গারো পাহাড় থেকে গারোদেরই উচ্ছেদ করতে চায় বনবিভাগ!
পইমনি চিরাং (৪০) ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী গারো সম্প্রদায়ের একজন শারিরীক প্রতিবন্ধী নারী। তার বৃদ্ধ মা ও স্বামীকে নিয়ে শেরপুরের শ্রীবর্দির বালিজুরি খ্রিস্টান পাড়া এলাকার এক টিলার উপর কুঁড়েঘরে কোনোভাবে বসবাস করে আসছেন। বাড়ির আঙিনায়ই কিছু বরবটির গাছ লাগিয়েছিলেন নিজেদের খাবারের চাহিদা মেটাতে এবং অল্প কিছু বিক্রি করে পরিবারের খরচ চালাতে। কিন্তু গত ১২ আগস্ট পইমনির জীবনধারণের একমাত্র মাধ্যম সবজির বাগানটির গাছগুলো কেটে মাচাং ভেঙ্গে দিয়ে যায় বনবিভাগের লোকজন।
যত্নে লাগানো নিজের সবজির বাগান হারিয়ে এই নারী দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "আমরা এখানে ছোট থেকে বড় হয়েছি। তেমন কাজ করতে পারি না বলে বাড়ির আঙিনায় সবজি করেছি সেগুলোও কেটে দিয়ে গেল, আমি চলবো কীভাবে? বনবিভাগের লোকজন কোনো আগাম নোটিশ না দিয়েও সব কেটে দিয়েছে আমি খাবো কী এখন?"
তিনি কেঁদে কেঁদে বলছিলেন, "এ পাহাড়ে আমার পরিবার বেড়ে উঠেছে, আমি বড় হয়েছি এখান থেকেই আমাদের উচ্ছেদ করে দিতে চাইছে।"
শুধু পইমনিই নয় এমন ৫ টি গারো পরিবারের সবজি ও গাছের বাগান কেটে দিয়েছে বনবিভাগের কর্মকর্তারা। এতে তাদের প্রায় ৩ লাখ টাকার সবজি নষ্ট হয়েছে। যেখানে এই বাগানগুলোই ছিল তাদের একমাত্র উপার্জনের মাধ্যম।
গত ১২ আগস্ট এ ঘটনা ঘটে। সোমবার ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে দেখা যায়, শেরপুরের শ্রীবরদি উপজেলার রানী শিমুল ইউনিয়নের বালিজুরি খ্রিস্টান পাড়া এলাকার ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী গারো সম্প্রদায়ের ৫ পরিবারের তাদের বাড়ির পাশে লাগানো সবজির বাগান কেটে ফেলে সেখানে আকাশমণি গাছের চারা লাগিয়ে দিয়েছে বনবিভাগ। ক্ষতিগ্রস্ত বাগানগুলোর মধ্যে বরবটি, করলার বাগান ছিল। যেগুলোতে কেবল ফলন আসা শুরু করেছিল। এক পরিবারের একটি সুপারি বাগানের প্রায় ১০০ টি গাছও কেটে ফেলা হয়। এতে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের একমাত্র উপার্জনের মাধ্যমটি হারিয়ে শুধু আর্থিক সংকটেই নয় তারা নিজেদের অস্তিত্ব নিয়েও শঙ্কিত।
ভুক্তভোগীরা জানান, তাদের জীবনযাপন পাহাড়ের ওপর নির্ভরশীল। এখানেই তারা ফসল উৎপাদন করেন আর বনকে রক্ষা করতে গাছের চারা লাগান। এই বন থেকেই তাদের ঔষধ কিংবা পথ্য তৈরি করেন।
তারা মনে করছেন, নিজ ভূমি থেকে তাদের উচ্ছেদ করার ষড়যন্ত্রের অংশ এই ফসল কেটে ফেলা।
তারা জানান, ঘটনার দিন রেঞ্জ অফিসার এসে কোনোকিছু না বলেই গাছের মাচাগুলো ভেঙে ফেলে। গাছগুলো কেটে দেওয়া হয়।
পইমনি চিরাং বলেন, "আমার তিনমাসে ৪৫ হাজার টাকার মতো সবজি উৎপাদন হতো। এখন আমি আমার সংসার কীভাবে চালাবো?"
