আসলে কী পরিমাণ মার্কিন সামরিক সরঞ্জামাদি তালেবানের দখলে গেছে?
সম্প্রতি সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প আফগানিস্তান থেকে সব মার্কিন সামরিক সরঞ্জামাদি ফিরিয়ে আনার দাবি তুলেছেন। তবে এই দাবি তোলার সময় এসব সরঞ্জামাদির পেছনে ৮৫ বিলিয়ন ডলার খরচ হয়েছে বলে তিনি উল্লেখ করেন। বিগত ক'দিন ধরে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমেও যুক্তরাষ্ট্রের ৮২ বিলিয়ন ডলার সমমূল্যের সামরিক সরঞ্জামাদি তালেবানের দখলে গেছে এমন খবর প্রকাশিত হয়েছে।
তবে তালেবানের হাতে মার্কিন সরঞ্জামাদি গেলেও তা ৮২ বিলিয়ন ডলারের নয়, দেশটিতে আফগান মিলিটারি ও পুলিশদের প্রশিক্ষণ দেওয়া, বাসস্থানের ব্যবস্থা করা ও সামরিক সরঞ্জামাদি কেনা- বিগত ২০ বছর ধরে এ সব মিলিয়ে খরচ হয়েছে এ ৮২ বিলিয়ন ডলার। সামরিক সরঞ্জামাদি কেনার অর্থ এ সম্পূর্ণ হিসাবের একাংশ মাত্র। ঠিক কী পরিমাণ অর্থের সামরিক সরঞ্জামাদি তালেবানের দখলে গেছে তা এই মুহূর্তে এসে কেউই বলতে পারছে না।
৮২.৯ বিলিয়ন বা ৮৩ বিলিয়নের এই সংখ্যার কথা জানা যায় গত জুলাইতে স্পেশাল ইনস্পেক্টর জেনারেল ফর আফগানিস্তান রিকনস্ট্রাকশনের (সিগার) ত্রৈমাসিক প্রতিবেদনে। প্রতিবেদনটিতে বলা হয়, ২০০১ সাল থেকে এ পর্যন্ত আফগানিস্তান সিকিউরিটি ফোর্সেস ফান্ডে সবকিছু মিলিয়ে খরচ হয়েছে এই অর্থ।
আফগান নিরাপত্তা বাহিনীর খরচ ছাড়াও বিগত ২০ বছরে আফগান সরকারকে শক্তিশালী করতে খরচ করেছে ৩৬ বিলিয়ন ডলার। সব মিলিয়ে আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের মোট খরচ ১৪৪ বিলিয়ন ডলারের মতো।
আফগান জাতীয় প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা বাহিনীর পেছনে যুক্তরাষ্ট্র দুই দশকে খরচ করেছে এই ৮৩ বিলিয়ন ডলার। এরমধ্যে ১৯ বিলিয়ন খরচ হয়েছে ২০০২ সাল থেকে ২০০৯ সালের মধ্যে।
২০১৭ সালে ইউএস মার্কিন নিয়ন্ত্রক সংস্থা গভর্নমেন্ট অ্যাকাউন্টেবিলিটি অফিসের (জিএও) প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০০৫ সাল থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত আফগান নিরাপত্তা বাহিনীর পেছনে যুক্তরাষ্ট্র যে পরিমাণ অর্থ খরচ করেছে তার ২৯ শতাংশ খরচ হয়েছে সামরিক সরঞ্জামাদি ও যাতায়াতের পেছনে।
এই হিসাব অনুযায়ী, ২০ বছর সময়কালে আফগান প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা বাহিনীকে সামরিক সরঞ্জামাদি দেওয়ার জন্য যুক্তরাষ্ট্র খরচ করেছে ২৪ বিলিয়ন ডলার। জিএও'র তথ্যমতে, আনুমানিক ৭০ শতাংশ সরঞ্জামাদি দেওয়া হয়েছে আফগান মিলিটারিকে, বাকিগুলো আফগান পুলিশকে।
২০০৫ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের করদাতাদের অর্থে ৭৬ হাজার যানবাহন, ৬ লাখ অস্ত্র, ২০০'র বেশি এয়ারক্রাফট কেনা হয়েছে। এরমধ্যে অনেক সরঞ্জামাদিই নষ্ট ও ধ্বংস হয়েছে বা বর্তমানে ব্যবহারপযোগী নেই।
