‘টপ সয়েল’ কেটে কৃষির বিনাশ, বগুড়ায় ১০ বছরে কমেছে ১,১৫২ হেক্টর কৃষিজমি
শস্যভাণ্ডার খ্যাত বগুড়ায় গত ১০ বছরের ব্যবধানে প্রায় এক হাজার ১৫২ হেক্টর কৃষিজমি কমে গেছে। গত বছরেও কমেছে অন্তত ৮০ বিঘা জমি। ফসলি জমি থেকে অবৈধভাবে মাটি কাটা, বালু উত্তোলন ও বসতির কারণে এই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। এই হিসাব কৃষি অফিসের। তবে মাটি রক্ষা আন্দোলনের নেতারা বলছেন, ক্ষতিগ্রস্ত ফসলি জমির পরিমাণ আরও বেশি হবে।
কৃষি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ফসলি জমির উপরিভাগের ১০-১৫ ইঞ্চির মধ্যে উর্বরতা শক্তি থাকে। তাই এসব মাটি খুঁড়ে বিক্রি করার ফলে তা পুনরায় ফিরে আসতে ২৫-৩০ বছর সময় লাগে। আর বারবার তা খোঁড়া হলে এসব জমি ফসল উৎপাদনে স্থায়ীভাবে একেবারে অক্ষম হয়ে পড়ে।
শাজাহানপুর উপজেলার সুজাবাদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পূর্ব দিকে মাটির সড়ক দিয়ে ট্রাকে করে কৃষি জমির মাটি লুট হয়েছে। এখানে প্রায় শতাধিক বিঘা কৃষি জমি এখন পুকুর। সেখানেও পানি থাকে না। চুক্তি অনুযায়ী খোঁড়ার কারণে এসব জমি এখন পরিত্যক্ত।
এই এলাকায় কৃষি জমি রক্ষায় দীর্ঘদিন ধরেই আন্দোলন করছেন স্থানীয় জনগণ। সুজাবাদ মাটি ভূমি রক্ষা কমিটির সভাপতি ও ইউপি সদস্য আবু জাফর এলাকার ফসলি জমি রক্ষার জন্য সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে চিঠিও দিয়েছেন। তবে তার মধ্যেই প্রায় শতাধিক বিঘা জমির মাটি লুট হয়েছে।
তিনি বলেন, "গত কয়েক বছরে এলাকায় অন্তত ১০০ বিঘা কৃষি জমির মাটি লুট হয়েছে। এসব জমিতে মাছ চাষও হচ্ছে না। বালু আর বালু। পতিত জমি হয়ে যাচ্ছে। এই জায়গার কোনো মূল্যই নেই। কৃষক এখনো আমাদের প্রাণ। বিকল্প ইটভাটা ও ইটের ব্যবস্থা করতে হবে। ভাটার কারণে মানুষের শ্বাসকষ্ট হচ্ছে ব্যাপকভাবে। কয়লা পোড়া গন্ধ প্রতিনিয়ত মানুষকে পোড়াচ্ছে"।
বগুড়ার বিভাগীয় পরিবেশ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, জেলায় ২৪১টি ইটভাটা রয়েছে। এর মধ্যে বৈধ ১৭টি। আর অবৈধ ইটভাটা রয়েছে ২২৪টি। এসব ইটভাটায় মাটি দেওয়ার জন্যই মূলত কৃষি জমি নষ্ট হচ্ছে।
শাজাহানপুর থেকে মাটি লুটের কারণ অবৈধ ৩৭ ইটভাটা। এসব ভাটায় ফসলি জমির উপরিভাগের মাটি দিয়ে ইট বানানো হচ্ছে। স্থানীয়দের অভিযোগ, প্রতি বছর এই মাটি ব্যবসায়ী চক্রের হাতে শতাধিক বিঘা ফসলি খালে পরিণত হচ্ছে। মাটি ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, লোভ দেখিয়ে কৃষকদের কাছ থেকে প্রতি শতক জমি ব্যবসায়ীরা কেনেন ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকায়। এই জমি ৮ থেকে ১৫ ফুট গভীর করে মাটি কাটার চুক্তি করা হয়। এবার প্রতি ট্রাক লাল মাটি ইটভাটায় বিক্রি করা হচ্ছে ৪০০ টাকা করে। তবে সাদা মাটির দাম বেশি। এই মাটি প্রতি ট্রাক বিক্রি করা হয় ৯০০ থেকে ১ হাজার টাকায়। আট ফুট গভীর করলে এক শতক জমি থেকে ৩২ ট্রাক মাটি কেটে নেওয়া যায়।