আফগানিস্তান ইস্যুতে পশ্চিমাদের কাছে নিজেকে অপরিহার্য প্রমাণ করাই ছিল কাতারের মূল লক্ষ্য
আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনা সম্পূর্ণভাবে প্রত্যাহারের পর থেকেই বিশ্বের শীর্ষ কূটনৈতিকদের প্রধানতম গন্তব্য হয়ে উঠেছে কাতার। দীর্ঘদিন ধরে তালেবানের সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যম থাকা উপসাগরীয় দেশটি এখন পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে কাবুলের নতুন শাসকগোষ্ঠীর আবশ্যক মধ্যস্ততার মাধ্যম হয়ে উঠেছে। এই পরিস্থিতি কোন আকস্মিক দুর্ঘটনার ফলে হয়নি, বরং দোহার দীর্ঘদিনের কৌশলের ফসল।
আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিশ্লেষকরা মনে করেন, নিজ নিরাপত্তা জোরদার করার স্বার্থেই ক্ষুদ্র অথচ সম্পদশালী রাষ্ট্র কাতার অত্যন্ত সুকৌশলে আফগানিস্তানে নিজেদের প্রধান মধ্যস্ততাকারী হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে সফল হয়েছে। হয়ে উঠেছে তালেবানের সাথে আন্তর্জাতিক সংলাপের নির্ভরযোগ্য মাধ্যম।
কাতারের বিত্তের প্রধান উৎস পেট্রোলিয়ামের সুবিশাল মজুদ। বিশ্বের প্রধান তরলীকৃত জ্বালানি গ্যাসের উৎপাদক ভূখণ্ডটি আসলে মরুভূমি বেষ্টিত ক্ষুদ্র উপদ্বীপ । মাথাপিছু আয়ে বিশ্বের শীর্ষতম ধনী দেশগুলোর একটি। অধিবাসীর সংখ্যা প্রায় ৩০ লাখ হলেও, তাদের ৮৫ শতাংশই আবার কর্মী ভিসায় আসা বিদেশী নাগরিক।
তবে দীর্ঘকাল ধরে দেশের আয়তনের চাইতে বড় উচ্চাভিলাষী লক্ষ্য রয়েছে কাতারি শাসক পরিবারের। মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় বিমান ঘাঁটি ও বিশ্বের অন্যতম প্রভাবশালী টেলিভিশন চ্যানেল (আল জাজিরা) এদেশেই অবস্থিত।
২০১১ সালের আরব বসন্তের সময় থেকেই মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন গণতন্ত্রপন্থী আন্দোলন ও বিদ্রোহী গোষ্ঠীকে সমর্থনদানের মাধ্যমে আঞ্চলিক প্রভাব বিস্তারের এক বিপুল চেষ্টা চালায় দেশটি। বিপরীতমুখী নীতির কারণে এতে ক্ষুদ্ধ হয় কাতারের নিকটতম প্রতিবেশী সংযুক্ত আরব আমিরাত ও সৌদি আরব। মিত্র হিসেবে মিশরের নতুন শাসক আব্দেল ফাত্তাহ আল সিসিকে সঙ্গে নিয়ে কাতারের ওপর বাণিজ্যিক ও কূটনৈতিক অবরোধ দেয় দেশগুলো। প্রতিবেশী দেশটিকে বিচ্ছিন্ন করার আসুরিক এক চেষ্টা করে বৃহৎ আরব রাষ্ট্রগুলো।
সেই অবরোধ কাতারের শাসকদের উচ্চাকাঙ্খায় লাগাম দেয়নি। পরবর্তীতে সৌদি জোট অবরোধ প্রত্যাহার করে চলতি বছরই কাতারের সাথে বিরোধ অবসানের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করে। কূটনীতিক এ দ্বৈরথেও কাতারকে স্পষ্ট বিজয়ী মনে করছেন অনেক পর্যবেক্ষক। ২০২২ সালে দেশটি বিশ্বকাপ ফুটবলও মহাসমারোহে আয়োজন করতে চলেছে।
