নারী ইস্যু: তালেবান সরকার কি তাদের অতীত ভুল, হঠকারিতা ও বিপর্যয় থেকে শিক্ষা নেবে?
ট্রিলিয়ন ডলার ব্যয় ও অগণিত প্রাণহানির পরে আমেরিকান দখলদারেরা অশ্বডিম্ব প্রসব করে আফগানিস্তান থেকে বিদায় নিয়েছে। আফগানিস্তানে তালেবানরা শাসন ক্ষমতায় ফিরেছে। এই পরিস্থিতিতে অন্যান্য ভাবনার সঙ্গে যে বিশেষ ভাবনাটি মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে তা হলো, সে দেশে নারীদের ভবিষ্যৎ।
প্রথমেই বলে নেওয়া ভালো, এই ভাবনাটিও সমস্যামুক্ত নয়। ভাবনাটি এমন এক স্ট্যাটাস কো অনুসরণ করে প্রবাহিত হয় যেন, তালেবান শাসনের অবর্তমানে সেখানে নারীদের ভবিষ্যৎ ছিল নির্ঝঞ্ঝাট! বলা বাহুল্য, ব্যাপারটি মোটেও তা নয়।
বাংলাদেশের নারী হিসেবে যেখানে আমি নিজেই একটি বিপদগ্রস্ত জনগোষ্ঠীর অংশ, সেখানে আফগানিস্তানের নারীদের নিয়ে লিখতে বসার কীই-বা অর্থ থাকতে পারে, এমন চিন্তাও মনে ঘুরপাক খায়। কিন্তু আসলে নারীরা দুনিয়ার যেকোনো স্থানেই অবস্থান করুক না কেন, নারীত্বের বন্ধনে গ্রন্থিত হয়ে আছি আমরা সবাই। আর নিজেরা নিপীড়িত বলে সহমর্মিতাও বেশি অনুভব করি। আফগান নারীদের সমস্যা ও সম্ভাবনা তাই আন্তরিক আগ্রহের সৃষ্টি করে।
দশকের পর দশক ধরে বহিরাগত হস্তক্ষেপের কুফল হিসেবে একটি জনপদ নিজেদের মতো করে নিজস্ব সময়ে সামনে এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ হারিয়ে ফেলে। সবকিছুই তখন চাপিয়ে দেওয়া বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। সেই জনগোষ্ঠীর নিজের মতো সময়কে ধারণ করার স্বাভাবিক পথ রুদ্ধ করে দেওয়া হয়। বহু দশক ধরে আফগানি জনতার সঙ্গেও তা-ই হয়ে আসছে।
তালেবানদের আগেও এটা হয়েছে। তালেবানও তাদের প্রথম শাসনকালে একই কাজ করেছে এবং আমেরিকানরাও তার পুনরাবৃত্তি করেছে। অথচ, জোর করে আরোপ করা কোনো কিছু সমাজে দীর্ঘস্থায়ী ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে ব্যর্থ হয়। এটা উভয় দিক থেকেই প্রযোজ্য।
ইসলামী জীবন-ব্যবস্থার জন্য সমাজকে ধীরে ধীরে তৈরি করতে হয়। জনমানুষের মধ্যে ধর্মের রীতিনীতির প্রতি ভালোবাসা ও সামাজিক সম্মতি তৈরি হলে তবেই পরবর্তী ধাপে অগ্রসর হওয়া সম্ভব হতে পারে। জোরপূর্বক কোন কিছু চাপিয়ে দেওয়া হলে তাতে প্রায়ই হিতে বিপরীত হয়ে থাকে।
তেমনি বিপরীত দিক থেকে বললে, আপনি যদি পশ্চিমা ছাঁচে সমাজকে সাজাতে চান, তাহলে প্রথমে আপনাকে পশ্চিমা মূল্যবোধ জনমানুষের আনুকূল্যে আনার চেষ্টা করতে হবে। আপনি ভ্যাকসিনের মতো করে বিদেশি ধ্যানধারণা পুশ-ইন করতে পারেন না!
