অগ্রসরমান তালেবানদের মানচিত্র....
২০০১ সালে তালেবান ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর থেকে এই পর্যন্ত তারা আফগানিস্তানের যত অঞ্চল দখল করেছে তার চেয়ে গত দুই মাসে দখলকৃত অঞ্চলের পরিমাণ বেশি।
গত ২০ বছর যাবত আফগানিস্তান নিয়ন্ত্রণের রূপরেখা বারবার পরিবর্তন হয়ে আসছে। আফগানিস্তানের কোন অঞ্চল কার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত তার একটি চিত্র আমরা নিচের ছবিতে দেখতে পাই। দেখা গেছে, সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্র তাদের বাহিনী সরিয়ে নেয়াতে তালেবানরা সরকারি বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে থাকা অঞ্চলগুলোর দখল নিতে বেশি উৎসাহী।
বিবিসি আফগানের গবেষণা অনুযায়ী, তালেবান যোদ্ধাদের বর্তমানে আফগানিস্তানের উত্তর, উত্তর-পূর্ব এবং গজনি ও মাইদান ওয়ারদাকের মত মধ্যবর্তী প্রদেশগুলোয় শক্ত অবস্থানে রয়েছে। এছাড়াও, তারা কুন্দুজ, হেরাত, কান্দাহার এবং লস্কর গা এর মত গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলোর কাছাকাছি অবস্থান নেয়া শুরু করেছে।
তালেবান নিয়ন্ত্রণ বলতে মূলত তালেবান অধ্যুষিত বিভাগসমূহকে বোঝানো হয়েছে যেখানে প্রশাসনিক ভবন, পুলিশ হেডকোয়ার্টার ও অন্যান্য সকল সরকারি প্রতিষ্ঠান এ দখলের অন্তর্ভুক্ত।
২০০১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের বাহিনী, ন্যাটো এবং অন্যান্য আঞ্চলিক জোট তালেবানকে ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য করে। তালেবানরা ওসামা বিন লাদেন সহ ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্র আক্রমণের সাথে জড়িত অন্যান্য আল-কায়েদা ব্যক্তিবর্গকেও আশ্রয় দিয়ে আসছিলো।
এরপরের পুরো সময় আফগানিস্তানে আন্তর্জাতিক বাহিনীর উপস্থিতি, বিলিয়ন ডলারের বরাদ্দ, সরকারি বাহিনীর প্রশিক্ষণ চলমান থাকার পরেও তালেবানরা পুনরায় সংগঠিত হতে শুরু করে। দূরবর্তী অঞ্চলগুলোতে অবস্থান করে তারা ধীরে ধীরে শক্তি ও ক্ষমতা লাভ করতে থাকে। মূলত দক্ষিণ, দক্ষিণ-পশ্চিম-উত্তরের প্রদেশ হেলমন্দ, কান্দাহার, উরুজগান এবং জাবুলের প্রচলিত কেন্দ্রগুলোতে তাদের প্রভাব জোরেশোরে বিদ্যমান। এসব প্রদেশের পাশাপাশি দক্ষিণ ফরিয়াবের উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত পাহাড়সমূহ এবং উত্তর-পূর্বে অবস্থিত বাদাখশানের পর্বতসমূহেও তালেবানের প্রভাব রয়েছে।
২০১৭ সালে করা বিবিসির একটি গবেষণায় সম্পূর্ণ তালেবান নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলগুলোর কথা উঠে আসে। গবেষণায় এটিও দেখা যায় যে, উল্লেখিত অঞ্চলগুলো ছাড়াও তারা আফগানিস্তানের আরো বেশ কিছু অঞ্চলে সচল রয়েছে। কিছু অঞ্চলে তালেবানের সাপ্তাহিক বা মাসিক আক্রমণের চিত্র, বর্তমানে তাদের শক্ত অবস্থানকেই নির্দেশ করে।
রিপোর্ট অনুযায়ী, তালেবান নিয়ন্ত্রিত অঞ্চল বা যেসব অঞ্চলে প্রতিনিয়ত তাদের আক্রমণের ঘটনা ঘটছে সেসব অঞ্চলেই আফগানিস্তানের প্রায় অর্ধেক জনগোষ্ঠী অর্থাৎ ১৫ মিলিয়ন মানুষ বসবাস করে।
তালেবান কি এখন দখলে রয়েছে
যদিও তালেবানদের দখলকৃত অঞ্চলের পরিমাণ ২০০১ এর তুলনায় বেশি, তবে তারা এখনও অস্থিতিশীল অবস্থানে রয়েছে। তালেবানের চাপের মুখে আফগান সরকার কিছু বিভাগের প্রশাসনিক ভবন ইতিমধ্যে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছে, আর তালেবানরা অন্যান্য ভবন জোরপূর্বকভাবে দখল করে নিয়েছে। পাল্টা আক্রমণে সরকারি বাহিনী কিছু কিছু অঞ্চল দখলে নিতে পারলেও বেশিরভাগ অঞ্চলেই তালেবানদের সঙ্গে তাদের সম্মুখযুদ্ধ চলছে।
