আমানতের সুদ এবং বিনিয়োগের মধ্যে সর্বোচ্চ ৩ শতাংশের বেশি থাকা উচিত না
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে স্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তানের দুটি শাখা এবং ১৭ টি বাণিজ্যিক ব্যাংক, যেগুলোকে রাষ্ট্রায়ত্ত করা হয়েছিল। বাংলাদেশের সরকার সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি গড়ে তোলার আদর্শকে সামনে রাখে যা পরবর্তী ১২ বছর চলমান ছিল। পাকিস্তানের ন্যাশনাল ব্যাংক আজকের সোনালী ব্যাংক।
১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর এই বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক নীতি থেকে সরে আসে। বেসরকারি খাতকে উন্মুক্ত করা হয় এবং ১৯৮২ সনে সামরিক শাসন জারির পরে ১৯৮৩ থেকে বেসরকারি খাতে ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করার অনুমোদন দেওয়া শুরু হয়। যেসময় বাংলাদেশে ব্যাংকসমূহ জাতীয়করণ করা হয়েছিল তখন বাংলাদেশে কর্মরত বিদেশি ব্যাংকগুলো জাতীয়করণ করা হয়নি। শুধুমাত্র পাকিস্তানের মালিকানাধীন ব্যাংক জাতীয়করণ করা হয়েছিল। ১৯৮৩ সালে এরশাদ সরকার যখন ব্যাংকগুলোকে বেসরকারি খাতে অনুমোদন দেওয়া শুরু করলেন তখনই ব্যাংকগুলোর পরিশোধিত মূলধন ছিল মাত্র ২০ কোটি টাকা। এই ব্যাংকগুলোকে বলা হয় প্রথম জেনারেশন ব্যাংক। যার মধ্যে ন্যাশনাল ব্যাংক, সিটি ব্যাংকসহ সম্ভবত দশটি ব্যাংকের অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল।
গত বছরের হিসাব মতে, বর্তমানে ৬০টি তালিকাভুক্ত ও ৫ টি অ-তালিকাভুক্ত ব্যাংক নিয়ে এদেশের ব্যাংক ব্যবস্থা পরিচালিত হচ্ছে। তালিকাভুক্ত ব্যাংকের মধ্যে রয়েছে ৬টি রাষ্ট্রায়াত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংক, ৩ টি বিশেষায়িত ব্যাংক, ৪২টি ব্যক্তি মালিকানাধীন বাণিজ্যিক ব্যাংক এবং ৯ টি বিদেশি ব্যাংক। প্রথম দিকে যখন বেসরকারি খাতে ব্যাংক অনুমোদন দেওয়া হয়, তখন ব্যাংকগুলোর সুদের হার ছিল ১৮ থেকে ২০ শতাংশ। অর্থাৎ গ্রাহককে ১৮ থেকে ২০ শতাংশ সুদ পরিশোধ করতে হতো। সেই ১৮ থেকে ২০ শতাংশ থেকে বর্তমানে সুদের হার এক অংকের সংখ্যায় নামিয়ে আনা হয়। পূর্ববর্তী প্রায় চল্লিশ বছর এ দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যে ঐ পরিমাণ সুদ প্রদান করতে হতো।
২০ কোটি টাকার পরিশোধিত মূলধনের ব্যাংক এখন ৫০০ কোটি টাকার পরিশোধিত মূলধন নিয়ে চলছে। এই পরিশোধিত মূলধন ব্যাংক মালিকরা নিজেদের পকেট থেকে প্রদান করেন না। ব্যাংক কর্তৃক লভ্যাংশকে রিজার্ভ হিসেবে সংরক্ষণ করে মূলধনে রূপান্তরিত করা হয়। দীর্ঘকালের ব্যবসায়ী সমাজের দাবি এবং অর্থনীতিবিদদের পরিষ্কার মতামতের ভিত্তিতেই সরকার সিঙ্গেল ডিজিট ইন্টারেস্ট নামিয়ে এনেছে। ব্যাংকগুলোর অভ্যন্তরীণ বেতন কাঠামো বাংলাদেশের যে কোন শিল্পের চেয়ে বহুগুণ বেশি।
উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা কী পরিমাণে বেতন পান তা এ দেশের অন্যান্য খাতে কর্মরত মানুষ ধারণাই করতে পারবেন না। বেতনের বাইরে ট্যাক্স কার্ড করার জন্য রয়েছে হাজারো রকমের সুযোগ-সুবিধা। ব্যবস্থাপনা পরিচালকসহ অন্যান্য উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তারা বছরে কোটি টাকার উপরে শুধুমাত্র বেতন খাতে আয় করেন। এর ফলে বাংলাদেশ ভারী শিল্পে বিনিয়োগ অত্যন্ত ধীর গতিতে হচ্ছে। গত ২০ বছরে নানাভাবে বেশ কিছু ভারী শিল্প তৈরি হয়েছে। এখনো আমাদের আরও বহু পথ চলতে বাকি।
ব্যাংক কর্মকর্তাদের বেতনের পরিধি এতটাই বৃদ্ধি পেয়েছে যে সাম্প্রতিক কালের বহুল আলোচিত অভিনেত্রীর গাড়ির সঙ্গে দেশীয় ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীর নাম জড়িত রয়েছে যদিও এ বিষয়ে বিশ্বাসযোগ্যতা সন্দেহাতীত নয়, তারপরও এই ব্যাংক কর্মকর্তাদের আর্থিক সক্ষমতা ওই পর্যায়ে পৌঁছেছে দেখেই এই ধরনের প্রচারণা সামনে চলে আসে। আবার এই প্রথম জেনারেশনের অনেকগুলো ব্যাংকে নানান আর্থিক দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ে সমাজে নানান ঘটনার জন্ম দিচ্ছে।
কিছুকাল আগেই এইরকম একটি ফার্স্ট জেনারেশন ব্যাংকের পরিচালকবৃন্দ অন্য আরেকটি ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণ করার জন্য সেই ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও ডেপুটি ব্যবস্থানা পরিচালকে গুলি করে হত্যার হুমকি প্রদান করেন। পরিণতিতে দেশ ত্যাগ এবং শেষপর্যন্ত সমঝোতা চুক্তি। শুধু এই ঘটনা না, এ ধরনের আরো অনেক ব্যাংকের মধ্যেই এ রকমের নানান দুর্নীতির লুকিয়ে আছে ।
রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক বেসিক এবং আরো দু-একটি ব্যাংকে এমন নানান ইতিহাস ছড়িয়ে পড়েছে গত এক দশকে।এমনকি পূর্ববর্তী ব্যাংকিং অর্ডিন্যান্স আইন পাল্টে এখন ব্যাংকগুলোকে পারিবারিক প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত করা হয়েছে।
প্রথমদিকের ব্যাংক পরিচালনা আইনের মধ্যে বলা ছিল ২৫ শতাংশের বেশি কোনো শেয়ার কোনো পরিবারের মধ্যে থাকবে না, কিংবা ৬ বছরের বেশি সময় কোন পরিষদের সভাপতি অথবা পরিচালক থাকা যাবে না, এ বিষয়গুলোকে এখন তুলে দেওয়া হয়েছে, ফলে ব্যাংক সমূহ দেশের বিকল্প রাজনৈতিক শক্তিতে রূপান্তরিত হয়েছে।
সরকার ব্যাংকের সুদের উপর লাগাম টেনে ধরে একটা লম্বা সময় দিয়ে বললেন, নয় শতাংশের উপরে কোন সুদ ধার্য করা যাবে না। কোভিড- ১৯ দেশে প্রচন্ড অর্থনৈতিক সংকট সৃষ্টি করেছে। নতুন কোনো বিনিয়োগ হচ্ছে না। ফলে বাজারের তারল্য বৃদ্ধি পেয়েছে। তারল্য বৃদ্ধি পাওয়ার সাথে সাথেই ব্যাংকগুলো আমানতকারীদের সুদের হার দ্রুত কমাতে লাগলেন এবং ইতিহাসের সর্বনিম্ন পর্যায়ে নিয়ে আসলেন। আমানতের সুদ যদি দেশের মুদ্রাস্ফীতির নিচে হয় তাহলে তা একটি ভয়ঙ্কর আত্মঘাতী পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে।
