যুক্তরাষ্ট্রের শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদীর তালেবান বন্দনা
"তালেবান একটি মৌলবাদী, ধর্মীয় শক্তি। অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্র একটি ঈশ্বরহীন, উদারপন্থী রাষ্ট্র। আফগানিস্তানে মার্কিন সরকারের পরাজয় তাই নিঃসন্দেহে ইতিবাচক অগ্রগতি,"- একবার ভাবুন কথাগুলো কে বলছে?
বেশিরভাগ মানুষ মনে করবেন, এটি বুঝি তালেবানের জয়ে উচ্ছসিত কোনো ইসলামী গোষ্ঠীর বিবৃতি। আসলে সে ধারণা, একেবারেই ভুল। কথাগুলো বলেছেন, ২৩ বছরের মার্কিন তরুণ নিক ফুয়েন্টেস। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের একজন শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদী ও কট্টর ডানপন্থী রাজনীতির অনুসারী। একই আদর্শে বিশ্বাসী মার্কিন তরুণদের ওপর তার রয়েছে ব্যাপক প্রভাব।
যুক্তরাষ্ট্রের কট্টর সংরক্ষণবাদী বলে পরিচিত রিপাবলিকান দলের ঘনিষ্ঠ মিত্র হিসেবেও পরিচিত নিক।
তালেবানের নিরঙ্কুশ জয় নিয়ে এধরনের উচ্ছ্বাস নিক ফুয়েন্টেস একাই করছেন এমন নয়, বরং মার্কিন ডানপন্থী মহলের অনেকেই আছেন এই স্তাবকদের দলে। তালেবানের বিজয়কে তারা সমান কট্টর আদর্শের অবস্থান থেকে 'আকাঙ্ক্ষিত' বলে মনে করছেন। এনিয়ে বক্তব্য রেখে তারা গভীর করছেন যুক্তরাষ্ট্রে সাংস্কৃতিক বিভাজন, দিনে দিনে এ বিভাজন আরও সহিংস হয়ে উঠছে।
উগ্র মতাদর্শী এ অঙ্গনের অনুসারীরা বিশ্বাস করেন, আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্র নিজ নিষ্ঠুরতা বা আফগান সরকারের সীমাহীন দুর্নীতির কারণে হারেনি, বা সেকারণে তালেবানের প্রতি মানুষের সমর্থন বাড়েনি। বরং যুক্তরাষ্ট্র বৈচিত্র্য বা বহু মতাদর্শে আস্থা রাখায় পরাজয় বরণ করেছে। যাকে তারা বলছেন, সত্যকে গোপন রেখে, ভ্রান্ত নীতিতে চলার ফসল। অর্থাৎ, যুক্তরাষ্ট্র তালেবানের মতো ধর্মীয় শক্তি হলেই বিজিত হতো- এ বিশ্বাস তাদের।
বিষয়টি স্পষ্ট হয়, ডানপন্থী গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব গ্রেগ কেলি'র ভাষ্যে, "দুর্ভাগ্যজনকভাবে আফগানিস্তানের জন্য সঠিক পরিকল্পনা ও প্রস্তুতিকে প্রাধান্য দেওয়া হয়নি। আমাদের সেনাদের ভুল নীতিতে চালিত করা হয়েছে।"
বিপরীতে তারা তালেবানকে দেখছেন, ঐতিহ্যের প্রতীক ও তৃণমূল পর্যায়ে ধর্মীয় আন্দোলনের পুরুষালি শক্তি হিসেবে, যার অভাব যুক্তরাষ্ট্রের পরাজয় ও সামাজিক 'অবনতি'র মূল কারণ।