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শাজাহানপুর উপজেলার খোট্টপাড়া ইউনিয়নে খাউড়া ও খলিশাকান্দি, চুপিনগর ইউনিয়নের বৃ-কুষ্টিয়া, আশেকপুর ইউনিয়নের চকজোড়া, খড়না ইউনিয়নের কলমাচাপর গ্রামে কৃষি জমি থেকে মাটি কেটে নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে খাউড়া, খলিশাকান্দি, বৃ-কুষ্টিয়া থেকে রাতের বেলায় মাটি লুট হয়। এসব মাটির বেশিরভাগই যায় ইটভাটায়।
উপজেলার ছয়টি ইউনিয়নের অন্তত ৩০ জন কৃষকের কথা বলে জানা গেছে, এসব এলাকার কৃষিজমি থেকে বছরের পর বছর মাটি কেটে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। ভাটা মালিকেরা নানা প্রলোভনে কৃষি জমি পুকুরে পরিণত করেছেন। পাশের জমির মাটি কেটে খাদে পরিণত করায় অন্য জমিওয়ালা কৃষি জমির মাটি বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন। প্রশাসনের বিভিন্ন দপ্তরে লিখিত অভিযোগ করেও কোনো প্রতিকার মিলে না। বাসিন্দাদের অভিযোগ, প্রশাসন টাকার কাছে বিক্রি হয়ে গেছে। মাটি ব্যবসায়ীরা প্রভাবশালী হওয়ায় ভয়ে কৃষকরা প্রকাশ্যে প্রতিবাদ করতে চান না।
শাজাহানপুরের খোট্টাপাড়া ইউনিয়নের খলিশাকান্দি গ্রামে কৃষি জমিতে তিন বছর বছর আগে 'টপ' নামের একটি ইটভাটা নির্মাণ করা হয়েছে। এই ইটভাটার উত্তর পাশেই ২ বিঘা কৃষি জমি গভীরভাবে খনন করে মাটি বিক্রি করা হয়েছে। এই জমি থেকে মাটি বিক্রি করছেন স্থানীয় ব্যবসায়ী নুরুল ইসলাম।
টপ ইটভাটার পাশের দুই বিঘার বেশি কৃষি জমি থেকে মাটি কেটে প্রায় ১০ থেকে ১২ ফুট গভীর করা হয়েছে। কোথাও এর চেয়ে বেশি গভীর করে মাটি তোলা হচ্ছে। এই জমির তিনপাশেই হচ্ছে সোনালি ধান।
ফসলি জমি থেকে মাটি কাটার সঙ্গে জড়িত নুরুল ইসলাম জানান, তিনি এই জমি সাজু নামের এক ব্যক্তির কাছ থেকে কিনে নিয়েছেন। এই জমিতে তিনি পুকুর খনন করবেন। এখানে মাটি কাটার কারণে অন্য কোনো কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হবেন না বলে দাবি তার।
যদিও এখানে কৃষি জমি পুকুর হওয়ার পর প্রশাসন রাতের বেলায় একটি ভ্রাম্যমাণ অভিযান চালায়। এরপর সেখানে ফের চলেছে মাটি কাটার কাজ।
বগুড়া-ঢাকা মহাসড়কের পশ্চিমে প্রায় ১ কিলোমিটার দূরে কৃষি জমির মাটি কেটে গভীর করা হয়েছে। স্থানীয় কৃষক আবদুর রশিদের একটি জমি থেকে ১০ ফুট গভীর করে মাটি কাটা হয়েছে। এতে পাশের জমিগুলো ভেঙে গেছে। ওই জমির আইল ঘেঁষে রয়েছে একই গ্রামের মঞ্জুরুল আলমের ৪০ শতাংশ জমি। এই জমির অর্ধেক অংশে তিনি মরিচের চাষ করেছেন।
মঞ্জুরুল আলম বলেন, মাটি কাটার কারণে কয়েক বছরে এই এলাকায় কয়েক ডজন ফসলি জমি এখন চাষাবাদের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। তার জমির দুই পাশে ১০ ফুট গভীর করে মাটি কাটা হয়েছে। এখন তিনি শঙ্কায় রয়েছেন, কবে যেন তার জমিও ভেঙে যায়। তাকেও মাটিদস্যুরা চাপ দিচ্ছেন তাদের কাছে মাটি বিক্রি করার জন্য।
