সায়মন ড্রিং: বাংলাদেশে টেলিভিশন সাংবাদিকতার জনক
৭৫ বছর এমন কোনো বয়স না- বিশেষ করে সায়মন ড্রিং এর মতো লড়াকু ব্রিটিশ সাংবাদিকের জন্য। তবু তিনি হেরে গেলেন, পেটের একটি অপারেশন করতে হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিরতরে চোখ বন্ধ করলেন হাজারো তরুণের চোখে স্বপ্ন বুনে দেওয়া কিংবদন্তী সাংবাদিক সায়মন ড্রিং।
একাত্তরে বাংলাদেশে এসেছিলেন লন্ডনের গার্ডিয়ান পত্রিকার তরুণ রিপোর্টার হিসেবে। ২৫ মার্চের কালরাত্রির আগে থেকেই পাক সেনারা সব বিদেশি সাংবাদিকদের ঢাকা ছাড়তে বাধ্য করেন। হোটেল থেকে আর্মির ট্রাকে করে এয়ারপোর্টে নিয়ে তাদেরকে প্লেনে তুলে দেওয়া হয়। কিন্তু সায়মন ড্রিং এবং একজর ফরাসী ফটোসাংবাদিক সেদিন পাক সেনাদের চোখ এড়িয়ে লুকিয়ে থাকেন ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলের ছাদের পানির ট্যাংকে। এসময় তাদের সহায়তা করেন হোটেলের বাংলাদেশি কর্মচারীরা।
তারা থেকে যান ঢাকায়। দেখেন পাক বাহিনীর গণহত্যা, গার্ডিয়ানে তার রিপোর্টের মাধ্যমে বিশ্ব জানতে পারে বাংলাদেশে পাকিস্তানী সেনাদের গণহত্যার খবর। সেই থেকে বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু তিনি। মুক্তিযুদ্ধ শেষে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশে ফিরে এলে বেশ কয়েকবার জাতির পিতার সাক্ষাতকারও নেন সায়মন। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গেও ঘনিষ্ঠতা হয়েছিলো সায়মনের।
পরবর্তীকালে ওয়ার করেসপন্ডেন্ট হিসেবে যোগ দেন লন্ডনে বিবিসি টেলিভিশনে। ভিয়েতনাম যুদ্ধসহ বিশ্বের বিভিন্ন যুদ্ধের সংবাদ সংগ্রহ করে তিনি হয়ে ওঠেন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন টিভি ব্যক্তিত্ব। টেলিভিশনের সেই অভিজ্ঞতা নিয়ে ২০০০ সালে বাংলাদেশে এসে শুরু করেন একুশে টেলিভিশন, দেশের প্রথম বেসরকারি টেরিস্ট্রিয়াল টেলিভিশন। তাঁর হাতেই তৈরি হয় এদেশের প্রথম পেশাদার এবং সফল টেলিভিশন সাংবাদিক প্রজন্ম। গত দুই দশক ধরে যারা এদেশে টেলিভিশন সাংবাদ পরিচালনা করছেন, তাদের অধিকাংশই সায়মন ড্রিং এর হাতে তৈরি।
একুশে টেলিভিশনের সে সময়ের তুমুল জনপ্রিয়তা, সাফল্য এবং গ্রহণযোগ্যতার পেছনে অন্যতম কারণ ছিলো সায়মন ড্রিং এর পেশাদারিত্ব এবং যোগ্য নেতৃত্ব। আমিসহ তার টিমের প্রতিটি সাংবাদিককে তিনি নিজের সন্তানের মতো করে হতে ধরে কাজ শেখাতেন, পরামর্শ দিতেন, ভুল ধরতেন এবং তা সংশোধন করে দিতেন। নিয়মানুবর্তিতায় সায়মনের ধারে কাছে কেউ ছিল না আমাদের টিমে। তিনি সবার আগে অফিসে আসতেন, কখনো কখনো সকাল সাতটায় টেলিফোন অপারেটর আসার আগে তিনি অফিসে আসতেন এবং পিএবিএক্সে রিং বাজলে ফোন ধরে ভাঙা ভাঙা বাংলায় বলতেন "আসসালাসু আলাইকুম, একুশে টেলিভিশন, কাকে চান?"