মধ্যপ্রাচ্যের কিছু দেশে সম্পৃক্ততার কৌশল ফল না দিলেও, আফগানিস্তানে দেশটির কূটনৈতিক তৎপরতা কাতারের জন্য বড় পরিসরে লাভবান হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে। ২০১৩ সালে তালেবানকে নিজ ভূমিতে প্রথম আন্তর্জাতিক দপ্তর খোলার অনুমতিদানের মাধ্যমে এ কৌশলের সূচনা করে দোহা।
তালেবানের এ অফিসের মাধ্যমেই শান্তি আলোচনার সূত্রপাত করে যুক্তরাষ্ট্র, যার ফলে গতবছর উভয়পক্ষের মধ্যে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের চুক্তিটি সম্পন্ন হয়।
এব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ভিত্তিক থিঙ্ক ট্যাঙ্ক আরব গালফ স্টেটস ইনস্টিটিউটের জ্যেষ্ঠ আবাসিক গবেষক ক্রিস্টিন দিওয়ান মন্তব্য করেন, "কূটনীতিক মধ্যস্ততার ধৈর্যশীল পদক্ষেপটি ছোট্ট একটি রাষ্ট্রের জন্য ছিল আন্তর্জাতিক প্রভাব অর্জনের সফল এক ধ্রুপদী কৌশল।"
তিনি বলেন, "জনসংখ্যার বিচারে দেশটির সামনে সামরিক শক্তি প্রদর্শনের বা ব্যবহারের সুযোগ অত্যন্ত সীমিত। কিন্তু, আন্তর্জাতিক স্তরে বিভিন্ন পক্ষ- বিশেষ করে পশ্চিমা বিশ্ব ও ইসলামপন্থী গোষ্ঠীগুলোর সম্পর্ক রক্ষা করে, কাতার নিজের গুরুত্ব বাড়িয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের মতো পরাশক্তি এসব গোষ্ঠীর সঙ্গে সরাসরি আলোচনা করাকে অস্পৃশ্য বলে মনে করে, তাই কাতারের মাধ্যমে যোগাযোগ এক্ষেত্রে গুরুত্ব পায়।"
মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের পর তালেবানের প্রতিহিংসার ঝুঁকিতে থাকা এক লাখ ২৪ হাজার আফগান ও বিদেশী নাগরিককে বিমানে দেশটি থেকে নিয়ে আসা হয়। এর মধ্যে ৫৮ হাজার জন আসতে পেরেছেন কাতারের মধ্যস্ততায়। এ ঘটনা যুক্তরাষ্ট্রে ও তালেবান উভয় পক্ষের কাছে কাতারের গ্রহণযোগ্যতা তুলে ধরে।
কাবুল থেকে যুক্তরাষ্ট্র ও তার ইউরোপীয় মিত্র দেশগুলোর সরিয়ে আনা দূতাবাস কর্মীদের অনেকেরই অস্থায়ী ঠিকানা হয়েছে কাতার। বিশেষত, বিদেশী দূতাবাসে কর্মরত আফগান কর্মীরা আপাতত কাতারে অবস্থান করছেন। একইসঙ্গে, তালেবানের সঙ্গে পশ্চিমা বিশ্বের নতুন করে যোগাযোগ রক্ষার উৎসও কাতার।
"সাহায্যের হাত বাড়িয়েছে"
"আগামীদিনেও কূটনীতিক প্রচেষ্টা এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে কাতার আমাদের সহযোগী হবে। কারণ, দীর্ঘদিন ধরেই দেশটি আফগানিস্তান ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়েছে," – চলতি সপ্তাহে কাতার সফরকালে একথা বলেছেন মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী লয়েড অস্টিন।
