জাপানের দর্শনীয় অলিম্পিক ভেন্যুগুলো
আপনার মধ্যে ভ্রমণের আকাঙ্ক্ষা জাগানোর জন্য টিভিতে অলিম্পিক দেখার চেয়ে ভালো কিছুই হতে পারে না। দর্শকদেরকে নিষিদ্ধ করার ফলে এবার অলিম্পিকের স্টেডিয়ামগুলো বেশিরভাগই ফাঁকা ছিলো। তবুও জাপানের সুন্দর দৃশ্যপটের পাশাপাশি বিশ্বজুড়ে আসা ক্রীড়াবিদরা আমাদেরকে বিস্মিত করেছে।
তবে খুশির খবর হলো, টোকিও ২০২০ অলিম্পিকের জন্য নির্মিত অনেক বিশেষ অবকাঠামো আসর শেষ হওয়ার পরও সেখানে থাকবে, দেশের সীমানা খুলে যাওয়ার পর আপনি গিয়ে দেখতেও পারবেন আপনার প্রিয় ক্রীড়াবিদরা কোথায় স্বর্ণ জেতার প্রতিযোগিতা নেমেছিল।
অলিম্পিক এবং প্যারালিম্পিকের বেশিরভাগ ইভেন্ট রাজধানী ও এর আশেপাশেই অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এবারের আয়োজনে নির্মিত বেশ কয়েকটি কাঠামো অস্থায়ী। তবে আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটির (আইওসি) মতে, গেমসের জন্য তৈরি করা নতুন কাঠামোর অধিকাংশই জাপানের জনগণের উপকারের জন্য ব্যবহার করা হবে।
জাপান ন্যাশনাল স্টেডিয়াম
টোকিওর বিখ্যাত শিনজুকু এলাকার এই স্টেডিয়াম অলিম্পিকের উদ্বোধনী এবং সমাপনী অনুষ্ঠানের পাশাপাশি বেশিরভাগ ট্র্যাক ও ফিল্ড ইভেন্টের আয়োজক। ২০১৬ সালে ভেঙে ফেলার আগের একটি জাতীয় স্টেডিয়ামের জায়গায় এটি প্রতিস্থাপন করা হয়।
বিশ্বখ্যাত স্থপতি এবং টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্যবিদ্যার অধ্যাপক কেঙ্গো কুমা গেমসের কেন্দ্রবিন্দু হওয়ার উদ্দেশ্যে নির্মিত নতুন এ আইকনটির নকশা করেছিলেন। স্টেডিয়ামটির দর্শক ধারণক্ষমতা ৬৮ হাজার। এটি জাপানের ৪৭ টি অঞ্চলের ৪৬টি অঞ্চলে থেকে নিয়ে আসা কাঠ দিয়ে তৈরি।
গেমসের এই ভেন্যুতে ইতিহাস তৈরির মুহূর্তের কোনো অভাব ছিলো না। এর মধ্যে আবেগপ্রবণ হাই জাম্প ফাইনালও রয়েছে যেখানে ইতালির জিয়ানমারকো তাম্বেরি এবং কাতারের মুতাজ এসা বারশিম একত্রে অলিম্পিক স্বর্ণপদক জিতেছেন।
এ স্টেডিয়ামের দুর্দান্ত দৃশ্যের জন্য শিবুয়া স্ক্র্যাম্বল স্কোয়ার বিল্ডিংয়ের শিবুয়া আকাশ পর্যবেক্ষণ ডেকের দিকে যেতে হবে।
আরিয়াকে অ্যারেনা
দক্ষিণ-পশ্চিম টোকিওতে অবস্থিত এই ভবনটি টোকিও ২০২০ অলিম্পিকের সময় সব ভলিবল ম্যাচ আয়োজন করেছিলো। গত রোববার গেমসের শেষ দিনে, টিম ইউএসএ এর মহিলা ভলিবল দল ব্রাজিলকে পরাজিত করে স্বর্ণপদক পেয়ে ইতিহাস সৃষ্টি করে। গেমস শেষ হয়ে গেলে অ্যারেনাটি একটি স্থানীয় কমিউনিটি সেন্টার এবং ১২ হাজার দর্শকের ধারণক্ষমতা সম্পন্ন ইভেন্ট ভেন্যু হিসেবে কাজ করবে।
মুসাশিনো ফরেস্ট স্পোর্ট প্লাজা
টোকিওর পশ্চিম শহরতলির চফু-তে অবস্থিত এই অ্যারেনাটি ছিল টোকিও অলিম্পিকের জন্য উদ্দেশ্যপূর্ণভাবে তৈরি প্রথম ভেন্যু।
