে বলেন, "সংক্রমণ যেভাবে বাড়ছে, তাতে আগামী কয়েকদিনের মধ্যে পরিস্থিতি আরো খারাপ হবে। ঈদে যদি আবার আগের মতো ঢাকা থেকে মানুষ গ্রামে যায়- তাহলে গ্রামে সংক্রমণ আরো বাড়বে। এছাড়া, ঢাকায় অনেকগুলো গরুর হাট বসবে, সেখানেও সংক্রমণ ছড়াবে। ইনফেকশন রেট হাই হলে ভাইরাসের মিউটেশন হবে, সেটি মারাত্মকও হতে পারে।"
"কঠোর লকডাউন দিয়েই সংক্রমণ কমানো যাচ্ছে না, আবার সেটি শিথিল করলে তো আরো ভয়াবহ হবে। ঈদের পর পজিটিভি শনাক্তের হার ৫০ শতাংশ হতে পারে। মৃত্যু আরো বাড়ার ঝুঁকি আছে। এখনই ঢাকার বাইরের হাসপাতালগুলোতে বেড, অক্সিজেন সংকট দেখা দিয়েছে, ঈদের পর হাসপাতালগুলোর ওপর চাপ আরো বাড়বে," আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন তিনি।
তার পরামর্শ, "এখন শতভাগ মাস্ক নিশ্চিত করতে হবে। বিএসএমএমইউ- এর কনভেনশন সেন্টারে ফিল্ড হাসপাতাল হচ্ছে- এটি একটি ভালো উদ্যোগ। জেলাগুলোতেও ১০০০ আইসোলেশন বেডসহ ফিল্ড হাসপাতাল স্থাপন করতে হবে। তা নাহলে ঈদের পর আমাদের পরিস্থিতি ভারতের চেয়েও খারাপ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।"
দেশে গত কয়েকদিনের সংক্রমণের হার ৩০ শতাংশের উপরে রয়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় পরীক্ষার বিপরীতে পজিটিভ শনাক্তের হার ৩১ দশমিক ২৪ শতাংশ এবং এপর্যন্ত শনাক্তের সার্বিক হার ১৪ দশমিক ৭৫ শতাংশ। ঢাকার বাইরের জেলাগুলোয় সংক্রমণ ও মৃত্যুর সংখ্যায়ও ঊর্ধ্বগতি অব্যাহত রয়েছে।
এ বিষয়ে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) এর উপদেষ্টা ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, "সরকার যদি এখন ঈদ বা জীবন-জীবিকার কথা ভেবে সবকিছু সীমিত আকারে হলেও খুলে দিতে চায়; তাহলেও বিষয়টি নিয়ে যথেষ্ট কৌশলী হতে হবে। কোনভাবেই গত ঈদের মতো পরিস্থিতি হতে দেয়া যাবে না। তাতে করে সংক্রমণ এবং মৃত্যুর রেখা যেভাবে উঠবে- তা নিয়ন্ত্রণ করা সরকারের পক্ষে সম্ভব হবে না।"
"এই সময় চলাচলের উপর যে বিধিনিষেধ আছে, তা যদি কোনভাবে না উঠিয়ে চলমান রাখা সম্ভব হয়, তাহলে সেটা করাই ভালো। কারণ জনস্বাস্থ্য বিধি অনুযায়ী এই পরিস্তিতিতে কোনভাবেই চলাচল বাড়তে দেয়া উচিত না। গরুর হাট, বাড়ি ফেরা বন্ধ করাসহ এবার ঈদে গণ-জমায়েত সীমিত করার বিকল্প নেই,"- যোগ করেন তিনি।
বাছাই করে রোগী ভর্তি করছে হাসপাতালগুলো:
ঢাকার বাসিন্দা গোলাম আলী ফেনীর দাগনভূঁইয়া থেকে চিকিৎসা নিতে আসা তার ৩০ বছর বয়সী আত্মীয় আনোয়ার হোসেনকে নিয়ে গেল দুই দিনে (রোব ও সোমবার) রাজধানীর ৫টি হাসপাতালে ঘুরেছেন। শেষমেষ করোনা চিকিৎসার জন্য এই রোগীর ঠাঁই হয়েছে রাজধানীর মহাখালীতে অবস্থিত ডিএনসিসির করোনা হাসপাতালে।
