পিছিয়ে পড়াদের জন্য দুর্গম পাহাড়ে ভিন্নধর্মী শিক্ষা
কারও মা নেই, কারও নেই বাবা। কোনো শিশুর বাবা-মা কেউ নেই। সমাজের একেবারে অসহায়, প্রান্তিক এবং সুবিধাবঞ্চিত অনাথ শিশুদের ঠাঁই মিলেছে ‘কোয়ান্টাম কসমো’ স্কুলে। পাহাড় এবং সমতলের ২২ জনগোষ্ঠীর শিশু শিক্ষার্থীরা এখানে সম্পূর্ণ বিনা খরচে লেখাপড়ার পাশাপাশি থাকা-খাওয়ারও সুবিধা পাচ্ছে। বিশেষ করে পাহাড়ের দুর্গম এলাকার সুবিধাবঞ্চিত এবং সমতলের অনাথ-দুস্থ শিশুদের ভর্তির ক্ষেত্রে এখানে প্রাধান্য দেওয়া হয়। আর তাদের জন্য গড়ে তোলা হয়েছে সম্পূর্ণ আবাসিক শিক্ষা ব্যবস্থা।
শিশু শ্রেণি থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত ভর্তি হয়ে আধুনিক সব সুযোগ-সুবিধা ও প্রকৃতির মনোরম পরিবেশে বড় হয়ে উঠছে প্রত্যেকেই। কেবল লেখাপড়াই নয়, সুস্থ শারীরিক গঠন ও মানসিক বিকাশের জন্য রয়েছে খেলাধুলার মাঠ ও সাংস্কৃতিক চর্চার ব্যবস্থাও। সব শ্রেণি ও ধর্মাবলম্বী শিশুদের জন্য আলাদা করে ধর্ম শিক্ষা দেওয়া হয়। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রে যোগ হচ্ছে বিভিন্ন সাফল্যও। পাহাড়ে ব্যতিক্রম এবং ভিন্নধর্মী এমনই একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বান্দরবানের লামা উপজেলার সরই ইউনিয়নের ‘কোয়ান্টাম কসমো স্কুল অ্যান্ড কলেজ’।
শুরুর কথা
১৯ বছর আগে অন্ধকার এক জনপদের নাম ছিল সরই এলাকা। একদিকে রীতিমতো দুর্গম পাহাড়ি এলাকা অন্যদিকে অজপাড়া গাঁ। লামা উপজেলা সদর থেকে এর দূরত্ব ৩০ কিলোমিটার। আবার বান্দরবান জেলা শহর থেকেও ৪০ কিলোমিটার দূরের রাস্তা।
১৯৯৮ সালে রাজধানীর কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে ওই এলাকায় প্রথমে প্রতিষ্ঠিত হয় কোয়ান্টাম মেডিটেশন সেন্টার। এর তিন বছর পরই পাহাড়ি ও বাঙালির অসহায়-দুস্থ স্থানীয় সাত শিশুকে নিয়ে চালু করা হয় কোয়ান্টাম কসমো স্কুল। কিন্তু কয়েক বছরেই আশানুরূপ পরীক্ষা ফলাফল এনে দেয় এই স্কুলের প্রথম ব্যাচের কয়েকজন শিক্ষার্থী। শুরুর কয়েক বছরে চমকপ্রদ এমন পরীক্ষার ফলাফলে কোয়ান্টাম কর্তৃপক্ষের ধারণা হয়, যতই প্রান্তিক ও সুবিধাবঞ্চিত হোক, প্রত্যেক শিশু উপযুক্ত শিক্ষার পরিবেশ ও সুুযোগ পেলে নিজেকে মেলে ধরতে পারে মেধাবী হিসেবে। সে অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে স্কুল কর্তৃপক্ষ ধীরে ধীরে প্রসারিত করতে থাকে কোয়ান্টাম কসমো স্কুলের শিক্ষা কার্যক্রম।
সাত থেকে দু’হাজার
২০০১ সালে সাত অনাথ শিশুকে নিয়ে যাত্রা শুরু কোয়ান্টাম স্কুলের। অবকাঠামো বলতে ছিল বাঁশের বেড়া ও টিনের চালের ঘর। দুর্গম তো বটেই, যাতায়াতের রাস্তাও ছিল ভাঙাচোরা। ছিল না কোনো বিদ্যুতের ব্যবস্থাও। সে অন্ধকার জনপদ এখন দুই হাজার শিক্ষার্থীর পদচারণায় মুখর। ৩৫০ একরজুড়ে কোয়ান্টাম স্কুলের শিক্ষার্থীদের জন্য রয়েছে মাঠ, আবাসিক হল, জিমনেসিয়াম, ধ্যানের কেন্দ্র, চিকিৎসা কেন্দ্র এবং যার যার ধর্মের প্রার্থনা কেন্দ্রও।
ছেলে ও মেয়েদের জন্য আলাদা করে গড়ে তোলা হয়েছে ছয়টি আবাসিক হল। এ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিশু থেকে পঞ্চম শ্রেণির ছেলে শিক্ষার্থীদের সংখ্যা ৭০০ জন এবং মেয়েদের সংখ্যা ৩০০ জন। ৬ষ্ঠ থেকে ১০ম শ্রেণি পর্যন্ত ছেলেদের সংখ্যা ৬০০ জন এবং মেয়েদের সংখ্যা ১০০ জন। উচ্চ মাধ্যমিকে ছেলেদের সংখ্যা ১৭০ এবং মেয়েদের সংখ্যা ২০ জন। কারিগরি বিভাগে রয়েছে ২০০ জন শিক্ষার্থী।
