পর্যটকদের কাছে বাড়ছে টাঙ্গুয়ার হাওরের হাউস বোটের জনপ্রিয়তা
জলের রঙ কখনো আকাশের মতো নীল, কখনো আয়নার মতো স্বচ্ছ টলটল, এমন স্নিগ্ধ রঙে রাঙা পানিতে টইটুম্বর টাঙ্গুয়ার হাওর। যে হাওরের দূরে মেঘালয় রাজ্যের পাহাড়ে ঝরনা থেকে নেমে আসা স্বচ্ছ পানি। পাশের মেঘালয়ের পাহাড়কে মনে হয় হাওরের সীমানা প্রাচীর।
টাঙ্গুয়ার হাওরকে ২০০০ সালে সুন্দরবনের পর বাংলাদেশের দ্বিতীয় 'রামসার সাইট' হিসেবে ঘোষণা করা হয়। মূলত এরপর থেকেই প্রচারণায় আসতে থাকে এই হাওরের নৈস্বর্গিক সৌন্দর্য্য। দিনে ভিড় বাড়তে থাকে পর্যটকদের। তবে ২০১৮ সালের পর দ্রুত বেড়েছে পর্যটক সংখ্যা।
বর্তমানে প্রতিদিন কয়েক হাজার পর্যটক আসেন টাঙ্গুয়ার হাওরে। তারা হাওরে ঘুরতে গিয়ে বেছে নেন নৌকা। তাই দিন দিন পর্যটকদের চাহিদার অনুপাতে বেড়েছে নৌকায় সংখ্যা। বর্তমানে হাওরে পর্যটকবাহী নৌকার সংখ্যা পাঁচ'শর কাছাকাছি। একেকটি নৌকার ভাড়া ১৫ হাজার থেকে ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত।
প্রতি মৌসুমে এইসব নৌকায় কোটি টাকার ব্যবসা হচ্ছে। কর্মসংস্থান হয়েছে অন্তত ৫ হাজার মানুষের। পর্যটনকেন্দ্রিক অর্থনীতির সুবিধা নিচ্ছেন ৫০ হাজার মানুষ।
তাহিরপুর উপজেলার ট্রলার মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক হুমায়ুন কবির জানান, মাঝারি ও বড়- এই দুই আকারের নৌকা হাওরে চলে। পর্যটকরা দুইদিন একরাতের জন্য একেকটি নৌকা ভাড়া নেন ১৫ হাজার থেকে ৫০ হাজার টাকায়। বর্ষা মৌসুমে ৫ মাস চলে হাউস বোটের এই ব্যবসা।
মৌসুমে কত টাকার ভাড়া যাচ্ছে, সে হিসেব না থাকলেও তিনি জানান, প্রায় পাঁচ শতাধিক নৌকার কোনোটাই বসে থাকে না; বিশেষ করে বন্ধের দিনে নৌকা পেতে হলে এক মাস আগে বুকিং দিতে হয়। এখানে শুধু স্থানীয় নৌকা নয়, আশেপাশের অন্তত ১০-১২টি উপজেলা থেকে নৌকা আসে বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে।
নৌকার মালিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, একটা কাঠের হাউস বোট বানাতে আনুমানিক ২ থেকে ৩ মাস এবং স্টিলের হাউস বোট বানাতে দেড় মাসের মতো লাগে। প্রতিটি নৌকা বানাতে লোক লাগে ৫-৬ জন। নৌকা ভেদে খরচ হয় ৭ লাখ থেকে ১৫ লাখ টাকা।
একেকটি হাউস বোটে ১৫ থেকে ৩০ জনের রাতে ঘুমানোর ব্যবস্থা থাকে। রয়েছে আধুনিক নাগরিক সুবিধা। যে হাউস বোটের সুবিধা যত বেশি, তার ভাড়াও তত বেশি।
সাধারণত তাহিরপুর উপজেলার নৌকা ঘাট থেকে সকালে নৌকা ছেড়ে যায় এবং রাতে শহীদ সিরাজ লেকের পাশে অবস্থান করে পরের দিন আরও কয়েকটি স্পট ঘুরে বিকেল বেলা পর্যটকদের আবার তাহিরপুর বাজারে নামিয়ে দেয়।
রাজার তরী হাউস বোটের মালিক শেখ রাফি বলেন, 'আমি এইবার প্রথম কাঠের একটি হাউস বোট নামিয়েছি। প্রায় ৩ মাস সময় লেগেছে বোটটি তৈরি করতে। বর্তমানে প্রতি দুইদিন একরাতের জন্য ১৬ হাজার টাকায় ভাড়া দিচ্ছি। এই মাসে আমার কোনো সিডিউল খালি নেই। এক মাসে আগেই সব বুকড হয়ে গেছে।'
তিনি আরও জানান, তার মতো আশেপাশের প্রতিটি নৌকা এভাবেই বুকড হয়ে আছে আগে থেকেই। এই ১৬ হাজার টাকার বিনিময়ে তিনি পর্যটকদের আরও বেশ কিছু সুযোগ সুবিধা দিয়ে থাকেন বলে জানান।
অবশ্য, পর্যটনের মৌসুম শেষ হলেও বসে থাকে না এই নৌকাগুলো। এগুলো তখন স্থানীয়দের পরিবহনে কাজে লাগে।
