ধামাকা শপিংয়ের বিরুদ্ধে ১১৭ কোটি টাকা পাচারের ‘প্রমাণ পেয়েছে’ সিআইডি
ই-কমার্সের নামে অস্বাভাবিক স্বল্পমূল্যে পণ্য সরবরাহের লোভ দেখিয়ে গ্রাহকের কাছ থেকে নেওয়া প্রায় ১১৭ কোটি টাকা অবৈধভাবে পাচারের প্রমাণ পেয়েছে সিআইডি।
এজন্য প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক এসএমডি জসিম উদ্দিন চিশতিসহ তার স্ত্রী ও তিন সন্তান ও ধামাকা শপিংয়ের এক পরিচালক এবং চারটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলা করেছে সিআইডি।
মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, অভিযুক্ত ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাবসমূহের জমা ও উত্তোলন স্লিপ এবং দেশের বাইরে সম্পদের তথ্য পাওয়া গেলে পাচারকৃত অর্থ ও সম্পদের পরিমাণ আরও বাড়তে পারে।
এজাহার সূত্রে জানায়, ধামাকা শপিং প্রায় ৫ লাখ গ্রাহকের কাছ থেকে বিভিন্ন লোভনীয় অফারে পণ্য দেওয়ার নামে ৮০৩.৫১ কোটি টাকা গ্রহণ করে। শুরুতে কিছু গ্রাহককে পণ্য দিলেও পরবর্তীতে আর কাউকেই পণ্য না দিয়ে অর্থ আত্মসাৎ করেছে ধামাকা শপিং।
শুধু তাই-ই নয়, ধামাকা শপিং পণ্য সরবরাহকারী ৬০০ প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে ২০০ কোটি টাকার পণ্য নিলেও এপর্যন্ত কোনো টাকা পরিশোধ করেনি।
উল্লেখ্য, ধামাকা শপিংয়ের এমডি জসিম উদ্দিন চিশতি, তার স্ত্রী ও সন্তান গত জুলাই থেকে যুক্তরাষ্ট্রে আছেন। তাদের দ্বৈত নাগরিকত্ব রয়েছে। কেবলমাত্র ধামাকা শপিংয়ের পরিচালক (অপারেশন) সাফওয়ান আহমেদ দেশে অবস্থান করছে।
এই পাচারের একটি অংশ চিশতি পরিবার যুক্তরাষ্ট্রে নিয়ে গেছে বলেও তদন্ত জানতে পেরেছে সিআইডি।
ধামাকা শপিংয়ের বিষয়ে গত ৩০ জুন থেকে অনলাইন প্লাটফর্ম ব্যবহার করে ই-কমার্সের নামে বিভিন্ন পণ্যের লোভনীয় অফার ও ভার্চুয়াল সিগনেচার কার্ড বিক্রি করে অর্থ পাচারের অনুসন্ধানে নামে সিআইডি।
দীর্ঘ অনুসন্ধানের পর অর্থ আত্মসাৎ ও পাচারের তথ্য পাওয়ায় গতকাল বৃহস্পতিবার সিআইডির সহকারী পুলিশ সুপার আল আমিন হোসেন বনানী থানায় অর্থপাচার আইনে মামলা করেছেন।
আল আমিন হোসেন মামলার বিষয়টি দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে নিশ্চিত করেছেন।
মামলায় অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিং, ২০১৫ এর 4(2), 4(4) ধারায় অভিযোগ আনা হয়।
মামলার আসামি যারা
মামলায় আসামিরা হলেন- ধামাকা শপিংয়ের ও ইনভেরিয়েন্ট টেলিকম বাংলাদেশ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এসএস জসিম উদ্দিন চিশতি, তার স্ত্রী ও ইনভেরিয়েন্ট টেলিকমের পরিচালক সাইদা রোকসানা খানম, তার সন্তান ও ইনভেরিয়েন্ট টেকনোলজিসের চেয়্যারম্যান তাসরিফ রিদয়ান চিশতি, ইনভেরিয়েন্ট টেকনোলজিসের পরিচালক মাসফিক রিদয়ান চিশতি, ইনভেরিয়েন্ট টেকনোলজিসের এমডি নাজিমুদ্দিন আসিফ এবং ধামাকা শপিং ও ইনভেরিয়েন্ট টেলিকমের পরিচালক সাফওয়ান আহমেদ।