সুস্বাস্থ্যের জন্য মানসম্মত খাবার
কোয়ান্টাম স্কুল এবং কলেজের শিক্ষার্থীদের মাঝে পরিবেশন করা হয় স্বাস্থ্যসম্মত খাবার। সকালে প্রত্যেক শিক্ষার্থীদের দেওয়া হয় কাঁচা ছোলা। তিন বেলা ভাতের সঙ্গে রয়েছে ডাল, সবজি ও ডিম। এরপর তালিকা অনুযায়ী কোনো বেলায় থাকে মাছ, মাংস। সাধারণত শিশু বয়সে ভর্তির সময় তারা থাকে অপুষ্টিতে। এ কারণে বাড়তি যত্ন নেওয়া প্রয়োজন পড়ে। নিয়মিত ফলের তালিকায় থাকে পেঁপে ও কলা। এগুলোর বাইরে শিশুদের খাওয়ানো হয় বিভিন্ন মৌসুমভিত্তিক ফল।
বড় সাফল্য খেলাধুলায়
কোয়ান্টাম স্কুলে সবচেয়ে বড় সাফল্য এসেছে খেলাধুলার হাত ধরে। ২৮টি ইভেন্টে খেলাধুলার প্রশিক্ষণ পাচ্ছে শিক্ষার্থীরা। এর মধ্যে অন্যতম হলো হ্যান্ডবল, খো খো, আর্চারি, কাবাডি, টেবিল টেনিস, অ্যাথলেটিক্স এবং জিমন্যাস্টিকস। এর জন্য দেশ-বিদেশ থেকে নেওয়া হয়েছে দক্ষ প্রশিক্ষক।
সর্বশেষ ২০১৯ সালে নেপালে অনুষ্ঠিত সাফ গেমসে খো খো ইভেন্টে কোয়ান্টাম কলেজ শাখার শিক্ষার্থীরা জিতে নিয়েছে রৌপ্য পদক। ২০১৫ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত রাজধানীতে স্বাধীনতা দিবসে শিশু-কিশোরদের কুচকাওয়াজে টানা চার বছর প্রথম হয়েছে কোয়ান্টামের শিক্ষার্থীরা। এ ছাড়া ২০১৭-১৮ সালে ক্রীড়ানৈপুণ্যের ভিত্তিতে ‘দেশসেরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান’ স্বীকৃতি পেয়েছে টানা দুই বার। ২০১৩ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত গত চার বছরে বয়সভিত্তিক জাতীয় জিমন্যাস্টিক প্রতিযোগিতায় সাফল্যের তালিকায় যোগ হয়েছে কোয়ান্টাম স্কুলের মোট ৭৭টি স্বর্ণপদক।
সংস্কৃতি চর্চা
দুর্গম পাহাড়ে কোয়ান্টাম কসমো স্কুল এমনই একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, যেখানে বাঙালি ছাড়াও পাহাড় এবং সমতলের ২১টি ভাষাভাষীর শিশু শিক্ষার্থীরা পড়াশোনারসুযোগ পাচ্ছে। যার যার সংস্কৃতি চর্চারও সুযোগ পাচ্ছে তারা। সামাজিক উৎসবগুলোতে নিজেদের ঐতিবাহী পোশাকে আয়োজন করা হয় বিভিন্ন নাচ-গানের অনুষ্ঠান।
উচ্চ শিক্ষায় ওরা ২৩ জন
শুরুটা প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের জন্য হলেও ২০১২ সালে প্রতিষ্ঠা করা হয় কলেজ শাখা। এরপর ভালো ফলাফল পেয়ে উচ্চ শিক্ষাতেও টিকে যায় তারা। কেবল ২০১৮ সালেই উচ্চ শিক্ষায় ভর্তি হয় ২৩জন। এর মধ্যে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ১১ জন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাত জন, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন, চট্টগ্রাম বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন এবং বিভিন্ন মেডিকেল কলেজে ভর্তি হয় তিনজন।
সাফল্যের উৎস শৃঙ্খলা
এই প্রতিষ্ঠানের বিশেষ বৈশিষ্ঠ্য হলো শৃঙ্খলা। পরীক্ষার ফলাফল থেকে শুরু করে বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় সাফল্যের পেছনে অবদান রেখেছে প্রতিষ্ঠানের শৃঙ্খলাবোধ জীবন। প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে নিয়ম ও শৃঙ্খলার মধ্যে চলতে হয়। এ ব্যাপারে শিক্ষার্থীদের জন্য তৈরি করা হয়েছে সুনির্দিষ্ট একটি রুটিন, যার কারণে প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠতে হয় ভোর পাঁচটায়। সাড়ে সাতটায় সকালের খাবার খেয়ে আটটার মধ্যে যেতে হয় স্কুলে। দুপুর একটা থেকে বিকেল পাঁচটায় খাবার গ্রহণ, বিশ্রাম ও খেলাধুলা। ঘড়ির কাটায় সন্ধ্যা ৬টা ৩০ বাজলে দেওয়া হয় রাতের খাবার। এরপর শ্রেণি শিক্ষকদের নিবিড় যত্নে রাত ৯টা ৩০মিনিট পর্যন্ত চলে ক্লাসে পড়ানো বিষয় নিয়ে পুনর্মূল্যায়ন। সবশেষে রাত ১০টায় শিক্ষার্থীদের আবার দেওয়া কিছু হালকা নাস্তা। ১০টা ৩০ মিনিটে ঘুমাতে হয় সব শিক্ষার্থীদের। ছোটবেলা থেকে এভাবে সুনির্দিষ্ট নিয়ম ও শৃঙ্খলা মেনে বড় হচ্ছে প্রতিটি শিক্ষার্থী। এ ছাড়া বিনোদনের জন্য বয়সভেদে প্রতি শুক্রবারে দেখানো হয় শিশুতোষবিষয়ক চলচ্চিত্র এবং শিক্ষামূলক নাচ-গানের অনুষ্ঠান।
অসুস্থতায় চিকিৎসাসেবা কেন্দ্র
শিক্ষার্থীদের কেউ অসুস্থ হলে কোনো ক্লিনিক বা হাসপাতাল নয়। খোদ স্কুলের ভেতরে গড়ে তোলা হয়েছে চিকিৎসা সেবাকেন্দ্র। সেখানে কয়েকজন চিকিৎসক সার্বক্ষণিক দায়িত্বে রয়েছেন। নিয়মিত পরীক্ষা করে দেখা হয় শিশু শিক্ষার্থীদের। কেবল বড় কোনো অসুখ হলেই ভর্তি করতে হয় হাসপাতালে।
ক্লাসে প্রথম, জীবনেও প্রথম
কোয়ান্টামের এতসব আয়োজন শুধু পরীক্ষার ফলাফলের জন্য নয়। এখানে প্রত্যেক শিক্ষার্থীদের একজন পূর্ণাঙ্গ ও মানবিক মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা হয়। শেখানো হয় সততা ও নৈতিকতার চর্চা। লেখাপড়া ছাড়াও মানসিক দক্ষতার প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় নিয়মিত। প্রত্যেক শ্রেণির ক্লাসে নেওয়া হয় ‘লাইফ স্কিল সায়েন্স ক্লাস’। মানসিক স্থিরতা চর্চা হিসেবে সপ্তাহে একবার করে মেডিটেশনের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। যেখানে বর্তমান সময়ে অভিভাবকরা সন্তানদের পরীক্ষার ফলাফলকেই গুরুত্ব দিয়ে নৈতিক ও মানবিকবোধ জায়গায় পিছিয়ে পড়ছে, সেখানে এই স্কুল কর্তৃপক্ষ মানবিকতাকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দিচ্ছে।
বিশিষ্টজনদের পদচারণা
কোয়ান্টাম স্কুল পরিদর্শনে এসেছেন দেশের বিশিষ্টজনেরাও। লেখাপড়ার পাশাপাশি একজন শিশুকে মানসিক ও শারীরিকভাবে গড়ে তোলায় শিক্ষকদের আন্তরিক প্রচেষ্টায় মুগ্ধ হয়েছেন তারাও। এ পর্যন্ত কোয়ান্টাম স্কুল পরিদর্শন করেছেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ, জাতীয় অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান, ব্যারিস্টার এম আমীর-উল ইসলাম, জাতীয় অধ্যাপক ডা. নুরুল ইসলাম, কবি ও লেখক সৈয়দ শামসুল হক, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব কামাল লোহানী, জাতীয় অধ্যাপক ব্রিগেডিয়ার (অব.) ডা. আবদুল মালিক, জাতীয় অধ্যাপক ডা. এম আর খান, লেখক ও কলামিস্ট সৈয়দ আবুল মকসুদ, বিজ্ঞানী ড. এম শমসের আলী এবং সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব মুস্তাফা জামান আব্বাসী।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সার্বিক বিষয়ে কোয়ান্টাম স্কুল শাখার ইনচার্জ ও কলেজ শাখার অধ্যক্ষ সালেহ আহমেদ দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, শিশু পর্যায় থেকে প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে আলোকিত ও বিকশিত করার সর্বাত্মক উদ্যোগ রয়েছে। এ ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকার জন্য সাংস্কৃতিক চর্চা ও খেলাধুলাকে বিশেষ প্রাধান্য দেওয়া হয়। শুধু পরীক্ষার ভালো ফলাফলের দিকে নয়, একজন পূর্ণাঙ্গ ও মানবিক মানুষ হিসেবে গড়ে তোলাই এ প্রতিষ্ঠানের প্রধান লক্ষ্য।
(https://tbsnews.net/bangladesh/education/extraordinary-school-less-fortunate-kids-39121)