বাবাকে কখনো কারও কাছে নতজানু হতে দেখিনি: মৌলি আজাদ
একাধারে তিনি কবি, ঔপন্যাসিক, ভাষাবিজ্ঞানী, সমালোচক, রাজনীতিক ভাষ্যকার, গবেষক ও অধ্যাপক। বলছি প্রধাবিরোধী লেখক হুমায়ুন আজাদের কথা। তার সাহিত্যকর্ম এই দেশে তুমুল আলোড়ন তুলেছিল।
১৯৪৭ সালের ২৮ এপ্রিল মুন্সিগঞ্জের শ্রীনগর থানার রাঢ়িখালে জন্মগ্রহণ করেন এই লেখক। ৭টি কাব্যগ্রন্থ, ১২টি উপন্যাস, ২২টি সমালোচনা গ্রন্থ, ৭টি ভাষাবিজ্ঞানবিষয়ক, ৮টি কিশোরসাহিত্য ও অন্যান্য প্রবন্ধ সংকলন মিলিয়ে ৬০টিরও অধিক গ্রন্থ তার জীবদ্দশায় এবং মৃত্যু পরবর্তী সময়ে প্রকাশিত হয়। ১৯৮৬ সালে তিনি বাংলা একাডেমি পুরস্কার এবং ২০১২ সালে মরণোত্তর একুশে পদক পান।
২০০৪ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি অমর একুশে বইমেলা থেকে বেরিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে নিজের বাসায় যাওয়ার পথে ঘাতকদের আক্রমণের শিকার হন তিনি। পরে তাকে দেশে ও দেশের বাইরে চিকিৎসা করানো হয়। একই বছর তিনি ১২ আগস্ট জার্মানিতে মৃত্যুবরণ করেন।
হুমায়ুন আজাদের মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে তার সাহিত্যকর্ম এবং ব্যক্তিজীবন নিয়ে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের সঙ্গে কথা বলেছেন তার বড় মেয়ে মৌলি আজাদ।
টিবিএস: আপনার বাবার সর্ম্পকে কিছু বলুন?
মৌলি আজাদ: প্রথমেই বলব, তিনি ছিলেন একজন সম্পূর্ণ আধুনিক মানুষ; খুবই খোলামেলাভাবে কথা বলতেন। তাকে কখনো কারও কাছে নতজানু হতে দেখিনি।
টিবিএস: কিন্তু তাকে সবাই খুব রাগী বলে জানেন, আপনাদের সাথে কেমন ছিলেন তিনি ?
মৌলি: আসলেই তিনি রাগী ছিলেন, কিন্তু তার ভেতরে একটা কোমল মনও ছিল। অনেকে দেখবেন অনেক সামান্য বিষয়কেও জটিল করে তোলে ক্ষমতাবলে, কিন্তু বাবাকে দেখতাম অনেক কিছু এড়িয়ে যেতে। আমাদের পড়াশোনার ব্যাপারে ভীষণ কড়া ছিলেন অবশ্য। আমরা তাকে এমনটাই দেখেছি।
টিবিএস: কেন তিনি প্রথাবিরোধী? তিনি কি ব্যক্তিজীবনেও প্রথাবিরোধী থাকতে পেরেছিলেন? তার ব্যক্তিগত জীবন কেমন ছিল?
মৌলি: তিনি সবকিছুকে অন্য সবার চেয়ে ভিন্নভাবে ভাবতেন ও দেখতেন। তবে বাবা তার ব্যক্তিগত জীবন প্রথাগতভাবেই কাটিয়েছেন। অবশ্য আমাদের সমাজব্যবস্থায় অন্যভাবে থাকাও সম্ভব নয়। তাই সবার মতনই ছিল তার ব্যক্তিগত জীবন।
টিবিএস: তার লেখা সব উপন্যাস, কাব্যগ্রন্থ কি আপনাকে সমান টানে?
মৌলি: বাবার সব লেখার মধ্যে আমার প্রিয় কিশোরদের জন্য লেখাগুলো । 'ফুলের গন্ধে ঘুম আসে না', 'আব্বুকে মনে পড়ে' যতবার পড়ি, ততবার মনটা ভালো লাগায় ভরে যায় ।
টিবিএস: তিনি নেই ১৭ বছর হয়ে গেল, কেমন অনুভুতি আপনার?
