কর আরোপের মাধ্যমে কেন দাড়ি রাখা নিষিদ্ধ করতে চেয়েছিলেন রাশিয়ান জার?
রাশিয়ান সম্রাট বা জার পিটার দ্য গ্রেট ছিলেন বলতে গেলে একজন ফ্যাশন-নাৎসি। তার পুলিশ বাহিনীর কাজ ছিল সেন্ট পিটার্সবার্গের রাস্তায় ঘুরে ঘুরে মানুষের দাড়ি কামিয়ে দেওয়া এবং কোটের কাপড় কেটে নেওয়া।
আপনি যদি ১৭১৪ সালে সেন্ট পিটার্সবার্গে বসবাসকারী একজন দাড়িওয়ালা ব্যক্তি হয়ে থাকেন, তাহলে আপনার জন্য সরকারি পুলিশের হাত থেকে নিজেকে বাঁচানোর একমাত্র পন্থা হচ্ছে একটি বিশেষ টোকেন। এই টোকেন প্রমাণ করবে, আপনি দাড়ির জন্য কর দিয়েছেন।
দাড়ি-কর কিন্তু পিটারের একমাত্র ফ্যাশন-ফ্যাসিজম ছিল না। পুরো রাশিয়ান সংস্কৃতির নান্দনিক পুনর্বিন্যাস প্রকল্প হাতে নিয়েছিলেন এই শাসক। প্রজাদেরকে তাদের পরিচিত দীর্ঘ রাশিয়ান ওভারকোটগুলোকে ফেলে দিয়ে ফরাসি বা হাঙ্গেরিয়ান জ্যাকেট পরার আদেশ দিয়েছিলেন তিনি।
নতুন ফ্যাশন আইন অনুযায়ী মডেল বানিয়ে মেনিকিন স্থাপন করা হয়েছিল মস্কো শহরের গেটের সামনে। চিরায়ত রাশিয়ান ধারার কাপড়-চোপড় বানানো দর্জিরা তখন হুট করে পড়ে যান জরিমানার ঝুঁকিতে। চিরায়ত ধারার কাপড়-চোপড় পরে কেউ রাস্তায় বের হলেও জারের পুলিশ তৎক্ষণাৎ কাপড় ছিঁড়ে ফেলার অধিকার রাখত!
পিটারের মাথায় এই প্রকল্পের বীজ আসে তার দীর্ঘ ইউরোপ সফর থেকে। ১৬৯৭ সালে ইউরোপ ভ্রমণের জন্য ছদ্মবেশে একটি বড়সড় সফরে রওনা হন তিনি। দুই বছর ব্যাপী ওই সফরের সময়ে পিটার কিছুদিন কাজ করেছেন একটি ডাচ শিপইয়ার্ডে। সাক্ষাৎ করেছেন বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধান ও প্রাকৃতিক নিদর্শন সংগ্রাহকদের সঙ্গে। শরীরবৃত্তীয় থিয়েটারসহ পরিদর্শন করেছেন বিভিন্ন সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান। আর এসবের সঙ্গে বন্য পার্টি তো ছিলই!
এই ভ্রমণ থেকে ফেরার সঙ্গে সঙ্গেই নিজের মাতৃভূমিকে 'ইউরোপীয়করণ' করার প্রকল্প হাতে নেন পিটার। ওই ইউরোপীয়করণের ফাঁদে প্রথম কাটা পড়ে জনগণের দাড়ি!
এই নিয়ে পিটারের পুলিশ বাহিনী জনগণের মাঝে ভালো রকম ত্রাস তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিল। রাস্তায় দাড়িওয়ালা কাউকে পেলেই গাছের শিকড় বা ভোঁতা কিছু দিয়ে তাদের দাড়ি টেনে তোলা হতো; মাঝে মধ্যে দাড়ির সঙ্গে উঠে আসতো গালের চামড়াও।
তবে পিটারের এই ফ্যাশন বিপ্লবে বাধ সাধে গির্জা। মুখের দাড়িকে তখন ধার্মিকতার প্রতিফলন হিসাবে বিবেচনা করা হতো: 'মানুষ স্রষ্টার প্রতিমায় সৃষ্ট, যার মধ্যে রয়েছে দাড়িও।' খ্রিস্টান বিশ্বাস অনুযায়ী, শেভ করা তাই মারাত্মক পাপ হিসেবে বিবেচিত হতো।
রাশিয়ার ধার্মিক জনগোষ্ঠী এই দাড়ি-করকে মোটেও ভালোভাবে নেয়নি। সারা দেশে গুজব রটে যায়, পিটার আসল জার নন। রাশিয়ার শত্রুরা তাকে ক্ষমতায় বসিয়েছে। জারকে ধর্ম অবমাননার দায়ে অভিযুক্ত করে বেনামি চিঠি শোভা পেতে থাকে শহরের পথে-প্রান্তরে।
এক সময় জনগণের মাঝে বিদ্রোহও দানা বাঁধে। ১৭০৫ সালে স্ট্রেলটসি নামে পরিচিত রুশ সামরিক বিভাগ অ্যাস্ট্রখান শহরে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। বিদ্রোহীরা একটি চিঠির মাধ্যমে ঘোষণা দেন, তারা খ্রিস্টান বিশ্বাসের পক্ষে, এবং দাড়ি-ছাটাই ও বিদেশি পোশাকের বিরুদ্ধে অবস্থান নিচ্ছেন।
তাদের এই বিদ্রোহ অবশ্য বেশি দূর গড়ায়নি। জারের সেনারা সহজেই চূর্ণ করতে সক্ষম হয় এই বিদ্রোহকে। এর ফলে প্রাণ হারান শত শত বিদ্রোহী।
গির্জার সঙ্গে জারের মনোমালিন্য শুধু দাড়ির কর নিয়েই ছিল না। জারের জীবনযাত্রা নিয়েই আপত্তি ছিল গির্জা কর্তৃপক্ষের।
পিটার তার মদ্যপানের সঙ্গীদের নিয়ে একটি ক্লাব প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ক্লাবের সদস্যরা কার্ডিনাল ও বিশপদের নিয়ে ফাজলামো করতেন, নকল বিয়ে ও অনুষ্ঠান করতেন।
জোরপূর্বক আনন্দ-উল্লাস, বাধ্যতামূলক মাতাল হওয়া এবং অবিরাম ভোজ ও যৌনতার নারকীয় এক পরিবেশ সৃষ্টি করেছিলেন জার। এসব কর্মকাণ্ড থেকে বিরত থাকারও কোনো উপায় না ছিল ক্লাব সদস্যদের। ধর্ম অবমাননার মাধ্যমেই নিকটতম সঙ্গীদের আনুগত্য পরীক্ষা করতেন জার।
এ ব্যাপারে ইতিহাসবিদ ভি এম ঝিভভ লিখেছেন, গির্জার ক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ করে, সাধারণ সমাজের সীমার বাইরে গিয়ে জার নিজেকে একটি আধা-ঐশ্বরিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে দাঁড় করানোর চেষ্টা করেছিলেন।
সম্ভ্রান্ত কয়েকজন মাতাল নিজেদেরকে পুরোহিত সাজানোর চেষ্টা করছেন- দাড়ি-করের মতো এই দ্বন্দ্বকেও আপনার কাছে হাস্যকর শোনাতে পারে। কিন্তু বাস্তবে সে সময় রাজশক্তির স্বভাব ও চরিত্রের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের বিতৃষ্ণা মারাত্মক পর্যায়ে পৌঁছেছিল।
-
সূত্র: জার্নাল স্টোরেজ [জেএসটিওর]