‘অপরিকল্পিত নগরায়নে’ যেন কংক্রিট ও আবর্জনার শহর কক্সবাজার!
বিশ্বের দীর্ঘতম সৈকত সমেত দেশের পর্যটন রাজধানী খ্যাত নগরী কক্সবাজার। নব্বইয়ের দশক থেকে বছরে প্রায় প্রতিটি সময় এখানে পর্যটকের পদচারণা থাকে। আর ২০১৭ সালে বানের মতো রোহিঙ্গা আগমনের পর থেকে পর্যটক ছাড়াও দেশি-বিদেশি শতাধিক আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থার হাজারও কর্মজীবী পর্যটক এ শহরেই বাস করছেন।
কিন্তু দীর্ঘ সময়ে অপরিকল্পিত নগরায়ন হয়েছে এখানে। ফলে বিশ্বমানের পর্যটকবান্ধব নগরী না হয়ে 'হিজিবিজি' কংক্রিটের শহরে পরিণত হচ্ছে কক্সবাজার।
বাৎসরিক শত কোটি টাকা সরকারি রাজস্ব পেলেও পর্যটন নগরী হিসেবে কক্সবাজারকে আলাদাভাবে সাজানো হয়নি। নেই বর্জ্য ব্যবস্থাপনা। প্রথম শ্রেণির পৌরসভা হলেও পড়ে থাকছে যত্রতত্র ময়লা-আবর্জনা। গড়ে তোলা হয়নি সুয়ারেজ সিস্টেম। পয়োবর্জ্যে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে পরিবেশ; ভাঙাচোরা সড়কে নাজুক নগর জীবন।
কক্সবাজার ট্যুর অপারেটর ওনার অ্যাসোসিয়েশন (টুয়াক) সভাপতি রেজাউল করিম বলেন, 'সস্তায় (সহজ) আসা-যাওয়া, সস্তায় থাকা-খাওয়া' এমন কিছু বিষয়ের ওপর পর্যটন বিকাশ নির্ভর করে। একটি বিশ্বের দীর্ঘতম সৈকত ছাড়া আমাদের আর কিছু নেই। রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আগত পর্যটকদের যাতায়াতে ভোগান্তি পোহাতে হয়।
সবচেয়ে বড় ভোগান্তি পর্যটন এলাকায়। বিগত এক দশক ধরে অভ্যন্তরীণ সড়কগুলো দিয়ে পায়ে হাঁটাও দুরূহ হয়ে পড়েছে। যদিও এখন বিভিন্ন সড়কে উন্নয়ন কাজ চলছে। সে কার্যক্রমেও সমন্বয় না থাকায় বিগত বছর দেড়েক ধরে যুদ্ধ বিধ্বস্ত নগরীর মতোই অবস্থা পর্যটন নগরী কক্সবাজারের।
দেখা যায়, স্বাধীনতার অর্ধশত বছরেও কক্সবাজার পরিকল্পিত নগরী হিসেবে গড়ে ওঠেনি। পৌর এলাকার হলি ডে মোড় থেকে শুরু করে দক্ষিণে মেরিন ড্রাইভের টেকনাফ সীমান্ত পর্যন্ত ছোট-বড় মিলিয়ে প্রায় সাড়ে সাতশো হোটেল-মোটেল, গেস্ট হাউস ও কটেজ গড়ে উঠেছে। এরমধ্যে ৬টি তারকা হোটেলসহ রয়েছে ২৪টি বড় হোটেল। গড়ে উঠেছে আড়াই শতাধিক রেস্তোরাঁও। তবে অধিকাংশ স্থাপনা গড়ে উঠেছে অপরিকল্পিতভাবে।
পর্যটনকে কেন্দ্র করে স্থাপনা নির্মাণের ক্ষেত্রে মানা হয়নি পরিবেশ রক্ষা নীতিমালা। যেখানে সেখানে স্থাপনার অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। অনেক হোটেল নির্মাণ হলেও রাস্তার অনুমোদন দেওয়া হয়নি। এতে নাগরিক সমস্যা প্রতিদিন বাড়ছে। ক্ষতি হচ্ছে পরিবেশ-প্রতিবেশের; আর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে সমুদ্রের জীববৈচিত্র্যেও।
পরিকল্পিত নগরায়ন না হওয়ায় ইতোমধ্যে কক্সবাজারের প্রধান সড়কের সম্প্রসারণ নিয়েও বেকায়দায় পড়েছে উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ। সড়কের দুই পাশে রয়েছে ব্যক্তি মালিকানাধীন অনেক পুরোনা স্থাপনা।