মৌলি: মনে হয় দুঃস্বপ্ন এটা। কিছুক্ষণ পরেই তিনি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ক্লাস নিয়ে বাড়ি ফিরবেন– এ রকম মনে হয়।
টিবিএস: তাকে হত্যা মামলার বিচার দ্রুত শেষ করার নির্দেশ ছিল। সেটার বর্তমান অবস্থা কী?
মৌলি: তার মৃত্যুর ১৭ বছর হয়ে গেল, কিন্তু আজও মামলাটি শেষ হলো না– ভাবলে দুঃখ হয়।
টিবিএস: বাবা নয়, লেখক হিসেবে হুমায়ুন আজাদকে মূল্যায়ন করুন।
মৌলি: বাবার লেখা 'লাল নীল দীপাবলী', 'কত নদী সরোবর বা বাংলাভাষার জীবনী'– বই দুটো বাংলাদেশের খুব কম তরুণ পড়েননি। আমাকে অনেকে বলেছেন, 'স্যারের লেখা এ বই দুটো না পড়লে হয়তো বিসিএসে পাসই করতে পারতাম না।' তার অন্য সব লেখা বাদ দিয়ে যদি শুধু তার লেখা বাংলা ভাষার বইয়ের কথাই বলি– তবে বলতে হয়, তার মতো ভাষাবিদ কয়জনই-বা এখানে আছে বলুন!
টিবিএস: জার্মানির মিউনিখে তিনি যখন মারা যান, তখন তার রুমে তিনটা পোস্টকার্ড পাওয়া যায়। আপনাদের তিন ভাইবোনকে লেখা চিঠি ছিল সেগুলো। তিনি আপনাকে কী লিখেছিলেন সেই চিঠিতে?
মৌলি: চিঠিগুলো আলমারিতে রেখে দিয়েছি। খুলে দেখি না বহু বছর। কারণ, দেখলেই কান্না আসে। চিঠিতে সুন্দর জার্মান শহরের বর্ননা আছে, কিন্তু তার সেসব কিছুই ভালো লাগছে না বলে তিনি লিখেছেন। প্রতিটি চিঠির শেষেই লেখা, 'তোমরা ভালো থেকো, খুব সাবধানে থেকো।'
টিবিএস: বর্তমান সময়ে এসে আপনার কি মনে হয় এখন আপনার বাবাকে বা আপনার বাবার লেখালেখি খুব প্রাসঙ্গিক ও জরুরি ছিল?
মৌলি: হ্যাঁ, মনে হয়। আর তাই তো আজও বাবার বইগুলো পাঠক কিনছেন। বাবার লেখার নানা উদ্ধৃতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রায়শই অনেকে উদ্ধৃত করছেন।
টিবিএস: আপনাদের পরিবারের সবাই এখন কী অবস্থায় আছেন?
মৌলি: আমাদের জীবন চলে যাচ্ছে এক রকম। এখানে একটা কথা উল্লেখ করি, বাবা নেই, যখন যেখানে যাই, বাবার জন্য সবার কাছ থেকে সম্মান পাই– যা মেয়ে হিসেবে আমার ভীষণ ভালোলাগে। অনেকেই যখন বলেন, 'স্যারের মতন স্পষ্টভাষী মানুষ আজকাল আর কই'– তখন বুঝতে পারি, বাবা তার পাঠকের জীবনে কীভাবে প্রভাব ফেলে গেছেন। বাবা আসলে এভাবেই বেঁচে থাকতে চেয়েছেন।
টিবিএস: বাবার লেখা, দর্শন বা চিন্তা-ভাবনা ছড়িয়ে দেওয়ার কোনো উদ্যোগ আপনারা নিচ্ছেন?
মৌলি: লেখক হুমায়ুন আজাদের মতন সাহস কয়জনের আছে, যে, তার চিন্তা-ভাবনা ছড়িয়ে দিতে সক্ষম হব? বাবার বেশিরভাগ বই এখনো পুর্নমুদ্রণ হচ্ছে পাঠকের চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতেই। ২০১৮ সালে তার কিশোর গ্রন্থ 'আব্বুকে মনে পড়ে' বইটি ইংরেজিতে অনুবাদ হয়েছে। অনুবাদ করেছেন অরুণাভ সিনহা; প্রকাশ করেছে আমাজন।