এর একটি উদাহরণ হলো, জেন্ডার সমতার ধারণা। এখানে আপনি আফগান শহুরে এলিট গোষ্ঠীকে পাশে পেলেও বৃহত্তর জনতা কিন্তু আপনাকে আজগুবি ধারণার ফেরিওয়ালা, দখলদার ভিনগ্রহী হিসেবেই দেখবে। সার্বিকভাবে সমাজকে বিভক্ত করা ছাড়া শেষমেশ এ প্রক্রিয়া থেকে আর কোনো ইতিবাচক ফলাফল আসবে না।
দুঃখজনকভাবে, আফগান জনগণের ওপর দুই বিপরীতমুখী শিবির থেকে একই আচরণ করা হয়েছে।
প্রত্যেক জনগোষ্ঠীর নিজস্ব সামাজিক-সাংস্কৃতিক বোঝাপড়া থাকে। অবশ্য বিশ্বায়নের যুগে এই নিজস্বতা অনেকটাই দ্রবীভূত ও মিশ্রিত হয়ে পড়ছে। আর রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক আধিপত্যের হাত ধরে যে সাংস্কৃতিক আধিপত্য এসে ভর করে, এটা আমরা সবাই জানি।
শক্তিমান পক্ষের মূল্যবোধ শ্রেষ্ঠত্বের দাবি নিয়ে সেখানে উপস্থিত হয়। কিন্তু উপস্থিত হলেই সবসময় তা যাপিত জীবনের অংশ হয়ে উঠতে পারে না। তালেবান-পূর্ব নারী 'স্বাধীনতার' স্বরূপ বোঝাতে যে ছবিগুলো অন্তর্জালে ঘোরাঘুরি করে, তা একটি ছোট্ট গোষ্ঠীর জীবনযাত্রার প্রতিচ্ছবি।
সেখানে সার্বিকভাবে আফগান নারীদের জীবনের ছাপ খুব কমই ফুটে থাকে। আমরা খেয়াল করলে ভালো করব যে ২০১৮ সালেও, অর্থাৎ বহুকাল তালেবান শাসনহীন পরিস্থিতিতেও খোদ কাবুলে ভোট প্রদানের ছবি দেখলে আমরা সেখানে প্রায় সব নারীকে হিজাব পরিহিতই দেখতে পাই।
ফুটবল খেলার ছবিতে আমরা দেখি দর্শক হিসেবে যেসব নারী আনন্দ করছেন, তারা প্রায় প্রত্যেকেই হিজাব পরে আছেন। ২০১৯ এর আফগান লয়া জিরগা (ঐতিহ্যবাহী আইনি কাউন্সিল)-র ছবি দেখুন, নারী ডেলিগেটরা প্রায় সবাই হিজাবি। অর্থাৎ বিভিন্ন শ্রেণির নারীদের ওপর শাসকের চাপ না থাকলেও হিজাব ঠিকই তাদের জীবনের অংশ থেকে গেছে।
প্রথমবারের তালেবান শাসনকালে ১৯৯৯ সালে মাধ্যমিক স্তরে একটি মেয়েও স্কুলগামী ছিল না! শাসন-পরবর্তী ২০০৩ থেকে ২০১৭ সময়কালে তাদের সংখ্যা ৬ শতাংশ থেকে ৩৯ শতাংশে উন্নীত হয়েছিল। তালেবানের সময়ে মাত্র নয় হাজার মেয়েশিশু প্রাথমিক শিক্ষাধীন ছিল, সেই সংখ্যা ২০০৩ সালেই ২৪ লাখে পৌঁছে যায় (শেষ হিসাব পর্যন্ত এই সংখ্যা ৩৫ লাখ)।
বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে অধ্যয়নরত জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশ নারী, কাবুল বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যাজুয়েটদের মধ্যে নারীরা একটি বড় অংশ। নারীরা পার্লামেন্টের অংশ হয়েছেন। ২০ শতাংশ সরকারি চাকরিজীবী এখন নারী (সূত্র: বিবিসি, ২০২১)। এই পরিসংখ্যানসমূহ নিঃসন্দেহে উৎসাহব্যঞ্জক।
তবে, ২০০১ সালে তালেবানদের প্রথম শাসনের অবসান হওয়ার বহু বছর পরও, হিউম্যান রাইটস ওয়াচের ২০১৭ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী দেশটির দুই-তৃতীয়াংশ মেয়ে স্কুলজীবন থেকে বঞ্চিত। ইউনিসেফ বলছে, ১২-১৫ বছর বয়সী ৬৬ শতাংশ মেয়ে স্কুলে যায় না।
কোনো কোনো প্রদেশে অবস্থা আরও করুণ, মাত্র ১৫ শতাংশ মেয়েরা স্কুলে যাচ্ছে। স্কুল-শিক্ষায় জেন্ডার প্যারিটি ইনডেক্সও খুব ভালো নয়। এর কারণ হিসেবে দারিদ্র্য, যুদ্ধাবস্থা, নিরাপত্তার অভাব, সামাজিক মানসে মেয়েদের অবস্থান, স্কুলগামী বয়সে বিয়ে, পর্যাপ্ত স্কুলের অভাব, তাঁবু-স্কুলে পানি ও স্যানিটেশনের অনুপস্থিতি ইত্যাদি নানা বিষয় জড়িত।
দারিদ্র্য যে একটি বড় ফ্যাক্টর এতে কোন সন্দেহ নেই। ২০১৬-১৭ সালের সরকারি জরিপ অনুযায়ী আফগানিস্তানের ৫৪ শতাংশ মানুষ জাতীয় দারিদ্র্য সীমার নিচে বাস করে। তুলনার সুবিধার্থে উল্লেখ্য যে, ২০১৯ সালে বাংলাদেশের ২০ শতাংশ মানুষ জাতীয় দারিদ্র্য সীমার নিচে অবস্থান করছিল।
বাস্তবতার এই প্রেক্ষাপটে তালেবানরা এবার ক্ষমতা দখল করেছে। তারা এই দফা ঠিক কী স্ট্র্যাটেজি নেবে আমরা জানি না। কিন্তু এইবার নারী ইস্যুতে তারা পূর্বের ভূমিকায় থাকতে পারবে না, এটা বলাই যায়। আফগান নারীরাই তা হতে দেবেন না বলে আমার বিশ্বাস।
তালেবান মুখপাত্রের প্রেস ব্রিফিং থেকে আশাবাদী হওয়ার সুযোগ আছে। নারী ইস্যু যে একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ, সংবেদনশীল বিষয়, এটা তারা বাস্তবিকই অনুধাবন করুক! শুধু কথায় নয়, কাজেও তার প্রতিফলন ঘটুক!