স্পেশাল ইনস্পেক্টর জেনারেল ফর আফগানিস্তান রিকনস্ট্রাকশনের (সিগার) প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২১১টির মধ্যে ১৬৭টি এয়ারক্রাফট বর্তমানে ব্যবহারযোগ্য। তবে এসব এয়ারক্রাফট চালানোর জন্য আফগান এয়ার ফোর্সের দক্ষ পাইলট খুব বেশি নেই। এর অন্যতম কারণ, পাইলটদের টার্গেট করে হত্যা করতো তালেবান।
এছাড়াও, এয়ারক্রাফটগুলোর রক্ষণাবেক্ষণের জন্য পর্যাপ্ত দক্ষ কর্মী ছিল না। সিগারের প্রতিবেদনটিতে আরও বলা হয়েছে, প্রতিনিয়ত রক্ষণাবেক্ষণের ব্যবস্থা ছাড়া এসব এয়ারক্রাফট মাত্র কয়েক মাসের মতো যুদ্ধে ব্যবহারের জন্য উপযোগী থাকতে পারে।
তালেবানের ক্ষমতা দখলের পর বেশকিছু ব্ল্যাক হক হেলিকপ্টারও দখল করেছে তারা। আশরাফ গনির অনুরোধে এ বছর যুক্তরাষ্ট্রের পাঠানো একটি হেলিকপ্টারও আছে এরমধ্যে।
এদিকে আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের পর আফগান নিরাপত্তা বাহিনীকে দেওয়া এসব সরঞ্জাম তালেবানের দখলে গেছে। তবে ইউএস সেন্ট্রাল কমান্ডের প্রধান জেনারেল কেনেথ এফ. ম্যাকেনজি জুনিয়র জানিয়েছেন, ৩০ আগস্ট কাবুল ছেড়ে আসার আগে মার্কিন সেনাবাহিনী ৭০টি এমআরএপি গাড়ি, ২৭টি হামভিস গাড়ি ও ৭৩টি এয়ারক্রাফট অকেজো করে দিয়ে এসেছে।
"আর কখনোই এসব এয়ারক্রাফট উড়তে পারবে না। কেউই আর এগুলো চালাতে পারবে না," বলেন তিনি।
সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের অ্যান্থনি এইচ. কোর্ডসম্যান জানান, গত কয়েক সপ্তাহের ঘটনার পর বর্তমানে ঠিক কতো সংখ্যক সরঞ্জামাদি তালেবানের হাতে রয়েছে তার প্রকৃত হিসাব কারো কাছে নেই। এছাড়াও, এর আগেও আফগানিস্তানের অনেক অঞ্চলে এর প্রকৃত হিসাব রাখা সম্ভব ছিল না বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছিল সিগার।
তিনি আরও জানান, দখল করা বাদবাকি যাননাহন ও এয়ারক্রাফট চালাতে বেশ ঝামেলার মুখে পড়বে তালেবান।
দুই দশক ধরে আফগান নিরাপত্তা বাহিনীকে সামরিক সরঞ্জামাদি দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের পর ট্যাঙ্ক, গাড়ি, হেলিকপ্টারসহ বিভিন্ন সরঞ্জামাদি তালেবানের দখলে গেছে। এসব সরঞ্জামাদির প্রকৃত মূল্য এখনো স্পষ্ট নয়। তবে স্পেয়ার পার্টস যোগাড় করতে না পারলে এসব সরঞ্জামাদিও খুব বেশিদিন ব্যবহার করতে পারবে না তালেবান।
তবে এসব সরঞ্জামাদির মূল্য কোনোভাবেই ৮০ বিলিয়নের ঘরে নয়। ২০ বছর ধরে আফগান মিলিটারিকে প্রশিক্ষণ দেওয়াসহ টিকিয়ে রাখতে সম্মিলিতভাবে এ পরিমাণ অর্থ খরচ করা হয়েছে। ২৪ বিলিয়ন ডলারের সামরিক সরঞ্জামাদিও কম নয়, তবে উপরোল্লিখিত বিষয়গুলোর বিবেচনায় বলা যায়, ২৪ বিলিয়ন ডলারেরও অনেক কম পরিমাণ অর্থের সরঞ্জামাদি তালেবানের দখলে গেছে।
- সূত্র: দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট