দ্রুত কাবুল ছাড়ছে কূটনীতিকরা
তালেবান বিদ্রোহের দ্রুত অগ্রগতির মুখে কূটনৈতিক কর্মী, শ্রমিক, নাগরিক এবং অন্যান্যদের নিরাপদ স্থানে সরে যেতে সাহায্য করার জন্য মার্কিন সৈন্যের প্রথম দল আফগানিস্তান পৌঁছতে চলেছে।
শুক্রবারে (১৩ আগস্ট) রাজধানী কাবুল হতে মাত্র ৮০ কিলোমিটার (৫০ মাইল) দূরবর্তী লোঘার প্রদেশের রাজধানী পুল-ই-আলমের পতন হয়েছে তালেবান বাহিনীর হাতে।
জাতিসংঘ প্রধান বলেন, বেসামরিক নাগরিকদের মারাত্মক দুর্দশায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। এ পর্যন্ত আড়াই লাখের বেশি মানুষ নিজেদের ঘরবাড়ি ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়েছে।
২০ বছরের সামরিক অভিযান সমাপ্তির প্রেক্ষিতে মার্কিন ও বিদেশী সেনা প্রত্যাহারের ফলে তালেবান বাহিনীর তাণ্ডব শুরু হলো। ২০০১ সালে জঙ্গি পতন ঘটিয়ে সামরিক অভিযানের মাধ্যমে দেশটিতে মানবাধিকারের যতটুকু উন্নতি হয়েছিলো, তা দ্রুতই বিপরীত দিকে ধাবিত হতে দেখা যাচ্ছে।
১৯৯০ এর দশকে তালেবান শাসনামলে নারীদের উপর চাপিয়ে দেওয়া হত নানা ধরণের নির্যাতনমূলক সিদ্ধান্ত। বোরকা দ্বারা নিজেকে সম্পূর্ণরূপে আবৃত করে তাদের বাইরে বের হতে হতো, মেয়ে শিশুদের দশ বছর বয়স হয়ে গেলে স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দিতে হতো এবং প্রকাশ্যে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ারও বিধান ছিলো দেশটিতে।
এছাড়া শুক্রবারে, তালেবান বাহিনী আফগানিস্তানের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর কান্দাহার দখলের সঙ্গে সঙ্গে পার্শ্ববর্তী লস্করগাহ এবং পশ্চিমের হেরাতও দখল করে ফেলেছে। দেশটির মোট প্রাদেশিক রাজাধানীগুলোর এক-তৃতীয়াংশ এখন তালেবান দখলে।
পেন্টাগনের মুখপাত্র জন কিরবি তালেবানের এই সাম্প্রতিক অগ্রগতিকে 'গভীরভাবে উদ্বেগজনক' বলে মন্তব্য করেছেন।
মার্কিন কূটনৈতিক কর্মীদের সরিয়ে নিতে যে ৩ হাজার সেনা পাঠানো হচ্ছে তাদের অধিকাংশই সপ্তাহের শেষে গিয়ে পৌঁছাবে। কাবুল থেকে প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষকে বিমানযোগে সরিয়ে নেয়ার পরিকল্পনা করেছে যুক্তরাষ্ট্র।
মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থার সর্বশেষ তথ্যমতে, ধারণা করা হচ্ছে, আগামী ৩০ দিনের মধ্যেই জঙ্গি দলটি রাজধানী কাবুলের দিকে অগ্রসর হতে পারে।
প্রোপাগান্ডা ছড়াতে পারে সেই আশঙ্কায়, স্থানীয় মার্কিন দূতাবাসের কর্মীদের জানানো হয়েছে যে, সংবেদনশীল নথি ও অন্যান্য সামগ্রী (যেমন- পতাকা) যেন ধ্বংস করে ফেলা হয়।
ব্রিটিশ নাগরিক এবং সাবেক আফগান কর্মীদের সরিয়ে ফেলতে যুক্তরাজ্য ৬০০ সৈন্য পাঠাচ্ছে; এবং জার্মানির মত তারাও ঘোষণা দিয়েছে যে, স্থানীয় দূতাবাসে কর্মীদের সংখ্যা সর্বনিম্ন করা হবে।
এছাড়া ডেনমার্ক ও নরওয়ে তাদের দূতাবাস বন্ধ করে দিচ্ছে।
আফগান যুদ্ধের সারাংশ
