তালেবান গোষ্ঠীর শহর দখল ঠেকাতে হবে আফগান বাহিনীকেই: যুক্তরাষ্ট্র
তালেবান গোষ্ঠী যদি বছর খানেক আগে উত্তর আফগানিস্তানের তিনটি প্রাদেশিক রাজধানী দখল করে ফেলত, যেমনটা তারা গত রোববার করেছে, তাহলে মার্কিন বাহিনী এর জবাব খুব কঠোরভাবেই দিত। যুদ্ধবিমান এবং হেলিকপ্টার গানশিপের বলপ্রয়োগ করে ইসলামপন্থী গোষ্ঠীটির অগ্রযাত্রাকে সেখানেই রুখে দিত তারা।
কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতি ভিন্ন। কুন্দুজ, তালিকান কিংবা সার-ই-পুল শহর থেকে মার্কিন বাহিনীর শত শত মাইল দূরে থেকেও বিমান এবং অত্যাধুনিক অস্ত্রের মাধ্যমে প্রতিরোধ গড়ে তোলার সক্ষমতা রয়েছে। অথচ সেই শহরগুলো এখন তালেবানদের দখলে।
গত রোববার যুক্তরাষ্ট্রের এমন নিস্তব্ধ প্রতিক্রিয়া বুঝিয়ে দিয়েছে, আফগানিস্তানে মার্কিন যুদ্ধ শেষ হয়েছে। সুতরাং বিশৃঙ্খলিত ও ক্লান্ত হয়ে পড়া আফগান বাহিনীকে নিজেদের প্রচেষ্টাতেই শহরগুলো পুনরুদ্ধার করতে হবে, অথবা চিরতরে সেগুলোর দাবি ছেড়ে দিতে হবে।
আফগান বাহিনীর বিপরীতে তালেবান বাহিনীর জয় মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের এ মাস শেষে আফগানিস্তানে মার্কিন যুদ্ধ পরিসমাপ্তির সিদ্ধান্তকে পরিবর্তন করতে পারবে না- বলেই গত রোববার জানিয়েছেন একজন মার্কিন ঊর্ধ্বতন প্রশাসনিক কর্মকর্তা।
তবে চলমান সহিংসতায় বাইডেনের পক্ষে আমেরিকাকে যুদ্ধ থেকে বের করে আনা যথেষ্ট কঠিন হয়ে পড়বে, যেখানে তিনি জোর দিয়ে বারবারই বলেছিলেন, নৃশংস তালেবান আক্রমণের মাঝে আফগানিস্তান ত্যাগ করবেন না।
গত মাসে বাইডেন এক বক্তব্যে বলেন, মার্কিন বাহিনী আফগান সরকার ও সামরিক বাহিনীকে দেশটিতে অধিষ্ঠিত করতে ও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে যথেষ্ট সহায়তা করেছে। এখন সময় হয়েছে আফগানদের নিজ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা নিজেদেরই তৈরি করার।
গত কয়েক সপ্তাহে তালেবান বাহিনী আফগানিস্তানের অধিকাংশ শহর দখল করে নিয়েছে। আর এই দখলদারীর সময়ে তালেবানের হাতে প্রাণ দিতে হয়েছে অগণিত সরকারি কর্মকর্তা, সামরিক কর্মকর্তা ও বেসামরিক মানুষকে।
এ অবস্থার মাঝেও মার্কিন কর্মকর্তারা জনসম্মুখে বলছেন, শহরগুলো ফিরে পেতে তালেবান গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে লড়াই করার মতো সক্ষমতা আফগান বাহিনীর রয়েছে; যেখানে তালেবান বাহিনীর সঙ্গে যেকোনো প্রকার শান্তিচুক্তি এখন প্রায় অসম্ভবেরই নামান্তর।
সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার অধীনে প্রতিরক্ষা সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী লিওন ই প্যানেটা বলেন, তিনি রোববার আরও বেশি মার্কিন বিমান সহায়তা পাওয়ার আশা করেছিলেন, তবে মার্কিন বাহিনীর সাহায্য সত্ত্বেও পরিস্থিতির উল্লেখযোগ্য উন্নতি হবে বলে আশা করেননি।
'তাই আসুন আমরা এর মুখোমুখি হই,' বলেন প্যানেটা। তিনি আরও বলেন, 'আফগান বাহিনী ও তালেবান যোদ্ধাদের মধ্যে আপনি এখন যা আশা করতে পারেন, তা হলো এক ধরনের অচলাবস্থা, যাদের উভয়ই মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহারের ঘোষণার পর থেকে যেকোনো ধরনের চুক্তিতে পৌঁছানোর ব্যাপারে খুব কম আগ্রহ দেখিয়েছে।'