উপজেলায় মাটি ব্যবসায়ী মালিক সমিতির সভাপতি নুরুজ্জামান। জানতে চাইলে তিনি মুঠোফোনে বলেন, "কোনো কৃষি জমি থেকে মাটি কাটার নিয়ম নেই। পতিত কোনো জমি থেকে মাটি কাটতে হবে। কেউ কেটে থাকলে তার বিরুদ্ধে প্রশাসন ব্যবস্থা নিক। আমি সর্বাত্মক সহযোগিতা করব। কৃষি জমি থেকে কোনো মাটি কাটা হবে না।"
টপ সয়েল কাটার তথ্য জানতে শাজাহানপুর উপজেলার কৃষি কর্মকর্তা মো. নুরে আলমকে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি ধরেননি। তবে কিছুদিন আগে তিনি বলেছিলেন, "জমির উপরিভাগ কেটে নেওয়া হলে উর্বরতা শক্তি নষ্ট হয়ে যায়। বেশি গভীর করে কেটে নিলে ওই জমি শক্তি পুরোপুরি নষ্ট হয়ে যায়। তবে শাজাহানপুরে কৃষি জমি কাটার বিষয়ে কোনো তথ্য আমাদের কাছে নেই"।
মাটি ও বালুখেকোরা একের পর এক ফসলি জমি লিজ নিয়ে মাটি কেটে ও বালু উত্তোলন করায় ফসলি জমির সর্বনাশের চিত্র জেলার ১২টি উপজেলাতেই। এদের বিরুদ্ধে প্রশাসনের তরফ থেকে মাঝেমধ্যে অভিযান চালানো হয়। শিবগঞ্জ উপজেলার গুজিয়া, উত্তর শ্যামপুর, অর্জুনপুর, কিচকসহ বেশ কয়েকটি এলাকায় ফসলি জমি থেকে মাটি কাটার পর ওই জমির গর্ত থেকে অবৈধভাবে বালু তুলছিলেন আবদুল কুদ্দুস, রফিকুল ইসলাম ও লেমন। ৫ মে শিবগঞ্জ উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) মৌলী মণ্ডল সেখানে ভ্রাম্যমাণ অভিযান চালান। অভিযোগ রয়েছে, সপ্তাহের ব্যবধানে সেখানে ফের বালু উত্তোলন শুরু হয়েছে।
বালুমহাল ও মাটি ব্যবস্থাপনা আইনে গত পাঁচ মাসে শেরপুর উপজেলা সহকারি কমিশনার (ভূমি) সাবরিনা শারমিন ১৫টি মামলা করেছেন। এসব মামলায় জরিমানা করা হয়েছে সাত লাখ টাকার উপরে।
বগুড়ার মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইন্সটিটিউটের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা (আঞ্চলিক গবেষণাগার) আমিনুল ইসলাম বলেন, "টপ সয়েলে জৈব পদার্থ থাকে। এটি কেটে নেওয়ার ফলে মাটির পানি ধারণ ক্ষমতা কমে যায়। মাটির উর্বরতা শক্তি নষ্ট হয়। উৎপাদন ক্ষমতা ব্যাহত হয়। মাটি কাটা হলে চাষাবাদে ভয়ংকর প্রভাব পড়ে। এ অবস্থা থেকে স্বাভাবিকরূপে ফিরে আসতে মাটির ২৫ থেকে ৩০ বছর সময় লাগে"।
জেলা কৃষি বিভাগ জানায়, শস্যভাণ্ডার খ্যাত এ জেলায় ২ লাখ ২৪ হাজার হেক্টর জমিতে আবাদ হয়ে থাকে। বাড়িঘর নির্মাণ ছাড়াই আশঙ্কাজনকহারে শুধু আবাদি জমির মাটি কেটে গর্ত করায় এবং ওই গর্ত থেকে বালু উত্তোলন করায় ফসলি জমি কমেছে। কৃষি বিভাগের তথ্যানুযায়ী, জেলায় গত ৫ বছরে ১ হাজার ৯৫২ হেক্টর জমির আবাদ কমে গেছে।
জেলা কৃষি উপপরিচালক দুলাল হোসেন বলেন, "বগুড়ার মতো কৃষি উর্বর একটি জেলার জমি এভাবে কমে যাওয়া ভয়ংকর ইংগিতবাহী। এই বিষয়ে সচেতনতা গড়ে তুলতে হবে। ফসলি জমি বাঁচাতে হবে। তাহলেই বাঁচবে মানুষ, বাঁচবে দেশ"।