আলুর বস্তায় স্কুলের বই লুকিয়ে এনে পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার গল্প যার জীবনে আছে, দুই দশক পরে সেই ভুক্তভোগীর মনে জন্ম নেওয়া ভয় আর দুশ্চিন্তাকে আমরা হালকা করে দেখার অধিকার রাখি না। এটা ঠিক যে পশ্চিমের মিডিয়াগুলো সাধারণত পশ্চিমা বচনের সঙ্গে খাপ খায় এমন গল্পগুলোই প্রচার করে থাকে। মিডিয়ার 'বাস্তবতা' আর সত্যিকারের বাস্তবতা সবসময় মিলে যায় না।
মিডিয়া প্রেজুডিস একটি বিদ্যমান সত্য, বিশেষত ইসলাম ও মুসলিম প্রশ্নে। তাই বিপরীত দিকের জীবন্ত গল্পগুলোর স্থান হয় না সংবাদে। কিন্তু তার মানে তো এই নয় যে ভয়ের গল্পগুলো অলীক! পূর্বের অভিজ্ঞতাপ্রসূত ভয় বর্তমান সময়ের আফগান নারীদের বিচলিত করবে, এটাই স্বাভাবিক।
তাদের মননের অন্তরিত, অবিবেচিত, ছায়ামানবী হয়ে যাবার ভয় বাস্তব। পূর্বের ন্যায় শিক্ষাবঞ্চিত হবার সঙ্গত ভয় বহু নারীর মনে। তাদেরকে আশ্বস্ত করার সম্পূর্ণ দায়ভার তালেবানের ওপর ন্যস্ত।
অগ্রগতি, প্রগতির একমাত্রিক পশ্চিমা ধারণা সমস্যামূলক। পাশ্চাত্যের আধুনিকতার মাপকাঠি আর দাঁড়িপাল্লা সবখানে প্রযোজ্য নয়, হওয়া উচিতও নয়। আফগানদের তাদের মতো করে সমাজ ও দেশকে এগিয়ে নেওয়ার সুযোগ দিতে হবে এবং তা হবে আফগান নারী ও পুরুষ উভয়ের অংশগ্রহণের মাধ্যমে।
শুধুমাত্র কাবুলই তো সমগ্র আফগানিস্তান নয়! আফগান ভূমি নানা বৈচিত্র্যের ধারক ও বাহক। এর বহুবর্ণী সামাজিক-সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নিতে হবে।
ইতোমধ্যে নারীদের সামগ্রিক অবস্থার যতটা ইতিবাচক পরিবর্তন হয়েছে, তাকে ধারণ করেই আফগানিস্তানের সামনের পথ পরিক্রমা হবে এটাই প্রত্যাশা। পছন্দ করি বা না করি, আফগানিস্তানে তালেবানদের পুনঃশাসন এখনকার বাস্তবতা।
তবে এবারের তালেবান সরকার যে মাত্রায় বিশ্ববীক্ষণে থাকবে, তা হয়ত নজিরবিহীন হতে যাচ্ছে। তাদের পক্ষে পূর্বের কার্যকলাপে প্রত্যাবর্তনের অবকাশ অত্যন্ত সীমিত হবে বলেই মনে হয়, বিশেষত নারী- ইস্যুতে। এক্ষেত্রে তারা প্রজ্ঞার পরিচয় দিক! নারীদের 'অদৃশ্য' করে দিয়ে আগামীর পথে চলা কখনই সম্ভব হবে না, তাদের এ শুভবুদ্ধির উদয় হোক!
তালেবান সরকার তাদের অতীত ভুল, হঠকারিতা ও বিপর্যয় থেকে শিক্ষা নিবে, এমন ধারণা নিয়ে সামনে তাকানো যেতে পারে।
- লেখক: অধ্যাপক, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়