তার সঙ্গে আমার প্রায় তিন বছর কাজ করার সুযোগ হয়েছে একুশে টেলিভিশনে। বিএনপি-জামাত সরকার ক্ষমতায় এসে ২০০২ সালে হাইকোর্টের মামলার মাধ্যমে একুশে টিভির সম্প্রচার বন্ধ করে দেয়। সায়মন ড্রিং এর ওয়ার্ক পারমিট বাতিল করে তাকে দেশত্যাগে বাধ্য করা হয়। তাঁকে বিদায় জানাতে সেদিন আমিও গিয়েছিলাম এয়ারপোর্টে। প্লেনে ওঠার আগে কান্নজড়িত কণ্ঠে সায়মন বলেছিলেন, "প্রথমবার পাকিস্তানী সেনাবাহিনী এই দেশ থেকে আমাকে তাড়াতে পারেনি, আর এবার কিনা বিনা দোষে স্বাধীন বাংলাদেশের সরকার আমাকে এভাবে বের করে দিল?" সায়মনের এই কথা এখনো আমার কানে কাাঁটার মতো বিঁধে।
এই ঘটনার ১০ বছর পর কিছুটা হলেও তাঁর ঋণ শোধ করেছে বাংলাদেশ। মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ অবদানের জন্য ২০১২ সালে সরকার তাঁকে মুক্তিযুদ্ধ মৈত্রী সম্মাননা জানায়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর হাতে তুলে দেন সেই সম্মাননা স্মারক।
এখন বাংলাদেশে আজ এত এত টেলিভিশন চ্যানেল, এই চ্যানেলগুলোর বার্তা বিভাগে গত ২০ বছর ধরে যারা শীর্ষ কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করছেন; তাদের অধিকাংশই সায়মন ড্রিং এর হাতে তৈরি, তার একুশে টিভির নিউজ টিমের সদস্য। বাংলাদেশের টেলিভিশন সাংবাদিকতাও তাই সায়মন ড্রিং এর কাছে দারুণভাবে ঋণী।
এ প্রসঙ্গে কথা উঠলেই সায়মন বলতেন, টেলিভিশনে সাফল্যের সবচেয়ে বড় বিষয় হলো প্রশিক্ষণ। যে টেলিভিশন চ্যানেল তার সাংবাদিক ও কর্মীদের যত ভালো প্রশিক্ষণ দেবে- তারা ততো ভালো করবে। সরকারের জন্য পরামর্শ হিসেবে তিনি বলতেন, লাইসেন্স দেওয়ার ক্ষেত্রে নীতিমালা থাকা উচিত। কেউ চাইলেই তাকে টিভি লাইসেন্স দেওয়া উচিত না। ব্যবসায়ী স্বার্থ বা কর্পোরেট স্বার্থে চ্যানেল করলে কখনো তা পেশাদার হতে পারে না।
২০১৪ সালে আরেকবার বাংলাদেশে এসেছিলেন সায়মন। যমুনা গ্রুপের প্রয়াত চেয়ারম্যান নুরুল ইসলাসম বাবুলের অনুরোধে যমুনা টেলিভিশনে কনসালট্যান্ট হিসেবে যোগ দেন তিনি। সেখানে এক বছর কাজ করে গুছিয়ে দেন ২৪ ঘন্টার নিউজ চ্যানেল যমুনা টিভিকে।
২০১৫ সালে তিনি চলে যান স্ত্রী ফিয়োনা, দুই শিশু জমজ কন্যা ইন্ডিয়া রোজ এবং আভা রোজের কাছে, অস্ট্রেলিয়ায়। গতবছর করোনা মহামারি শুরুর পর সপরিবারে চলে যান রোমানিয়ায় তার খামার বাড়িতে। পেটের কোনো এক সমস্যায় হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে হাসপাতালে নেওয়া হয়, গত ১৬ জুলাই শুক্রবার সেখানে তাঁর মৃত্যু হয়।
আমার সাথে সায়মনের সবশেষ কথা হয় গত ২৫ জুন। আমাকে বলেছিলেন, তাঁর একটি পরিকল্পনার কথা। তাঁর ইচ্ছা ছিলো বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী উপলক্ষ্যে এদেশের গ্রামের মানুষের জীবনমানের উন্নতি, দেশের অবকাঠামো উন্নয়ন এবং বাংলাদেশের সাফল্য নিয়ে আন্তর্জাতিক দর্শকদের জন্য একটি টিভি অনুষ্ঠান নির্মাণের। একাজে আমি তাকে কীভাবে সাহায্য করতে পারবো সে বিষয়ে আমাদের কয়েক দফা কথাও হয়েছে। কিন্তু, হঠাৎ করেই সোমবার সকালে লন্ডনের সাংবাদিক সৈয়দ নাহাস পাশার ফেসবুক স্ট্যটাসের মাধ্যমে জানতে পারি এই ভয়াবহ দু:সংবাদ।
সায়মন ড্রিং এর মৃত্যুর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ তাঁর এক অকৃত্রিম বন্ধুকে হারালো। আর আমরা যারা বাংলাদেশে টেলিভিশন সাংবাদিকতা করি, আমরা হারালাম আমাদের সাংবাদিকতার গুরু, পিতৃসম অভিভাবককে, যার কাছে আমাদের আজন্ম ঋণ।
- লেখক: প্রধান নির্বাহী সম্পাদক, এটিএন বাংলা