অকাস চুক্তি যেভাবে তীব্র কূটনৈতিক বিরোধ সৃষ্টি করেছে
ফ্রান্সের কাছ থেকে সাবমেরিন কিনতে ২০১৬ সালে ৫ হাজার কোটি ইউরোর একটি গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি করেছিল অস্ট্রেলিয়া। কিন্তু, সেখান থেকে পিছু হটেছে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের সঙ্গে 'অকাস' চুক্তি সম্পাদনের পর। এখন ফ্রান্সের বদলে, মার্কিন ও ব্রিটিশ প্রযুক্তিগত সহায়তায় পারমাণবিক শক্তিচালিড ডুবোযান নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
এ ঘটনায়, অকাস চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী তিনটি দেশের সঙ্গে মিত্র ফ্রান্সের কূটনীতিক বিরোধ নজিরবিহীন মাত্রা লাভ করেছে। অতীতে প্রতিরক্ষা সহযোগিতা নিয়ে ঘনিষ্ঠ পশ্চিমা মিত্র রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে এমন টানাপোড়েন আর দেখা যায়নি।
ইতোমধ্যেই, যুক্তরাষ্ট্র ও অস্ট্রেলিয়া থেকে প্রতিবাদস্বরূপ নিজ রাষ্ট্রদূতদের প্রত্যাহার করেছে ফরাসী পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। চুক্তিতে স্বাক্ষরকারীরা 'দ্বৈততা ও মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে অবিবেচক' কাজ করেছে বলে কড়া সমালোচনা এসেছে মন্ত্রণালয়ের তরফ থেকে।
এতে হাজার হাজার কোটি ইউরো অর্থনৈতিক ক্ষতির শিকার ফ্রান্স বলেছে, যেভাবে অস্ট্রেলিয়া ও তাঁর মিত্ররা এ চুক্তি সম্পাদন করেছে তা তাদের ক্ষুদ্ধ করেছে।
ফরাসি পররাষ্ট্রমন্ত্রী জ্যঁ-ইভেস লে ড্রিয়ান বলেছেন, 'আমাদের অসম্মান করার ফলেই তাদের সাথে সম্পর্কে অবনতি হয়েছে।'
আগামী কয়েক দিনের মধ্যেই এনিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সাথে ফোনালাপ করবেন ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়ালে মাখোঁ। ওই সংলাপে যুক্তরাষ্ট্র তথা বাইডেন প্রশাসনের কড়া সমালোচনা করতে পারেন তিনি।
অস্ট্রেলিয়ার কৌশলগত অবস্থান পরিবর্তন:
২০১৬ সালে ৫০ বিলিয়ন ইউরো (৫৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার) মূল্যের সাবমেরিন ক্রয় চুক্তি করেছিল অস্ট্রেলিয়া। যার আওতায় ১২টি ডিজেল-ইলেক্ট্রিক সাবমেরিন কেনার পরিকল্পনা ছিল দেশটির। কিন্তু, ওই চুক্তিকে বাতিল করার ঘোষণা দেওয়া হয় গত বুধবার।
যার পরিবর্তে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রযুক্তিতে তৈরি আটটি পরমাণু শক্তিচালিত সাবমেরিন কমিশনে আনবে অস্ট্রেলীয় নৌবাহিনী। প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চীনের হুমকি মোকাবিলার জন্য 'অকাস' চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এর আওতায় গোপনীয় সর্বাধুনিক সামরিক প্রযুক্তি বিনিময় করবে অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য।