এছাড়াও মামলায় ইনভেরিয়েন্ট টেলিকম বাংলাদেশ লিমিটেড, মাইক্রো ট্রেড, ইনভেরিয়েন্ট টেকনোলজিস লিমিটেড ও মাইক্রো ট্রেড ফুড অ্যান্ড বেভারেজ লিমিটেডকেও আসামি করা হয়েছে।
১১৭ কোটি টাকা পাচার হয়েছে যেভাবে
মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, সিআইডি গত ৩০ জুন থেকে ধামাকা শপিয়ংয়ের বিরুদ্ধে অনলাইন প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে ই-কমার্সের নামে বিভিন্ন পণ্যের লোভনীয় অফার ও ভার্চুয়াল সিগনেচার কার্ড বিক্রির প্রলোভন দেখিয়ে গ্রাহকদের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা প্রতারণামূলকভাবে গ্রহণ করে অবৈধভাবে তাদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাবে স্থানান্তরের বিষয়ে মানিলন্ডারিংয়ের বিষয়টি অনুসন্ধান করে।
অনুসন্ধানকালে মামলায় অভিযুক্ত ১০ আসামি ছাড়াও অজ্ঞাতনামা চার-পাঁচজন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে বিভিন্ন প্রয়োজনীয় ব্যাংকিং তথ্য বিভিন্ন সেলার ও গ্রাহকদের জবানবন্দি, বিভিন্ন সহকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে অভিযোগ সংশ্লিষ্ট তথ্য প্রমাণাদি সংগ্রহ ও পর্যালোচনা করে।
পর্যালোচনায় জানা যায়, ইনভেরিয়েন্ট টেলিকম বাংলাদেশ লিমিটেড গত ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ সাল থেকে যৌথ মূলধনী কোম্পানী ও ফর্মসমূহের পরিদপ্তর থেকে ডেভেলপমেন্টস, সফটওয়্যার, টেলিকম সিস্টেমস, স্মার্ট ফোন ও আইপি ফোন, ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার, কমিউনিকেশন আমদানি-রপ্তানি-ধরনের ব্যবসার অনুমতি নেয়।
পরে গত অক্টোবর ২০২০ থেকে প্রতিষ্ঠানটি অর্থ আত্মসাৎ করার জন্য ধামাকা শপিং নামে অবৈধভাবে ই-কমার্স ব্যবসা চালু করে।
অনুসদ্ধানে জানা যায়, এই সংঘবন্ধ প্রতারক চক্রটি অর্থ আত্মসাৎ করার জন্যই ধামাকা শপিং নাম ব্যবহার করে। ইনভেরিয়েন্ট টেলিকমের সাথে সম্পৃক্ত ব্যক্তিগণ ধামাকা শপিংয়ের নামে কোনো প্রকার অনুমোদন, নিবন্ধন, ট্রেড লাইসেন্স, বিআইএন, ব্যাংক হিসাব বা দালিলিক ভিত্তি ছাড়াই প্রতারণার উদ্দেশ্যে ই-কমার্স ব্যবসা করে বলে প্রতীয়মান হয়।
এই থেকে স্পষ্টভাবে আরও প্রতীয়মান হয় যে, নিরীহ জনগণের অর্থ আত্মসাৎ করায় ছিল প্রতারক চক্রটির মূল উদ্দেশ্য।