গত জুন মাসে যুক্তরাষ্ট্রীয় বাহিনীর আফগানিস্তান ছাড়ার কার্যক্রম শুরু হলেও এখনও কাবুলে মার্কিন বাহিনীর সদস্যরা অবস্থান করছে। একই সাথে যুক্তরাষ্ট্রের বিমান বাহিনীও গত কয়েকদিনে তালেবান জঙ্গিদের উপর বিমান হামলা চালিয়ে যাচ্ছে।
বর্তমানে আফগান সরকার সমতল এবং নদীর পার্শ্ববর্তী অঞ্চলগুলোতে তাদের প্রভাব ধরে রাখতে পেরেছে, এবং এই অঞ্চলগুলোই মূলত ঘনবসতিপূর্ণ। অপরদিকে তালেবান নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলগুলো তূলনামূলকভাবে পাহাড়-পর্বত সঙ্কুল। এসব অঞ্চলে জনবসতি কম। কিছু কিছু জায়গায় প্রতি কিলোমিটার স্কয়ারে মাত্র ৫০ জন লোকের বসবাস রয়েছে। আফগান সরকারের ভাষ্যমতে, যেসব প্রধান শহরগুলোতে তালেবানের হুমকি রয়েছে সেখানে তারা অধিক শক্তিশালী বাহিনী মোতায়েন করেছে। একই সাথে, তালেবানের নিয়ন্ত্রণ কমিয়ে আনার জন্যে পুরো দেশে মাসব্যাপী কারফিউ জারি করা হয়েছে যা মূলত রাতে বহাল থাকবে। যদিও তালেবান জঙ্গিরা হেরাত ও কান্দাহারের মত শহরগুলোতে বসতি গড়তে সক্ষম হয়েছে, তবে তারা এখনও একটিরও পূর্ণ দখল নিতে পারেনি। এলাকাভিত্তিক আধিপত্য অর্জনের মাধ্যমে সাধারণত তাদের চুক্তির আলোচনায় অবস্থান আরো জোরদার হয়ে ওঠে। একইসাথে, কর আদায় এবং যুদ্ধের সময় লুটপাটের মাধ্যমে রাজস্ব আদায়ও সহজতর হয়।
২০২১ অর্ধবছরে, তালেবান সংশ্লিষ্ট সংঘর্ষের কারণে রেকর্ড সংখ্যক সাধারণ জনগণ মৃত্যুবরণ করেছে। এছাড়াও, ১,৬০০ মানুষের মৃত্যুর জন্যে তালেবান ও অন্যান্য সরকারবিরোধী সংগঠনকে দায়ী করেছে জাতিসংঘ। এই সাংঘর্ষিক পরিস্থিতিতে প্রায় ৩ লাখ মানুষ তাদের বসতবাড়ি ছেড়ে অন্যত্র চলে যেতে বাধ্য হয়েছে।
ইউএনএইচসিআর এর মতে, তালেবানরা গ্রাম অঞ্চল দখলের ফলে বাদাখশান, কুন্দুজ, বলখ, বাঘলান এবং তখর প্রদেশজুড়ে সাধারণ মানুষের বাস্তুচ্যুত হওয়ার ঘটনা এখন দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে। একইসঙ্গে আক্রমণের সময় কিছু মানুষ পার্শ্ববর্তী বিভাগে পালিয়ে যাওয়ার পর আবার নিজের বাড়িতে ফিরেও এসেছে, অনেকেই আবার সাময়িকভাবে পালিয়ে রয়েছে বাড়ি ছেড়ে। এএফপি সংবাদ মাধ্যমের রিপোর্ট অনুযায়ী, তালেবান যোদ্ধাদের আক্রমণের কারণে আফগান সরকারি বাহিনী এবং আফগান শরণার্থীদের কেউ কেউ সীমান্ত পার হয়ে তাজাকিস্তানে গিয়ে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছে।
যদিও চলমান সংঘর্ষের কারণে আফগানিস্তানের আমদানি-রপ্তানির হিসাব স্থিতিশীল নয়, দেশটির সীমান্ত দিয়ে প্রবেশকৃত পণ্যদ্রব্যের নিয়ন্ত্রণও এখন তালেবানের হাতে।
একইসাথে, পাকিস্তানের সাথে সংযুক্ত প্রধান সীমান্ত স্পিন বলদাকসহ বেশ কিছু বর্ডারে তালবানদের নিয়ন্ত্রণ লক্ষণীয়ভাবে দৃশ্যমান। অপরদিকে, ইরান সীমান্ত ইসলাম ক্বালার দিয়ে আফগানিস্তানের আয় প্রতি মাসে ২০,০০০ ডলার এরও বেশি। এই অঞ্চল অস্থিতিশীল হয়ে ওঠায় আমদানি এবং রপ্তানি বাধাগ্রস্ত হওয়ার ফলে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি, বিশেষ করে জ্বালানি ও খাদ্যদ্রব্যের দামও অধিক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে।
- সূত্র- বিবিসি