বুধবার অস্ট্রেলীয় প্রধানমন্ত্রী স্কট মরিসন বলেন, "একটি বর্ধিত ত্রিমাত্রিক নিরাপত্তা সহযোগিতার ব্যাপারে তিন জাতির মধ্যে ঐক্যমত্য হয়েছে।"
এ চুক্তির ফলে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে অস্ট্রেলিয়ার প্রতিরক্ষা সম্পর্ক আরও দৃঢ় হলো, যা প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে নৌশক্তির ভারসাম্য পশ্চিমাদের পক্ষে আনবে। সমন্বিত প্রতিরক্ষা কৌশলের আওতায়, বিরোধপূর্ণ দক্ষিণ চীন সাগরে নিয়মিত টহলদারি শুরু করতে পারে অস্ট্রেলীয় যুদ্ধজাহাজ।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এ চুক্তিকে 'আমাদের সেরা শক্তির উৎস, মিত্রতা দৃঢ়করণে বিনিয়োগ' বলে উল্লেখ করেন। চুক্তিটির ফলে 'মিত্রদের সমরসজ্জা উন্নতকরণের মাধ্যমে আজ ও আগামীদিনের হুমকি মোকাবিলায়, তাদের আরও উপযুক্তভাবে প্রস্তুতি নিতে সাহায্য করা হবে।'
কিন্তু, তাতে করে ফ্রান্সের সাথে ২০১৬ সালে সম্পাদিত প্রতিরক্ষা চুক্তি বাতিল হয়ে গেল। জাপান ও জার্মানির মতো অত্যাধুনিক সাবমেরিন নির্মাতা দেশের সাথে প্রতিযোগিতা করে এ কার্যাদেশ পায় ফরাসি কোম্পানি। ফ্রান্সের জন্য সবচেয়ে বড় ক্ষোভের কারণ, মূল দরপত্র প্রতিযোগিতার সময় যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য এতে অংশও নেয়নি।
তাই ত্রি-দেশীয় 'অকাস' চুক্তিকে বিশ্বাসঘাতকতা হিসেবে দেখছে ফ্রান্স।
'মিথ্যাচার ও প্রতারণা'
ফরাসি পররাষ্ট্রমন্ত্রী লে ড্রিয়ান ও সশস্ত্র বাহিনী বিয়রক মন্ত্রী ফ্লোরেন্স পার্লি অস্ট্রেলিয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে গত বৃহস্পতিবার প্রচণ্ড ক্ষোভ ও অসন্তোষ প্রকাশ করেন। 'দুই দেশের মধ্যে সহযোগিতার যে সুসম্পর্ক বিদ্যমান দেশটির সিদ্দান্ত তাঁর সম্পূর্ণ পরিপন্থী' বলে নিন্দা জানান তারা।
ফ্রান্স ইনফো নামের একটি স্থানীয় বেতার চ্যানেল'কে দেওয়া সাক্ষাতকারে লে ড্রিয়ান এ ঘটনাকে 'পিঠে ছুরি মারার শামিল' বলে বর্ণনা করেন।
অস্ট্রেলিয়ায় নিযুক্ত ফ্রান্সের রাষ্ট্রদূত জ্যাঁ পিঁয়েরে থিওবোল্ট দেশটি ছেড়ে আসার কালে আল জাজিরাকে বলেন, দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে 'অকাস ছিল বিশাল বড় এক ভুল।'
ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, "এটি শুধু চুক্তি নয়, কৌশলগত অংশীদারিত্বের অঙ্গীকারনামা। অথচ অংশীদারিত্ব আস্থার ভিত্তিতে হওয়া উচিত।" যা অস্ট্রেলিয়া ফ্রান্সের সাথে রক্ষা করেনি।