- মার্কিন নেতৃত্বাধীন বাহিনী কর্তৃক তালেবান উৎখাত: ৯/১১ হামলার মূল পরিকল্পনাকারী আল-কায়েদা নেতা ওসামা বিন লাদেনকে সমর্থন দেওয়া ও লুকিয়ে রাখার প্রেক্ষিতে, ২০০১ সালে মার্কিন নেতৃত্বাধীন বাহিনী আফগানিস্তানের তালেবান সরকারকে উৎখাত করে।
- বিশ বছরের সামরিক অভিযান: মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্র বাহিনী দেশটির নির্বাচন তদারকি সহ আফগান নিরাপত্তা বাহিনী তৈরি ও তাদের শক্তি বৃদ্ধিতে কাজ করে। তবে এরমধ্যেও তালেবানরা বিচ্ছিন্নভাবে হামলা চালিয়ে যেতে থাকে।
- তালেবানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের চুক্তি: সন্ত্রাসী কার্যক্রম বন্ধ করলে যুক্তরাষ্ট্র তার বাহিনী আফগানিস্তান থেকে সরিয়ে নেয়ার কথা দেয় তালেবানকে। তবে আফগান সরকার ও তালেবান বাহিনীর মধ্যে আলোচনা ব্যর্থ হয়। ফলে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের মুখে দেশটির অধিকাংশ অঞ্চল দখল করে ফেলতে শুরু করে তালেবান গোষ্ঠী।
জাতিসংঘের মহাসচিব এন্টোনিও গুতেরেস তালেবানকে আগ্রাসন বন্ধের আহ্বান জানিয়েছেন এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কেও এটা নিশ্চিত করতে আহ্বান জানিয়েছেন যে, সামরিক শক্তির মাধ্যমে ক্ষমতা দখল কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।
তিনি বলেন, "এই সংঘাত প্রতিদিনই নারী ও শিশুদের উপর চরম আকার ধারণ করছে। এই যুদ্ধ অব্যাহত থাকা মানে, বেসামরিক হত্যাকাণ্ডের সংখ্যাও বাড়তে থাকা"।
তিনি আরও বলেন, খাদ্য ও চিকিৎসা সরবরাহ দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে এবং স্কুল ও ক্লিনিকসহ গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামোও ধ্বংস করা হয়েছে।
বেসামরিক মানুষগুলো যেন নিরাপদ আশ্রয়ে পৌঁছাতে পারে সেজন্য পার্শ্ববর্তী দেশগুলোকে সীমান্ত খুলে রাখার আহ্বানও জানিয়েছে জাতিসংঘ। এই সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, শুধু গতমাসেই এক হাজারের বেশি বেসামরিক মানুষকে হত্যা করা হয়েছে।
রাজধানী কাবুলের পাশেই বাস্তুচ্যুত মানুষদের জন্য অস্থায়ী শিবিরের ব্যবস্থা করা হয়েছে। আবার অনেককে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে অন্যান্য শহর থেকে এসে কাবুলের রাস্তায়ই ঘুমোতে দেখা গেছে।
সেভ দ্য চিলড্রেনের তথ্যমতে, গত কয়েকদিনের মধ্যে রাজধানীতে আশ্রয়ের খোঁজে পালিয়ে আসা শরণার্থীদের ৭২ হাজারই শিশু।
বিশ বছর বয়সী ছাত্র যুহাল, বাস্তুচ্যুত মানুষদের রাজধানীতে আশ্রয় শিবিরে জায়গা পেতে সহায়তা করছে। তিনি বিবিসিকে বলেন, "যুদ্ধবিরতি, একটি যুদ্ধবিরতি দরকার। কারণ আরও একটা দিন ঘুম থেকে উঠে একটি রক্তাক্ত শিশু কিংবা সন্তানের জন্য কান্নাভেজা মায়ের আহাজারি আমরা আর সহ্য করতে পারবো না। এসব দৃশ্য আমরা আর সহ্য করতে পারছি না"।
অন্য এক বিবৃতিতে কানাডা জানিয়েছে, আফগান নারী নেত্রী, মানবাধিকার কর্মী এবং সাংবাদিক প্রতিবেদক সহ ২০ হাজার সংকটাপন্ন মানুষকে পুনর্বাসনের পরিকল্পনা করেছে তারা।
- সূত্র- বিবিসি