পেন্টাগনের উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা অনিচ্ছাকৃতভাবে আফগানিস্তানের অধিকাংশ সামরিক সহায়তা বন্ধ করে দিয়েছেন। তারা রোববার ফোনালাপে সাড়ে ৩ লাখেরও বেশি অধিবাসীর শহর কুন্দুজের চারপাশে চলমান সহিংসতা সম্পর্কে এ তথ্য জানিয়েছেন। তালেবানদের কাছ থেকে কুন্দুজ পুনরুদ্ধারের জন্য যুক্তরাষ্ট্র অতীতে আরও দুবার অভিযান চালিয়েছিল।
কিন্তু প্রতিরক্ষা কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, সীমিত বিমান হামলার বাইরে এবার আর কোনো পদক্ষেপ নেওয়ার পরিকল্পনা তাদের নেই। কর্মকর্তারা আরও জানিয়েছেন, গত তিন সপ্তাহ ধরে যুক্তরাষ্ট্র আর্মড রিপার ড্রোন এবং এসি -১৩০ এরিয়াল গানশিপ ব্যবহার করে ভারি আর্টিলারিসহ তালিবান গোষ্ঠীকে লক্ষ্য আক্রমণ করেছে, যা বেসামরিক মানুষ, বিদেশি দূতাবাস এবং আফগান সরকারি ভবনকেও হুমকির মুখে ফেলেছে।
যদিও মার্কিন সামরিক অভিযান এই মাসের শেষে আনুষ্ঠানিকভাবে শেষ হওয়ার কথা, মার্কিন সৈন্য ও তাদের পশ্চিমা মিত্ররা বেশিরভাগই ইতোমধ্যে আফগানিস্তান ত্যাগ করেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র গত মাসে আফগানদের হাতে সামরিক স্নায়ু কেন্দ্র বাগ্রাম বিমান ঘাঁটি হস্তান্তর করেছে, যা আফগানিস্তানে কার্যকরভাবে মার্কিন প্রধান সামরিক অভিযানের পরিসমাপ্তিকেই নির্দেশ করে।
তাই এখন আফগান বাহিনীর জন্য আকাশ সীমায় নজরদারি এবং বিমান সমর্থন আসছে কাতার কিংবা সংযুক্ত আরব আমিরাতের ঘাঁটি থেকে, অথবা আরব সাগরে অন্য দেশের বিমানবাহী জাহাজ থেকে।
সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের শাসনামলে কর্মরত থাকা ন্যাটোর প্রাক্তন শীর্ষ কর্মকর্তা জেনারেল ওয়েসলি ক্লার্ক সপ্তাহান্তের এই ঘটনাকে 'আফগানিস্তানের মানুষের জন্য একটি ট্র্যাজেডি এবং আমেরিকান ভুল বিবেচনা ও ব্যর্থতার পরিণতি' বলে অভিহিত করেছেন।
বেসামরিক হতাহতের সংখ্যা হয়েছে আকাশচুম্বী। গত মাসে প্রকাশিত জাতিসংঘের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ১ মে থেকে ৩০ জুনের মধ্যে প্রায় ২৪০০ বেসামরিক নাগরিক নিহত বা আহত হয়েছেন, যা ২০০৯ সালের পর সর্বোচ্চ।
শুক্রবার তালেবানের অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে চাইলে হোয়াইট হাউসের প্রেস সেক্রেটারি জেইন সাকি সাংবাদিকদের বলেন, বাইডেন আফগানিস্তান থেকে সৈন্য প্রত্যাহারের প্রতিশ্রুতির অংশ হিসেবে দীর্ঘ সময় ধরেই 'কঠিন সিদ্ধান্ত' গ্রহণের জন্য প্রস্তুত ছিলেন।
মিস সাকি আরও বলেন, 'প্রেসিডেন্ট স্পষ্ট করে বলেছেন: যুদ্ধের ২০ বছর পর, মার্কিন সৈন্যদের দেশে ফিরে আসার সময় হয়ে এসেছে। এছাড়া তিনি মনে করেন, আফগান সরকার এবং আফগান জাতীয় প্রতিরক্ষা বাহিনী যথেষ্ট প্রশিক্ষিত হওয়ার সুযোগ পেয়েছে, অত্যাধুনিক সামরিক সরঞ্জামও তাদের রয়েছে এবং এখনই সময় তালেবানদের আগ্রাসন ও সহিংসতা মোকাবিলায় তাদের নিজেদের নেতৃত্ব ও ইচ্ছা গড়ে তোলার।'
মিস সাকির এমন মন্তব্যে বোঝা যায়, বাইডেন প্রশাসন আফগানদের সামনে নিজেদের লড়াই করা ছাড়া আর কোনো পথ খোলা রাখতে চায় না।
ইরাক যুদ্ধে অভিজ্ঞ সৈনিক এবং প্রগতিশীল ভেটেরান্স গ্রুপ ভোটভেটসের চেয়ারম্যান জন সল্টজ বলেন, 'ইরাকের মতো এখানেও একটি নির্দিষ্ট সময় শেষে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা বন্ধ করে দিতে হবে। বন্ধ হওয়ার পরেই ইরাকি সেনাবাহিনী যেমন প্রতিরক্ষায় অগ্রসর হয়েছিল, আফগান বাহিনীও ঠিক এমনটাই করবে।'