সরকার বললেন, আমানতের সুদের হার ৫ শতাংশের নিচে নামানো যাবে না। সরকারের মুদ্রাব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণকারী বাংলাদেশ ব্যাংক ঠিক কত শতাংশ বলেছে তা এই মুহূর্তে সুস্পষ্ট নয়। কারণ দেশে বর্তমানে মুদ্রাস্ফীতির হার ৫.৫৭ শতাংশ যদি আমানতের ন্যূনতম মূল্য হয় তাহলে আমানতকারীদের আর বিনিয়োগকারীদের মাঝখানে শতাংশ হারে ৩.৪৩ আর যদি তা ৫ শতাংশ ধরা হয় তাহলে প্রায় চার শতাংশ। পৃথিবীর যে কোন উন্নত দেশ বিনিয়োগকারীদের জন্য ব্যাংকের সুদের হার এর থেকে বেশি নয়। যদিও সে ক্ষেত্রে আমানতকারীরা আরও কম উপার্জন করেন।
সরকার অবসরপ্রাপ্ত মানুষের জন্য জাতীয় সঞ্চয়পত্রে নানা ধরনের ব্যবস্থা রেখেছেন। যারা মূলত অবসর জীবন পার করেন। ব্যাংকের উপরে জামানতের বিপক্ষে সেদিকে তাদের খুব বড় ধরনের ঝুঁকি নাই। তারপরেও সরকার সুদের হার টেনে ধরার চেষ্টা করল। বলা হলো, ব্যাংকগুলো লোকসানের মুখোমুখি হবে। আমরা এখন পর্যন্ত জানতে পেরেছি ওয়ান ব্যাংকের নাম, যে ব্যাংকের মালিকরা তার কর্মচারী, কর্মকর্তাদের বেতন কর্তন করেছে। যদিও তারা উচ্চহারের লভ্যাংশ গ্রহণ করেছে।
অন্য কোনো ব্যাংক তাদের কর্মচারী কর্মকর্তাদের বেতন কর্তন করেছে কিনা তা এখনও পরিষ্কার নয়। দেশে লকডাউন থাকা অবস্থায়ও শিল্প-কারখানার সমস্ত উৎপাদন ব্যবস্থা চালু থাকা সত্ত্বেও এই ব্যাংকগুলো তাদের সুদের হারে কোন তারতম্য ঘটায়নি। শিল্প কারখানাগুলোর তাদের শ্রমিকদের বেতন প্রদান করতে হয়েছে। সরকার গার্মেন্টস-টেক্সটাইল খাতসহ অন্যান্য খাতে যে প্রণোদনা প্রদান করেছেন তা কিন্তু ফেরত দিতে হবে। শিল্পকারখানা সমূহকে কেবলমাত্র ৪ শতাংশ সুদ সরকার বহন করবে বাকি ৪ শতাংশ শিল্প মালিককেই বহন করতে হবে।
যতক্ষণ পর্যন্ত ব্যাংকগুলো নিজস্ব সংকোচন নীতি গ্রহণ না করছে ততক্ষণ পর্যন্ত ব্যাংকের আয়-ব্যয়ের উপরে একটি নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা উচিত। অতীতে দেখেছি, বহু ব্যাংক তাদের বাৎসরিক মিটিংয়ের জন্য বিদেশে ফাইভ স্টার হোটেল ভাড়া করে সেখানে যেতেন। মালয়েশিয়া-সিঙ্গাপুরসহ নানা বড় বড় শহরে তাদের ম্যানেজমেন্ট মিটিং করেছেন, বোর্ড মিটিং করেছেন। দেশের প্রথম সারির অনেকগুলো ব্যাংক এ ধরনের আচরণ করেছেন। ব্যাংক-বীমার নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা কখনো এ বিষয়ে কোনো আপত্তি তুলেছে কিনা তা আমাদের জানা নেই।
সে কারণে সরকারের বর্তমান পদক্ষেপ অত্যন্ত সঠিক রাস্তায় পরিচালিত হচ্ছে। আমানতের সুদ এবং বিনিয়োগের মধ্যে সর্বোচ্চ তিন শতাংশের বেশি থাকা উচিত না। তাহলেই কেবল মাত্র তাদের কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং নিজেদের উপর লাগাম টানতে পারবে। ২০ কোটি টাকার পরিশোধিত মূলধনের ব্যাংক হাজার কোটি টাকা প্রফিট করে। এই প্রফিট খতিয়ে দেখা না হলে খেলাপি ঋণের হদিস মিলবে না। কেবল শিল্প কারখানাগুলোকে ঋণখেলাপির অভিযোগের বোঝা বহন করতে হবে।