৩০ হাজার বর্গমিটার (৩ লাখ ২৩ হাজার বর্গফুট) এলাকা জুড়ে মুসাশিনো ফরেস্ট প্লাজার একটি ঝুলন্ত রূপালী ও সাদা ছাদ রয়েছে। এটি গেমসের সময় ব্যাডমিন্টন ও আধুনিক পেন্টাথলন ইভেন্টের আয়োজন করেছিলো। এখানের ব্যাডমিন্টন কোর্টে চীন আধিপত্যই দেখা যায়, দুটি স্বর্ণসহ ছয়টি পদক জেতে।
গেমসের পরে টোকিওর কর্মকর্তারা বলেছেন যে এটি একটি বহুমুখী ভেন্যু হিসেবে কাজ করবে যেখানে প্রধান ক্রীড়া প্রতিযোগিতা এবং বিনোদন ইভেন্ট অনুষ্ঠান হবে।
বোনাস: এটি বিখ্যাত স্টুডিও জিবলি মিউজিয়ামের কাছেই অবস্থিত।
টোকিও অ্যাকুয়াটিকস সেন্টার
২০২০ গেমসের জন্য বিশেষভাবে নির্মিত টোকিও অ্যাকুয়াটিকস সেন্টার টাটসুনামি-নো-মোরি সি-সাইড পার্কের ভেতর অবস্থিত। এই জনপ্রিয় স্থানটিতে স্থানীয়রা মিনি গলফ খেলতে পারে, উপভোগ করতে পারে শরতের পরিবেশ।
জায়গাটির নাম দেখে বোঝা যায়, গেমস চলাকালীন ডাইভিং এবং সাঁতারের মত জলকেন্দ্রিক অনেক খেলা এখানে অনুষ্ঠিত হয়েছিলো। এসবের মধ্যে ইতিহাস তৈরির মত অনেক মুহূর্তও ছিলো।
পুরুষদের ৪X১০০ মিটার মেডলে রিলে ফাইনালে টিম ইউএসএ টোকিও অ্যাকুয়াটিকস সেন্টারে বিশ্ব রেকর্ড ভেঙে স্বর্ণ জিতে নেয়।
এদিকে স্বল্প ও দীর্ঘ দূরত্বের ইভেন্টগুলোতে প্রতিযোগিতা করতে সক্ষম আমেরিকান সাঁতারু কেটি লেডেকি একজন ক্রীড়াবিদ হিসেবে পুনরায় তার মর্যাদা নিশ্চিত করেছেন। লেডেকি টোকিওতে ১৫০০ মিটার ও ৮০০ মিটার ফ্রিস্টাইল সোনা এবং ৪০০ ও ৪X২০০ মিটার ফ্রিস্টাইলে রূপা জিতেছেন। তিনি এখন তিনটি অলিম্পিক গেমসে ১০ টি পদক জিতেছেন।
অলিম্পিকের পর টোকিও অ্যাকুয়াটিকস সেন্টার ইভেন্টগুলো হোস্ট করা অব্যাহত রাখবে এবং সেখানকার বাসিন্দাদের জন্য সাঁতারের সুবিধা হিসেবেও কাজ করবে।
সি ফরেস্ট ওয়াটারওয়ে
রোয়িং এবং ক্যানোয়িং ইভেন্টগুলোর আবাসস্থল এ জায়গাটি টোকিও উপসাগরে দুটি মানবসৃষ্ট দ্বীপের মধ্যবর্তী খালে নির্মাণ করা হয়েছিলো।
গেমসের পর এটি আন্তর্জাতিক রোয়িং এবং ক্যানো প্রতিযোগিতার আয়োজন অব্যাহত রাখবে এবং বিনোদন এলাকা হিসেবে জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করবে।
এ বছরের গেমস চলাকালীন পর্দায় থাকা একটি সাধারন চিত্র টোকিও গেট ব্রিজ দেখার মাধ্যমে দর্শনার্থীরা খেলা শেষ হওয়ার সময় জানতে পারবে।
ওআই হকি স্টেডিয়াম
সুমিদা নদীর পাশে ওআই সেন্ট্রাল সি-সাইড পার্ক স্পোর্টস ফরেস্টের ভেতর অবস্থিত এবং মাঠের হকির জন্য বাঁকানো বৈদ্যুতিক নীল কৃত্রিম টার্ফ টিভিতে যেমন সুন্দর দেখায়, বাস্তবেও তা সেরকমই আকর্ষণীয়।
স্থানীয়রা এ পার্কটিকে সূর্যাস্তের দৃশ্যের জন্য পছন্দ করে। কর্মকর্তারা বলেছেন, অলিম্পিকের জন্য বিশেষভাবে তৈরি এ ভেন্যুটি ২০২০ গেমসের পর হকি, ফুটসাল এবং অন্যান্য খেলার জন্য ব্যবহৃত হবে।