স্টিল বডির বড় নৌকা 'সাম্পানে'র মালিক রাজিব সোহেল বলেন, 'আমরা মোট ৪ জন অংশীদার মিলে প্রায় ১৫ লক্ষ টাকা খরচ করে ৩২ জন পর্যটকের রাত্রিযাপনের ব্যবস্থা রয়েছে, এমন বোট বানিয়েছি। এই নৌকার ভেতরেই একটি হাই-কমোড ও একটি লো কমোড এবং পেছনে একটি লো কমোডের টয়লেটের ব্যবস্থা রয়েছে। এছাড়া বাবুর্চি দিয়ে ইঞ্জিন রুমের পেছনে গ্যাসের দুই বার্নের চুলায় গ্যাস সিলিন্ডারের সাহায্যে খাবার রান্নার সকল সরঞ্জামাদি ও প্রয়োজনীয় গ্লাস, প্লেট, বাটি, চামচ, চায়ের কাপ ইত্যাদির ব্যবস্থা রেখেছি। তাছাড়া সবার জন্য লাইফ জ্যাকেট, নৌকার উপরে সামিয়ানা, ময়লা ফেলার ডাস্টবিন, জুতা রাখার বক্সসহ বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা রয়েছে।'
'হাওরের মৌসুমের পর বছরের বাকি সময় সুনামগঞ্জ থেকে কিশোরগঞ্জ পর্যন্ত সপ্তাহে ৩ দিনের লোকাল ট্রিপ দেয় আমাদের নৌকা,' যোগ করেন তিনি।
রাজিব আরও বলেন, 'অনেকেই মনে করেন এখানে নৌকার ভাড়া বেশি; কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, একেকটি নৌকার খরচ তুলতে ১০ থেকে ১২ বছর লেগে যায়।'
হাওর পর্যটনের সবচেয়ে বড় আয়োজক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম কেন্দ্রিক বিভিন্ন ট্যুর গ্রুপ। তারা সুযোগ সুবিধা ভেদে ৪ থেকে ৬ হাজার টাকায় হাওরে দুইদিন একরাতের ট্যুর দেয়। নৌকায় করে পর্যটকদের ঘুরে দেখানো হয় হাওরের বিভিন্ন স্পট। ট্যুর গ্রুপের অ্যাডমিনদের অনেকেরই হাউস বোট রয়েছে; তারা মূলত ফেসবুককেন্দ্রিক মার্কেটিং করে থাকেন।
তবে নৌকার ভাড়া 'অস্বাভাবিক' বলে অভিমত অনেক পর্যটকের। ঢাকা থেকে আসা ফাইজা বেগম জানান, তিনি তার পরিবারের ১৫ সদস্য নিয়ে হাওরে ঘুরতে এসেছেন, সেজন্য ৪০ হাজার টাকায় একটি হাউস বোট ভাড়া নিয়েছেন।
ফাইজা বলেন, 'দুইরাত একদিন হাওরে আছি। সব মিলিয়ে ৭-৮ ঘণ্টা তারা নৌকা চালিয়েছে; বাকি সময় বিভিন্ন স্পটে কেটেছে। কিন্তু ভাড়া ৪০ হাজার টাকা! এটা কল্পনা করা যায়? একটা নৌকা তৈরি ও এর রক্ষণাবেক্ষণে যা খরচ, তা থেকে বলতে পারি, অতিরিক্ত মুনাফার লোভ পর্যটন সম্ভাবনাকে নষ্ট করবে।'
ভাড়া অতিরিক্ত কি না, তা জানার জন্য কয়েকজন নৌকা-মালিকের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তারা এ নিয়ে মন্তব্য করতে রাজি হননি। বরং তাদের দাবি, তারা নিজেরা কম ভাড়া নিলেও অন্যরা বেশি নিচ্ছেন!
এ বিষয়ে ট্রলার মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক হুমায়ুন বলেন, 'আমরা সম্প্রতি একটি ভাড়ার চার্ট দিয়েছি; কিন্তু সেটি মনিটর করা কঠিন। কারণ বেশিরভাগ মানুষ নৌকা আগেই ঠিক করে রাখেন। তাই আমরা জানতে পারি না আসলে কে কত টাকা ভাড়া নিয়েছে। তাছাড়া পর্যটকরা দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে আসার কারণে তারাও নৌকা ঠিক করার আগে জানেন না, ভাড়া আসলে কত। তবে ভাড়ার লাগাম টানার চেষ্টা করে যাচ্ছি আমরা।'
এদিকে, হাওরের নৌকার কোনো পরিসংখ্যান নেই স্থানীয় প্রশাসনের কাছে। প্রশাসন জানায়, বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে সুনামগঞ্জ ছাড়াও আশেপাশের নেত্রকোনা ও ময়মনসিংহ জেলার বিভিন্ন উপজেলা থেকেও প্রচুর নৌকা হাওরে প্রবেশ করে। এছাড়া সুনামগঞ্জের বিভিন্ন উপজেলা তো রয়েছেই। তবে তাহিরপুর উপজেলার ৮০টির মতো নৌকা আছে।
প্রশাসনের ধারণা, পর্যটকবাহী হাউস বোটের সংখ্যা পাঁচ'শর মধ্যেই।
তাহিরপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ রায়হান কবির জানান, হাওরের পর্যটনের কারণে হাউস বোটের ব্যবসার পাশাপাশি স্থানীয় মানুষের প্রচুর কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে। একেকটি নৌকাতে ৪ জন কর্মচারী থাকেন, যাদের বেশিরভাগই স্থানীয়। সব মিলিয়ে স্থানীয় অর্থনীতিতে ভূমিকা রাখছে এই পর্যটন।