জ্যেষ্ঠ একজন কাতারি কর্মকর্তা জানান, তার দেশ একটি নিরপেক্ষ মধ্যস্ততাকারী। কাতার সকল পক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করে আফগানিস্তানের মানুষের মুক্তির লক্ষ্যে কাজ করছে এবং "আঞ্চলিক সন্ত্রাসবাদ প্রতিহত করে ভবিষ্যতে এ অঞ্চলে যেকোন প্রকার অস্থিতিশীলতা এড়াতে চায়।"
ইতোমধ্যেই ঘনিষ্ঠ মিত্র তুরস্কের সাথে তালেবানকে কাবুল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর সচল করার সহযোগীতা দিয়েছে কাতার, ফলে সেখান থেকে মানবিক উদ্ধার তৎপরতা ও অভ্যন্তরীণ ফ্লাইট শুরু হয়েছে।
আবার বিদেশী সেনাদের ব্যতিব্যস্ত হয়ে আফগানিস্তান ছাড়ার গোলযোগপূর্ণ মুহূর্তে সেদেশে দায়িত্বপ্রাপ্ত কাতারি কূটনৈতিকরা পলায়মান অনেক আফগানকে তালেবান চেকপোস্ট পাড়ি দিয়ে সপরিবারে বিমানবন্দরে পৌঁছাতে সাহায্য করেছেন।
মধ্যপ্রাচ্যের ছোট্ট রাষ্ট্র কাতার চারপাশে আরও অনেক অস্ত্রসজ্জিত ভিন্ন মতাদর্শের রাষ্ট্র-বেষ্টিত। তাই উচ্চাকাঙ্খী কূটনীতির মাধ্যমে নিজ স্বার্বভৌমত্ব রক্ষার প্রয়োজনীয়তাও অনেক আগে থেকেই অনুভব করেছে।
ট্রাম্প প্রশাসনের নীরব অনুমোদনে চার বছর আগে যখন সংযুক্ত আরব আমিরাত, সৌদি আরব, মিশর ও তাদের অন্যান্য মিত্র আরব রাষ্ট্র অবরোধ আরোপ করে, সে সময়ে প্রাথমিকভাবে এক দুর্ভোগে পড়েছিল কাতার।
প্রতিবেশী দেশগুলো সুন্নি মুসলিম অধ্যুষিত কাতারের ওপর মধ্যপ্রাচ্যের ইসলামী গোষ্ঠীগুলোকে সমর্থন দান ও ইরানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক স্থাপনের অভিযোগ তোলে। সৌদি আরব ও তাঁর মিত্ররা কাতারে সামরিক অভিযান চালাতে পারে এমন আশঙ্কাও করেন অনেক আঞ্চলিক বিশেষজ্ঞ। তবে রিয়াদ বরাবর এমন পরিকল্পনা অস্বীকার করেছে। তাতে করে কাতারের নিরাপত্তাহীনতার অনুভূতি বিন্দুমাত্র কমেনি, বরং বেড়েছে।
অবরোধের সময়কালীন ৩০ হাজার কোটি ডলারের সুবিশাল রাষ্ট্রীয় তহবিল থাকায় অর্থনৈতিক সংকট থেকে রক্ষা পায় কাতার। তবুও, চলতি বছরের জানুয়ারিতে বিরোধ নিস্পত্তির আগপর্যন্ত নিজেদের অবস্থানেই অটল ছিল রাষ্ট্রটি।
সিঙ্গাপুর ভিত্তিক রাজারত্নম স্কুল অব ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের জ্যেষ্ঠ ফেলো জেমস ডর্সে বলেন, তবে কাতার এ বিরোধ থেকে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে প্রভাবশালী বন্ধুত্ব থাকার গুরুত্বকেও নতুন করে উপলদ্ধি করে। বুঝতে পারে পশ্চিমা বিশ্বের প্রয়োজন মেটাতে পারলে লাভবান হওয়া যায়।
তিনি ব্যাখ্যা করেন, "বিষয়টি প্রভাব অর্জনের পাশাপাশি প্রাসঙ্গিকতারও, বহিঃশক্তির একান্ত প্রয়োজনে সাহায্য করলে, বিপদে পড়লে তারাও আপনার পাশে এসে দাঁড়াবে- দোহার নীতিনির্ধারকরা সে শিক্ষাই নিয়েছেন।"
- সূত্র: রয়টার্স