নিপ্পন বুদোকান
চিওদা ওয়ার্ডের জুডো ভেন্যু ছিলো টোকিও অলিম্পিকের জন্য বিশেষভাবে নির্মিত। ১৯৬৪ সালে প্রথমবার টোকিও গেমস আয়োজন করার সময় এ ভেন্যুটি নির্মিত এবং সাধারণভাবে এটি বুদোকান (অর্থ- মার্শাল আর্ট হল) হিসেবে উল্লেখিত।
তারপর থেকে এটি জাপানে আসা সঙ্গীতশিল্পীদের জন্য একটি জনপ্রিয় জায়গা হয়ে ওঠে।
এবারের গেমসে এটি কারাতে অলিম্পিক অভিষেকের স্থান হওয়ার গৌরব অর্জন করে।
জাপানের রিও কিয়ুনা গত ৬ আগস্ট পুরুষদের কাটা ইভেন্টে প্রথম স্বর্ণপদক পেয়ে অলিম্পিক ইতিহাসে নিজের নাম লেখান।
দ্য অলিম্পিক অ্যান্ড প্যারালিম্পিক অ্যাথলেটস ভিলেজ
টোকিওর হারুমি জেলায় ৩৩ একর জুড়ে অবস্থিত এ ভেন্যুটি খেলার ইভেন্টগুলো শেষ হওয়ার পর নতুন জীবন পাবে।
বহুল আলোচিত পিচবোর্ডের বিছানাগুলো এখান থেকে সরিয়ে ফেলা হবে এবং পুর কমপ্লেক্সটিকে অ্যাপার্টমেন্টে বদলে ফেলা হবে। অলিম্পিক মুখপাত্রের মতে, এখানে ৫,৬৫০ টি আবাসিক ইউনিট থাকবে বিক্রির জন্য।
টোকিও ছাড়িয়ে...
সুরিগাসাকি সার্ফিং বিচ
প্রতিবেশী চিবা প্রদেশের সুরিগাসাকি তার প্রাকৃতিক পরিবেশ এবং টোকিওর কাছাকাছি হওয়াতে টোকিও অলিম্পিকে প্রথমবারের মত সার্ফিং আয়োজন করা হয়েছিলো এ ভেন্যুতেই।
এখানেই যুক্তরাষ্ট্রের ক্যারিসা মুর উদ্বোধনী নারী অলিম্পিক সার্ফিং চ্যাম্পিয়ন হয়ে ইতিহাস রচনা করেন।
সুরিগাসাকি ইতোমধ্যে জাপান ও সারা বিশ্বের সার্ফারদের কাছে ব্যাপকভাবে জনপ্রিয়। যারা তাদের নিজস্ব সার্ফিং ছুটির পরিকল্পনা করতে চান তাদের জন্য প্রচুর হোটেল, রেস্তোরাঁ ও সার্ফের দোকান রয়েছে এখানে।
মাকুহারি মেসে
২০২০ টোকিও গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিকের সময় মাকুহারি মেসে অনুষ্ঠিত ইভেন্টগুলির মধ্যে তায়কোয়ান্দো, রেসলিং অ ফেন্সিং ছিলো। চিবা প্রদেশের এ কনফারেন্স সেন্টারটি লেডি গাগা কনসার্ত থেকে শুরু করে বিশাল পোকেমন কার্ড সোয়াপের মত বিশ্বব্যাপি ইভেন্টের আয়োজন নিয়মিতভাবে করে।
গত ৬ আগস্ট এ ভেন্যুতেই পুরুষদের ১২৫ কিলোগ্রামের ফাইনালে টিম ইউএসএ এর গ্যাবল স্টিভসন জর্জিয়ার জেনো পেট্রিয়াশভিলিকে পরাজিত করে স্বর্ণপদক জিতে নেন।
এনোশিমা ইয়ট হারবার
১৯৬৪ এর প্রথম টোকিও গেমসের পাল তোলা ইভেন্টগুলোর জন্যে নির্মিত কানাগাওয়া প্রদেশের এ ভেন্যুটি এই বছরও গেমসের আয়োজন করে।
এছাড়া, উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের আগে এখানেই অলিম্পিকের কড়াটি সংরক্ষিত করা হয়েছিলো। গেমসের পরে এটি জল ক্রীড়া উৎসাহীদের গন্তব্য হিসেবে চালু থাকবে।
সাইতামা সুপার অ্যারেনা
একটি রূপান্তরযোগ্য গম্বুজ দিয়ে আবৃত এ ভেন্যুটি জাপানের বৃহত্তম ও বহুমুখী ভেন্যুগুলোর মধ্যে একটি। খেলাধুলা ছাড়াও এখানে কনসার্ট, কনফারেন্স এবং অন্যান্য ইভেন্টের আয়োজন করা হয়।
টোকিওর উত্তরে প্রতিবেশি সাইতামা প্রদেশে অবস্থিত এ ভেন্যুটিতে শনিবার টিম ইউএসএ ফরাসি পুরুষদের বাস্কেটবল দলকে পরাজিত করে।
একইসাথে টিম ইউএসএ এর নারীরা শেষ দিনের ফাইনাল ম্যাচে জাপানকে হারিয়ে এখানে স্বর্ণপদক জিতেছে। এই জয়টি ডব্লিউএনবিএ তারকা সিয়াটল স্টর্মের স্যু বার্ড। ফিনিক্স মার্কারির ডায়ানা তাওরাসি অলিম্পিকের ইতিহাসে যে কোনো দলীয় খেলায় পাঁচটি স্বর্ণপদক জেতা প্রথম ক্রীড়াবিদ হলেন এর মধ্য দিয়ে।
সাইতামা স্টেডিয়াম
২০০২ সালে বিশ্বকাপ আয়োজন করা জাপানের সবচেয়ে বড় ফুটবল স্টেডিয়াম হিসেবে এ ভেন্যুটি অলিম্পিক ফুটবল গেমস আয়োজনের জন্য ছিল অসাধারণ জায়গা।
সুইডেনের মহিলা দলের বিপক্ষে একটি নাটকীয় ফাইনালে স্বর্ণ জেতার মুহূর্তটিকে পুনরায় অনুভব করতে কানাডিয়ানরা এখানে আসতে চাইতেই পারে। গেমস শেষ হলে, সাইতামা স্টেডিয়ামে প্রধান ফুটবল ম্যাচগুলো অনুষ্ঠিত হবে।
ইয়োকোহামা বেজবল স্টেডিয়াম
বেজবল জাপানের একটি বড় ব্যবসা খাত এবং ২০২০ অলিম্পিকে সফটবল ও বেজবলকে সরকারি ইভেন্ট হিসেবে ফিরিয়ে আনা হয়েছে।
১৯৭৮ সালে তৈরি ইয়োকোহামা বেসবল স্টেডিয়াম এই ইভেন্টের আয়োজন করে, শনিবার রাতে আমেরিকা ও জাপানের মধ্যকার ম্যাচের মাধ্যমে শেষ হয়। শেষ পর্যন্ত জাপান ২-০ স্কোরে জিতে শীর্ষে উঠে আসে।
বছরের বাকি সময় টোকিওর দক্ষিণের এই বিশাল স্টেডিয়ামে ইয়োকোহামা ডেনা বেস্টার্স দল হাজার হাজার ভক্তদের জন্য খোলা থাকে।
জে-ভিলেজ ন্যাশনাল ট্রেনিং সেন্টার (ফুকুশিমা)
টোকিও গেমের প্রতিপাদ্য ছিলো "পুনরুদ্ধারের খেলা"। এটিকে সম্মান জানাতে অলিম্পিক টর্চ রিলে পূর্ব ফুকুশিমার এই ভেন্যুতে শুরু হয়েছিলো। ২০১১ সালের বিধ্বংসী ভুমিকম্প ও সুনামির পর এখানে আসা উদ্ধারকারীদের মূল পরিচালনাকেন্দ্র ছিল এটি।
উত্তর- পূর্ব জাপানের তোহোকু অঞ্চলে অবস্থিত এ ভেন্যুটি তখন থেকে একটি কমিউনিটি সেন্টার ও ক্রীড়া প্রশিক্ষণ ভেন্যুতে রূপান্তরিত হয়েছে।
সাপ্পোরো ওডোরি পার্ক
জাপানের উত্তরাঞ্চলীয় হকাইডো দ্বীপে অবস্থিত এ জায়গাটি তার বার্ষিক শীত উৎসবের জন্য একটি জনপ্রিয় গন্তব্য।
এ বছর এখানে রেস ওয়াকিং এবং ম্যারাথন ইভেন্টের আয়োজন হয়। গেমসের চূড়ান্ত দিনে, ২ ঘণ্টা ৮ মিনিট এবং ৩৮ সেকেন্ডে ফিনিশিং লাইনে পৌঁছে কেনিয়ার কিংবদন্তি এলিউড কিপচোগ পুরুষদের ম্যারাথনে তার ক্যারিয়ারের চতুর্থ অলিম্পিক পদক হিসেবে স্বর্ণ পদক জিতে নেন।
মজার বিষয় হলো, সাপ্পোরো ১৯৭২ সালে শীতকালীন অলিম্পিকের আয়োজন করেছিলো এবং ২০৩০ সালে আবারয একই আয়োজন করার পরিকল্পনা করছে।
- সূত্র: সিএনএন