প্রতিষ্ঠানটির সাথে জড়িত ব্যক্তিগণ মহাখালী বাণিজ্যিক এলাকার একোয়া টাওয়ারে অবস্থান করে অবৈধভাবে ধামাকা শপিং নামক ই-কমার্স সাইট/অ্যাপসের মাধ্যমে তথাকথিত ব্যবসা পরিচালনা করে প্রায় ৫ লক্ষাধিক গ্রাহকদের নিকট থেকে ২০২০ সালের ১ অক্টোবর চলতি বছরের ৩১ জুলাই পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে অস্বাভাবিক স্বল্পমূল্যে মোটরসাইকেল, রেফ্রিজারেটর, টেলিভিশন, মোবাইল ফোনসহ বিভিন্ন পণ্য সরবরাহের প্রলোভন দেখিয়ে তিনটি ব্যাংক হিসাবের মাধ্যমে মোট ৮০৩.৫২ কোটি টাকা গ্রহণ করে। প্রথম দিকে অল্পসংখ্যক গ্রাহককে কিছু পণ্য সরবরাহ করার মাধ্যম্যে অধিকসংখ্যক গ্রাহক আকৃষ্ট করে তাদের ক্রয়াদেশকৃত পণ্য আর সরবরাহ না করে প্রতিষ্ঠানটি প্রতারণা করে।
অন্যদিকে প্রায় ৬০০ পণ্য সরবরাহকারী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে পণ্য ক্রয়ের নাম করে প্রায় ২০০ কোটি টাকার পণ্য গ্রহণ করে মূল্য পরিশোধ না করেও প্রতারণা করে।
অনুসন্ধানকালে সিআইডি জানতে পারে, গ্রাহকদের অর্ডার করা পণ্যমূল্য এসএসএল কমার্স, সিটি ব্যাংক ও বিকাশ পেমেন্ট গেটওয়ের মাধ্যমে ইনভেরিয়েন্ট টেলিকম বাংলাদেশ লিমিটেডের সাইথইস্ট ব্যাংক মহাখালী শাখা, সিটি ব্যাংক গুলশান শাখা ও ডাচ-বাংলা ব্যাংক মহাখালী শাখার পৃথক তিনটি হিসাবে জমা করে।
ধামাকা শপিংয়ের ক্রয়াদেশের টাকা ইনভেয়েন্ট টেলিকমের ব্যাংক একাউন্টগুলোতে জমার পর বিভিন্ন সময় অভিযুক্ত ব্যক্তিগণ তাদের মালিকানাধীন অন্যান্য প্রতিষ্ঠান ইনভেরিয়েন্ট টেকনোলোজিস লিমিটেড, মাইক্রো ট্রেড ও মাইক্রো ট্রেড ফুড অ্যান্ড বেভারেজ লিমিটেডের ব্যাংক হিসাবে অবৈধভাবে স্থানান্তর করে আত্মসাৎ করেছে।
পর্যালোচনায় সিআইডি জেনেছে, এই সময়ে ইনভেরিয়েন্ট টেলিকম লিমিটেডের সাইথইস্ট ব্যাংকের হিসাব থেকে ইনভেরিয়েন্ট টেকনোলোজিসের সাইথইস্ট ব্যাংক, মহাখালী শাখার হিসাবে মোট ৫৮.৫১ কোটি টাকা এবং সিটি ব্যাংকের হিসাব থেকে সাউথইস্ট ব্যাংকের হিসাবে ৪২.১৭ কোটি টাকা ইনভেরিয়েন্ট টেকনোলোজিসের হিসাবে মোট ১০০.৬৮ কোটি টাকা স্থানান্তরপূর্বক গ্রহণ করে। একইভাবে ইনভেরিয়েন্ট টেলিকম বাংলাদেশ লিমিটেডের সাউথইস্ট ব্যাংকের হিসাব থেকে প্রতিষ্ঠানটির অভিযুক্ত ব্যক্তিদের অপর প্রতিষ্ঠান মাইক্রো ট্রেড ফুড অ্যান্ড ব্রেভারেজ লিমিটেডের সাউথইস্ট ব্যাংক মহাখালী শাখার হিসাবে মোট ২.২৯ কোটি টাকা স্থানান্তর করে। একইভাবে ইনভেরিয়েন্ট টেলিকম বাংলাদেশ লিমিটেডের সাউথইস্ট ব্যাংকের হিসাব থেকে মাইক্রো ট্রেডের সাউথইস্ট ব্যাংকের হিসাবে মোট ৭.৫৩ লাখ টাকা স্থানান্তর করে।
একইসাথে প্রতিষ্ঠানটির সিটি ব্যাংকের হিসাব থেকে মাইক্রো ট্রেডের সিটি ব্যাংকের হিসাবে মোট ১৩.৭০ কোটি টাকা স্থানান্তরপূর্বক গ্রহণ করে।