এরপর শনিবার 'দ্বৈততা, অসম্মান ও মিথ্যাচারে পূর্ণ' বলে এ চুক্তিকে প্রত্যাখ্যান করেন লে ড্রিয়ান। ফ্রান্সকে ধোঁকা দিয়ে অতি-গোপন আলোচনার মাধ্যমে এ চুক্তি আকস্মিকভাবে সম্পন্ন করা হয়েছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
তবে অভিযোগ অস্বীকার করে অস্ট্রেলীয় প্রধানমন্ত্রী স্কট মরিসন আজ রোববার বলেন, "ফ্রান্স যে সাবমেরিন বহর নির্মাণের কাজ শুরু করেছিল, তা আমাদের নিরাপত্তা নিয়ে তীব্র উদ্বেগ দূর করতে পারতো না। এনিয়ে আমাদের উৎকণ্ঠা ফ্রান্সের অজানা থাকারও কথা নয়।"
মরিসন দাবি করেন, গত জুনে তিনি ফরাসি প্রেসিডেন্ট মাখোঁর কাছে প্রচলিত সাবমেরিন সক্ষমতা অস্ট্রেলিয়ার সত্যিকারের ঝুঁকিগুলো মোকাবিলায় আদৌ কার্যকর হবে কিনা- এমন উদ্বেগ তুলে ধরেন।
এসময় সরাসরি চী্নের কথা উল্লেখ না করলেও, প্রশান্ত মহাসাগরীয় এশীয় অঞ্চলে ক্রমাবনতিশীল কৌশলগত পরিবেশের কারণেই অস্ট্রেলিয়া সরকারের সিদ্ধান্তে রদবদল আসে বলে জানান তিনি।
"ফ্রান্সের তৈরি অ্যাটাক ক্লাস সাবমেরিনগুলো অস্ট্রেলিয়ার সার্বভৌম স্বার্থরক্ষায় প্রয়োজন ছিল না," যোগ করেন মরিসন।
অস্ট্রেলীয় প্রতিরক্ষামন্ত্রী পিটার ডুট্টন জানান, সর্বপ্রথম পরমাণু শক্তিচালিত সাবমেরিন কেনার ইচ্ছেটি তাঁর দেশ কখনোই ফ্রান্সের কাছে গোপন করেনি। এব্যাপারে তারা সম্পূর্ণ সততা ও স্বচ্ছতা অবলম্বন করেছেন।
তবে বুধবার চুক্তি সম্পাদনের আগে ফ্রান্সের সঙ্গে কোনো প্রকার আলোচনা করা হয়নি বলে এসব দাবিকে নাকচ করে দিয়েছেন ফরাসি পররাষ্ট্রমন্ত্রী। তিনি একে 'নির্জলা মিথ্যে বলে অভিহিত করেন।
ঐতিহাসিক মিত্রতা কী ভেঙ্গে পড়ছে?
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতার ঘোষণার দুই বছর, ১৭৭৮ সালে ফ্রান্সের সাথে মিত্রতার জোট গড়ে ওঠে। ফরাসি-মার্কিন এ জোটের কারণেই যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতা যুদ্ধে অতি-দরকারি যুদ্ধাস্ত্র ও আর্থিক ঋণ দেয় ফ্রান্স।
ঐতিহাসিক এ সম্পর্কের কারণেই এর আগে কখনো যুক্তরাষ্ট্র থেকে রাষ্ট্রদূত প্রত্যাহার করেনি ফ্রান্স।
এব্যাপারে গত শুক্রবার দেওয়া এক বিবৃতিতে লে ড্রিয়ান বলেন, "ইতিহাসে প্রথমবারের মতো যুক্তরাষ্ট্র ও ফ্রান্স নিজ নিজ রাষ্ট্রদূতকে প্রত্যাহার করেছে, এ ঘটনা আমাদের দুই দেশের মধ্যে বিরাজমান সংকটের গভীরতা প্রকাশ করছে।"
২০২২ সালে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সভাপতির পদ পাবে ফ্রান্স, তখন দেশটি ইইউ- এর নিজস্ব প্রতিরক্ষা কৌশল নির্ধারণকে অগ্রাধিকার দেবে বলে যুক্তরাষ্ট্রকে এক প্রকার সতর্ক করে দেন তিনি।
তবে ফ্রান্সের রাষ্ট্রদূত প্রত্যাহারের ঘটনায় দুঃখপ্রকাশ করে গত শুক্রবার হোয়াইট হাউজের এক কর্মকর্তা বলেন, বিরোধ নিরসনে ওয়াশিংটন সামনের দিনগুলোতে দ্বিপাক্ষিক যোগাযোগ বজায় রাখবে।
- সূত্র: আল জাজিরা