প্রিস কিলা ম্রং নামে একজন টিবিএসকে বলেন, "আমার মামার সুপারি বাগান কেটে দিয়েছিল। সবিতা মৃ আমার মামি উনি প্রায় ১০০ সুপারি গাছ লাগিয়েছিল সেগুলো কেটে ফেলেছে।"
সুমন সাংমা নামে একজন ভুক্তভোগী বলেন, "আমরা ১৯১০ সাল থেকে এখানে আছি। আমরা পড়াশোনা করি আর কৃষি কাজ করি। পাহাড়েই আমাদের বসবাস আর জীবনধারণ পাহাড়ের ওপরই নির্ভরশীল এখান থেকে আমাদের উচ্ছেদ করার পায়তারা চলছে।"
ঘটনার প্রতিবাদে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর লোকজন গত কয়েকদিন ধরে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করলেও কোনো সমাধান না আসায় সোমবার ও মঙ্গলবার ঢাকা থেকে নাগরিক সমাজের একটি দল এবং ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের সংগঠনের সদস্যরা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে।
পরিদর্শন শেষে তারা স্থানীয় বন কর্মকর্তা, ইউএনও ও জেলা প্রশাসকের সাথে সাক্ষাৎ করে বিষয়টি বিবেচনায় নেওয়া এবং ক্ষতিগ্রস্তদের আর্থিক সহযোগিতা করার জন্য অনুরোধ জানান।
তবে বন বিভাগ বলছে, সরকারের নির্দেশনা মানতে খাস জমি দখলমুক্ত করে বনায়নের জন্যই তারা এমনটি করেছেন।
এ বিষয়ে রেঞ্জ অফিসার (বালিজুরি) রবিউল ইসলাম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "এ এলাকায় বনবিভাগের অনেক জমি মানুষ দখল করে আছে। যাদের সবজি ক্ষেতের গাছ কাটা হয়েছে সেগুলো বনবিভাগের জমি এবং তাদেরকে সেখানে কৃষি করতে বার বার নিষেধ করা হয়েছিল।"
শেরপুরের সহকারি বন সংরক্ষক ড. প্রান্তোষ রায় টিবিএসকে বলেন, "বালিজুরি রেঞ্জে ৮৮৮ জন জবরদখলকারীর তালিকা আমরা করেছি। এ জমিগুলো উদ্ধার করতে আমার উপর সরকারি নির্দেশনা রয়েছে। আমি নির্দেশনা অনুযায়ীই কাজ করে যাচ্ছি।"
শুধু গারোদের বাগানের গাছই কাটা হয়নি উল্লেখ করে এ বন কর্মকর্তা বলেন, এখানে গারোদের ৫ টি ব্যতীত আরও ২৫ টি বাঙালি মুসলিম, হিন্দু পরিবারের দখলে থাকা জমি উদ্ধারে এ ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, "সুফল প্রকল্পের আওতায় ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের জীবনমান উন্নয়নের চেষ্টা করা হচ্ছে। তবে প্রভাবশালী একটি মহলের কারণে অনেক গারোরা অংশীদারত্বের তালিকা থেকে বাদ পড়েছেন। উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ চেষ্টা করছে সবাইকে এর আওতায় এনে কার্যক্রম এগিয়ে নেওয়ার।"
শ্রীবরদী উপজেলা নির্বাহী অফিসার নিলুফা আক্তার টিবিএসকে বলেন, "আমি ঘটনাটি জানার পরেই তাদের ওখানে যেতে চেয়েছি কিন্তু আবহাওয়া খারাপ থাকায় যাওয়া হয়নি৷ তাদের বিষয়ে জেলা প্রশাসক মহোদয় থেকে যে নির্দেশনা আসবে সেটাই পালন করা হবে।"
তিনি আরও বলেন, "গারোদের জীবনমান উন্নয়নের জন্য আমরাও কাজ করে যাচ্ছি। প্রতি বছর সরকারি ১০টি ঘর আসছে আমার উপজেলায়, সেখান থেকে তাদের মধ্যে সবচেয়ে সমস্যায় থাকা পরিবারগুলোকে এক এক করে দেওয়া হচ্ছে।"
গারোদের অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে শেরপুরের জেলা প্রশাসক মো. মোমিনুর রশীদ দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "ভুক্তভোগীরা আমাকে এর আগে তো জানায়নি। আমি জানা মাত্রই এ বিষয়ে খোঁজ নিচ্ছি। গারোদের দাবি-দাওয়া সরকারের কাছে উপস্থাপন করা হয়েছে। পরবর্তী ব্যবস্থা সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী নেওয়া হবে। তবে, শেরপুরের ৬৫ হাজার ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সদস্যদের আতঙ্কিত হওয়ার কোনো কারণ নেই। সুফল প্রজেক্টের সুফল থেকে কেউ যেন বাদ না যায়, সে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। পাশাপাশি খ্রিস্টানপাড়ায় ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণের জন্য শ্রীবরদী ইউএনওকে বলা হয়েছে।"
খ্রিস্টানপাড়ার ক্ষতিগ্রস্ত গারো পরিবারগুলোর সবজি ও গাছের বাগান পরিদর্শন শেষে তীব্র ক্ষোভ ও প্রতিবাদ জানিয়েছে নাগরিক সমাজ।
মঙ্গলবার দুপুরে শেরপুর প্রেসক্লাবে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে ৫টি প্রস্তাব উপস্থাপন করা হয়। এরমধ্যে রয়েছে, সমতলের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষের জন্য পৃথক ভূমি গঠন করা, বন বিভাগের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নেয়া, প্রথাগত ভূমি আইনে চাষাবাদ করতে দেয়া, সামাজিক বনায়নের নামে গারোদের উচ্ছেদ না করা এবং সুফল প্রকল্প পরিবেশ বান্ধব করার পাশাপাশি স্থানীয়দের অংশগ্রহণে সিদ্ধান্ত নেয়া। বনে বাস্তুসংস্থান বজায় রাখতে বন আইনের সংশোধনের প্রতিও আলোকপাত করা হয়।
সংবাদ সম্মেলনে নাগরিক সমাজের পক্ষে অন্যান্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. জোবায়দা নাসরিন, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ফারহা তানজীম তিতিল, বাংলাদেশ আদিবাসী নারী নেটওয়ার্কের সদস্য সচিব চঞ্চনা চাকমা, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের ভূমি ও আইন বিষয়ক সম্পাদক এবং কাপেং ফাউন্ডেশনের প্রোগ্রাম ম্যানেজার উজ্জল আজিম, এসোসিয়েশন ফর ল্যান্ড রিফর্ম এন্ড ডেভেলপমেন্টের (এএলআরডি) কর্মসূচি কর্মকর্তা (আইন) একেএম বুলবুল আহমেদ প্রমুখ।
তারা বলেন, এ ধরনের অন্যায় কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। তারা যেখানে বনকে সংরক্ষণ করছে সেখানে তাদেরকে বন ধ্বংসের তকমা দেওয়া হচ্ছে। যেটা নিতান্তই লজ্জার।