ডানপন্থী গণমাধ্যম আমেরিকান কনজারভেটিভ- এর জ্যেষ্ঠ সম্পাদক টড ড্রেহারের কথাই ধরুন, তিনি মার্কিন সেনাবাহিনীর একটি নথি নিয়ে সমালোচনা করেছেন, ওই নথিতে 'বৈচিত্র্য' ও 'সহিষ্ণুতা'কে কৌশলগত সম্পদ বলে উল্লেখ করা হয়েছিল।
ড্রেহার লিখেছেন, "যুদ্ধক্ষেত্রে আমাদের বিরোধী শক্তির মধ্যে বৈচিত্র্য নামক কোন ভাবাদর্শের বালাই ছিল না। তারপরও, তারা আমাদের আফগানিস্তান থেকে তাড়িয়েছে। এ ঘটনা একটি শিক্ষা দিচ্ছে।"
এভাবেই যুক্তরাষ্ট্রের উগ্রবাদী রাজনীতির প্রায় প্রতিটি স্তরে সমানতালে জনপ্রিয়তা পেয়েছে ও আলোচিত হচ্ছে এ তত্ত্ব।
অথচ এসব গোষ্ঠীর মধ্যে 'ইসলামোফোবিয়া' বা মুসলিম বিদ্বেষ ঐতিহাসিক ভাবেই চরম মাত্রার। আরবদের তারা 'নোংরা' বলেন, এমনকি তাদের অনেকেই অতীত ও বর্তমানে অনেক নিরীহ আরবের ওপর চড়াও হয়েছেন ও হচ্ছেন। কিন্তু, বিস্ময়কর হলেও সত্য, আরবদের প্রতি ঘৃণা, আল-কায়েদার মতো কট্টর ইসলামী জঙ্গিগোষ্ঠীগুলোর প্রতি তাদের মুগ্ধতার কাছে দ্বিতীয় স্থান লাভ করেছে।
নাইন-ইলেভেনের সন্ত্রাসী হামলার পরের একটি ঘটনাকেই উদাহরণ হিসেবে হাজির করা যাক। হামলার পর যুক্তরাষ্ট্রের একটি নব্য-নাৎসী গোষ্ঠী- ন্যাশনাল অ্যালায়েন্স- এর একজন কর্মকর্তা আফসোস করে করে বলেন, টুইন টাওয়ারে আক্রমণকারীদের মতো সাহস তাঁর দলের সদস্যদের নেই, যা সত্যিই দুর্ভাগ্যজনক।
চেক প্রজাতন্ত্রের ন্যাশনাল সোশ্যাল ব্লক (আরেকটি নব্য নাৎসি দল) এর নেতা ইয়ান কোপালের মন্তব্য আরও বিস্ময়কর। তিনি বলেন, 'ওসামা বিন লাদেন আমাদের শিশুদের জন্য এক অনুকরণীয় আদর্শ হতে পারে।
এভাবে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা অনেক দেশের শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদী নেতার প্রশংসাসূচক মন্তব্য তুলে ধরা যায়। তবে এতক্ষণে আপনি নিশ্চয় তাদের দেওয়া সঠিক ইঙ্গিতটি ধরতেও পেরেছেন।
তারা চান, একই মাত্রায় মূল ধারার রাজনীতি ও সংস্কৃতিতে খ্রিস্টীয় মৌলবাদের নিয়ন্ত্রণ। গণতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার উদারনৈতিক ধারণা থেকে নিজ সমাজের তথাকথিত অবক্ষয় ঠেকাতে তারা সচেষ্ট। এদিক থেকে ইসলামী মৌলবাদীদের সঙ্গে তাদের পার্থক্য নেই বললেই চলে। উভয়েরই মৌলিক শত্রু- উদারনৈতিক রাষ্ট্র ও গণতন্ত্রের চর্চা।
- লেখক: ৬৯ বছরের পারভেজ আমিরালি হুদভয় একাধারে একজন পরমাণু বিজ্ঞানী, লেখক এবং মানবাধিকার কর্মী। নিজ দেশ পাকিস্তানে মৌলবাদ বিরোধিতা, বাক-স্বাধীনতা, অসাম্প্রদায়িকতা এবং আধুনিক শিক্ষা প্রসারের স্বপক্ষে তিনি একজন বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর।
- সূত্র: দ্য ডন, স্ক্রল ডটইন