সোমবার সকালে শেষ দফা রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল ঘুরে দুপুর ১২টা নাগাদ এই হাসপাতালে রোগী ভর্তির পর গোলাম আলী টিবিএসকে বলেন, "ফেনী থেকে আসার পর প্রথমে নিয়ে যাই ঢাকা মেডিকেলে। সেখানে কিছুসময় রেখে আমাদের অন্য হাসপাতাল খোঁজার জন্য বলা হয়। এরপর আরো দুটো প্রাইভেট এবং সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল ঘুরে এখানে এসেছি।"
"গত দুদিনে এসব করতে করতে আমাদের মোট ৩৫ হাজার টাকা শেষ। কিন্তু, বলার মতো কোন চিকিৎসা পাইনি। আজ সকালে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল থেকে এখানে আসতে অ্যাম্বুলেন্স খরচ সাড়ে তিন হাজার টাকা দিতে হয়েছে। মহামারিকালেও এসব দেখার কেউ নেই। তাছাড়া, এভাবে টানাটানিতে আমাদের রোগীর অবস্থা আরো খারাপ হয়েছে," তিনি যোগ করেন।
সোমবার রাজধানীর হাসপাতালগুলো ঘুরেও এমন চিত্রই পাওয়া গেছে। ঢাকার বাইরের রোগীর চাপ বাড়ছে। এতে করে হাসপাতালগুলোর শয্যা প্রায় শেষ হতে চলেছে। আইসিইউ সংকট তো আছেই, এরমধ্যে হাসপাতালগুলো এখন বেঁছে বেঁছে রোগী ভর্তি করছে। অগ্রাধিকার দিচ্ছে সংকটাপন্ন রোগীকে।
হাসপাতালে প্রতিনিয়ত রোগীর চাপ বাড়ায় শয্যা সংকট দেখা দিচ্ছে উল্লেখ করে ডিএনসিসি'র ডেডিকেটেড কোভিড-১৯ হাসপাতালের পরিচালক এ কে এম নাসির উদ্দিন টিবিএসকে বলেন, "এখান ৫০০ শয্যার সেবা দিয়ে যাচ্ছি। এর প্রায় পুরোটায় রোগী আছে। কিছু রোগী ছাড় পেলে ১০-২০টি শয্যা ফাঁকা থাকে। আবার রোগীতে ভরে যাচ্ছে। মূলত এখানকার ৭০ শতাংশ রোগীই ঢাকার বাইরের।"
"এখন আমরা সব রোগী ভর্তি নিতে পারছি না। প্রতিদিন যেভাবে রোগী আসছে তাতে শয্যা বাড়াতে হচ্ছে। এলক্ষ্যে ২৫০টি শয্যা প্রস্তুত করার কাজে হাত দিয়েছি। আইসিইউ সেবার বাইরে আমাদের এখানকার সব বেডেই অক্সিজেন লাইন আছে। নতুন প্রস্তুত করা বেডগুলোতেও অক্সিজেন লাইন থাকবে।"
সিলেট থেকে করোনা চিকিৎসা নিতে আসা রাহেলা খাতুন (৩৫) দুইদিন ভর্তি আছেন রাজধানীর আসগর আলী হাসপাতালে। অবস্থার অবনতি হওয়ায় তার স্বজনরা তাকে ঢাকা মেডিকেলে স্থানান্তরের চেষ্টা করেন। কিন্তু সেখানে সফল না হওয়ায় এসেছিলেন মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে।
রাহেলার চাচাতো ভাই আজিম উদ্দিন টিবিএসকে বলেন, "আসগর আলীতে দুই দিনে রোগীর অবস্থার কোন পরিবর্তন হয়নি। এরমধ্যে আমাদের ৮৫ হাজার টাকা বিল এসেছে। এত ব্যয় আমাদের পক্ষে ম্যানেজ করা সম্ভব না। তাছাড়া রোগীর অবস্থা যেহেতু খারাপ তাই আমরা অন্যত্র স্থানান্তরের চিন্তা থেকে এখানে নিয়ে এসেছি।"