'সহিংসতার চরম অবস্থা কাবুলের কাছাকাছি যেতেই যখন আফগানীদের পিঠ দেয়ালে ঠেকে যাবে, তখন তারা তাদের সর্বোচ্চটা দিয়ে লড়াই করবে। সেই মুহূর্তের জন্য তাদের প্রস্তুত করতে আমরা আমাদের যথাসাধ্য চেষ্টা করেছি,' বলেন ইরাকি সৈন্যদের অন্যতম প্রশিক্ষণদাতা সল্টজ।
এখন পর্যন্ত পেন্টাগনের কোনো উর্ধ্বতন কর্মকর্তা মার্কিন প্রেসিডেন্ট বাইডেনের সঙ্গে তালেবান প্রসঙ্গে প্রকাশ্যে দ্বিমত প্রকাশ করেননি। তবে গত বসন্তে প্রতিরক্ষা সচিব লয়েড জে অস্টিন এবং জয়েন্ট চিফ অব স্টাফ প্রধান জেনারেল মার্ক এ. মিলি মি. বাইডেনকে আমেরিকান সৈন্য প্রত্যাহারের বিরুদ্ধে পরামর্শ দিয়েছিলেন।
অস্টিন বলেন, 'আমরা আগেও এমন সংকটের মুখোমুখি হয়েছি, যখন ওবামা সরকারের আমলে ইরাক থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করা হয়েছিল। তখন সেখানে ইসলামী সন্ত্রাসী গোষ্ঠী ইসলামিক স্টেটের উত্থানের প্রেক্ষিতে আবারও পাঁচ বছরের জন্য অভিযান চালাতে হয়; বিমান সমর্থন দেওয়ার মাধ্যমে ইরাক ও সিরিয়ায় বিদ্রোহী গোষ্ঠী দমনে ইরাকি সৈন্যদলকে সহায়তা করার অপরিহার্যতা তৈরি হয়েছিল।'
বাইডেন বহু বছর ধরে আফগানিস্তান থেকে সরে আসার পক্ষে যুক্তি দিয়ে আসছেন। ২০০৯ সালে ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে তিনি সৈন্য কমানোর পক্ষে যুক্তি দেখিয়েছিলেন, যদিও সেই যুক্তি তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ওবামা গ্রহণ করেননি। তবে পরবর্তীকালে আবার দ্রুত সৈন্য প্রত্যাহারের ঘোষণাও তিনি দিয়েছিলেন।
তবে কয়েক বছর পর প্রেসিডেন্ট হিসাবে দায়িত্ব গ্রহণের পর তিনি মার্কিন বাহিনী প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, যা তার শাসন আমলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলোর একটি। এই সিদ্ধান্তের প্রেক্ষিতে আগামী দিনগুলোতে অসংখ্য বেসামরিক মানুষের যন্ত্রণা ও ক্ষয়ক্ষতির ভয়ঙ্কর চিত্রের মুখোমুখি হওয়ার আশঙ্কা থাকা সত্ত্বেও; বাইডেন যেকোনো পরিস্থিতি নির্বিশেষে তার অঙ্গীকার বাস্তবায়নের পথে অটল থাকতে চান।
এছাড়া জনমত জরিপেও দেখা গেছে, উভয় পক্ষেরই বিপুল সংখ্যক আমেরিকান এ ক্ষেত্রে নিজ দেশের সৈন্যদের আফগানিস্তান ত্যাগের সিদ্ধান্তকে সমর্থন করেন।
জো বাইডেন এপ্রিল মাসে বলেছিল, আফগানিস্তানে মার্কিন অভিযান শেষ হওয়ার প্রেক্ষিতে ১১ সেপ্টেম্বরের মধ্যে সমস্ত মার্কিন সৈন্য আফগান ভূমি ত্যাগ করবে।
তবে নাম প্রকাশ না করা শর্তে দুজন মার্কিন কর্মকর্তা বলেন, এখন আর কোনোভাবেই আফগান বাহিনীর পক্ষে কুন্দুজ শহর ফিরে পাওয়া সম্ভব নয়, যা মিস্টার প্রেসিডেন্টের সিদ্ধান্তকে পুনর্বিবেচনায় প্ররোচিত করতে পারে।
এছাড়া বাইডেনের সিদ্ধান্তে রদবদল আসতে পারে, যদি তালেবান বাহিনী আফগানিস্তানের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর কান্দাহার, এমনকি রাজধানী কাবুলও দখল করার পথে অগ্রসর হতে থাকে, যেখানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রায় ৪ হাজার স্টাফ নিয়ে দূতাবাসের কার্যক্রম চালায়।
- সূত্র: দ্য নিউইয়র্ক টাইমস