কক্সবাজার হোটেল-মোটেল অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশন'র সাংগঠনিক সম্পাদক ও হোটেল হোয়াইট অর্কিড মহা-ব্যবস্থাপক রিয়াদ ইফতেখার বলেন, 'কক্সবাজারে দৈনিক লাখো মানুষের আবাসন সুযোগ রয়েছে। পাঁচ তারকা থেকে শুরু করে নরমাল হোটেলও আবাসানে সেবা দিচ্ছে। শুধু দেশের যেকোনো শহর নয়, বিশ্বের নানান পর্যটন নগরীর চেয়ে এখানে আবাসন খরচ তুলনামূলক কম।'
কক্সবাজার রেস্তোরাঁ মালিক সমিতির সভাপতি আবুল কাশেম সিকদার বলেন, 'ছোট-বড় মিলিয়ে প্রায় তিন শতাধিক রেস্তোরাঁ, কয়েকশ কনফেকশনারি পর্যটকদের খাবারের সহজলভ্য সেবা দিয়ে আসছে। কক্সবাজারে বেড়াতে আসা যেকোনো পর্যটন হাত বাড়ালেই পছন্দসই খাবার পান।'
কক্সবাজারের পুলিশ সুপার মো. হাসানুজ্জামান বলেন, 'পর্যটন এলাকা হিসেবে কক্সবাজারে ট্যুুরিস্ট পুলিশের চৌকস একটি ইউনিট কাজ করছে। তাদের পাশাপাশি নিরাপত্তায় মাঠে কাজ করে জেলা পুলিশের বিভিন্ন ইউনিট। মাঠে থাকে বিশেষ গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরাও। বিশেষ দিন বলে কোনো কথা নেই; যেকোনো ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে শহরের কয়েকটি পয়েন্টে চেকপোস্ট বসানোসহ গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলোতে প্রতিনিয়ত নজরদারি রাখা হয়।
সার্বক্ষণিক রয়েছে অর্ধশতাধিক সিসি ক্যামেরা মনিটরিং। বলতে গেলে কয়েক স্তরের নিরাপত্তার চাঁদরে ঢাকা থাকেন সৈকতের শহরে বেড়াতে আসা পর্যটকরা।'
কক্সবাজার ট্যুরিস্ট পুলিশের পুলিশ সুপার (এসপি) মো. জিল্লুর রহমান বলেন, 'পর্যটকদের ভ্রমণ নির্বিঘ্ন করতে কক্সবাজার শহরের কলাতলী, সী-ইন ও লাবণী পয়েন্ট সৈকতে ২৪ ঘণ্টা পুলিশ পাহারা থাকে। এছাড়া হিমছড়ি, দরিয়ানগর ও ইনানী পর্যটন স্পটে পুলিশি নিরাপত্তা দেওয়া হয় রাত ১০টা পর্যন্ত। পর্যটকদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে পর্যবেক্ষণ টাওয়ার স্থাপনের পাশাপাশি কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ দপ্তর বা কন্ট্রোল রুম খোলা রয়েছে।'
'পাশাপাশি গোসলে নামার আগে পর্যটকদের জোয়ার-ভাটার সময় দেখে নেওয়ার পরামর্শ সম্বলিত নির্দেশনা রয়েছে সৈকতের বিভিন্ন স্পটে। এছাড়া মাইকিং করে জানানো হয় জোয়ারের সময় সৈকতে সবুজ পতাকা ওড়ানো থাকে; তখন সৈকতে নামা যায়। ভাটার সময় ওড়ানো থাকে লাল নিশানা। তখন সমুদ্রে নামা বিপজ্জনক,' যোগ করেন তিনি।
কক্সবাজার জেলা প্রশাসক মো. মামুনূর রশীদ বলেন, 'বিশেষ ছুটি ছাড়াও সপ্তাহিক ছুটির দিনেও লাখো পর্যটক কক্সবাজার ভ্রমণে আসেন। পর্যটকরা যেন ছিনতাই, ইভটিজিং, হয়রানি ও অতিরিক্ত ভাড়া কিংবা খাবার নিয়ে প্রতারণার শিকার না হন, তা নিশ্চিতে পুরো পর্যটন এলাকায় ভ্রাম্যমাণ আদালত টহলে থাকেন। যেকোনো অভিযোগ জানাতে জেলা প্রশাসনের পর্যটন সেলের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের একটি নাম্বারসহ পর্যটন এলাকার তথ্য সেবা কেন্দ্রে দেয়া রয়েছে। যেকোনো বিপদ বা প্রয়োজনে সেই নাম্বারে যোগাযোগ করলে সব ধরনের সহায়তা দেওয়া হয়।'