সেকালের বিজ্ঞাপনে মহামারি
উনিশ শতকের শেষভাগের বাংলা। সে বড় দুঃসময়। ম্যালেরিয়া, কলেরার মতো মহামারিতে একের পর এক গ্রাম উজার হয়ে চলেছে। বাঁচার আশায় বসতভিটা ফেলে মানুষ ছুটে চলেছে নতুন ঠিকানায়। কলেরা হুটহাট দেখা দিয়ে বিদায় নিলেও ম্যালেরিয়ার প্রকোপ এড়ানো যায় না। খুদে এক প্রাণী মশা, কী বিষ ঢেলে চলেছে মানুষের দেহে! রবীন্দ্রজীবনীকার প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় জীবনসায়াহ্নে এসে স্মরণ করেছেন ম্যালেরিয়ার আবির্ভাবে ওলটপালট হয়ে যাওয়া শৈশবের দিনগুলোর কথা। শৈশবে হারিয়েছেন পরম আদরের ছোট বোনকে। ম্যালেরিয়ায় ধুঁকে ধুঁকে বাবা যখন পৃথিবী ছাড়েন, তখন প্রভাত নিতান্তই কিশোর। ফিরে ফিরে চাই গ্রন্থে তিনি লিখছেন-
'ম্যালেরিয়া জ্বরের ভয়াবহতার কথা আজকের লোক আর জানে না, যদিও ইদানিং আবার শুরু হয়েছে। কিন্তু শতাব্দী-পূর্বে এই ব্যাধির আবির্ভাবের পর কত কোটি লোক যে মরেছিল মশার দংশনে, তার হিসাব দেওয়া যাবে না। হিসাব চাইলে দশশালী আদমশুমারির খণ্ডগুলি দেখতে বলবো। প্লেগ মহামারীর মতো হঠাৎ মারতো না ম্যালেরিয়ার বীজাণু, ধীরে ধীরে জীর্ণ করতো দেহমন। ভুগতে ভুগতে যারা বেঁচে থাকতো, তারা উৎসাহহীন আধমরা জীবমাত্র। মনে আছে অমাবস্যা, পূর্ণিমায় কেঁপে জ্বর আসতো, লেপকম্বল চাপা দিয়ে পড়ে থাকতাম। পরে ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়তো। ডাক্তাররা বলতেন "ডি. গুপ্ত" খাও। "ডি. গুপ্ত"র অর্থ হচ্ছে দ্বারিকানাথ গুপ্তের পেটেন্ট দাওয়াই। কুইনাইন তখন ম্যালেরিয়া জ্বরের ব্রহ্মাস্ত্ররূপে ব্যবহৃত হতো। পোস্টাপিসেও কেনা যেতো কুইনাইনের বড়ি, শিশি। "ডি. গুপ্ত" খেয়ে কিছুই হয় না। মাসান্তে কেঁপে জ্বর আসে। তখন বাজারে "গোবিন্দ সুধা" নামে ম্যালেরিয়ার নতুন ঔষধের চল হয়েছে। "ডি. গুপ্ত"র অনুকরণে কোনো বুদ্ধিমান ব্যবসায়ী এই দাওয়াই চালু করেন।'
দিশেহারা মানুষ তখন নিয়ত খুঁজে চলেছে ম্যালেরিয়া নিরাময়ের কার্যকর কোনো ওষুধ। এ সময়ে বাংলায় গড়ে উঠছে একের পর এক ওষুধালয়। আয়ুর্বেদিকের পাশাপাশি অনেক ওষুধালয় তখন বিলেত থেকে অ্যালোপ্যাথিক ওষুধ আমদানি করে তা দেশীয় নামে, নতুন মোড়কে বাজারে ছাড়ছে। নতুন সেসব ওষুধের খোঁজ বাংলার রুগ্ণ, চিকিৎসা সুবিধাবঞ্চিত জনসাধারণের কাছে পৌঁছাতে হবে, কিন্তু তা কীভাবে? ব্যবসায়ীরা এ সময় আশ্রয় নিলেন ছাপাই বিজ্ঞাপনের। লিফলেট, পত্রিকা আর বিশেষভাবে বাংলা পঞ্জিকায় ছেপে সেসব বিজ্ঞাপন পৌঁছে গেল বাংলার সকল প্রান্তে। ছাপার উৎকর্ষের সাথে বিজ্ঞাপনে যোগ হলো আকর্ষণীয় সব ছবি। শুধু ম্যালেরিয়াই নয়, প্রচলিত সব রোগের নিরাময়ের দাবি নিয়ে হরেক ওষুধের বিজ্ঞাপন নিয়ে উপস্থিত হলেন ব্যবসায়ীরা। দেশের সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীর রোগ নিরাময়ে এবং দেশীয় ওষুধ ব্যবসার প্রসারে আদি বাংলা বিজ্ঞাপনের ভূমিকা তাই বিস্তারিত আলোচনার দাবি রাখে।
বাংলার রোগব্যাধি: ম্যালেরিয়া ও অন্যান্য
উনিশ শতকে জ্বরজারি ছিল বাংলার মানুষের নিত্যসঙ্গী; তবে মহামারির সাথে তার পরিচয় ঘটে দ্বিতীয় দশকে। প্রাপ্ত তথ্যমতে মহামারির শুরুটা হয় যশোরে। যশোর তখন নীল চাষের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ঝুঁকে পড়েছে নীল ব্যবসায়। ব্যবসার সুবিধার্থে দরকার প্রয়োজনীয় অবকাঠামো। ইংরেজ সরকার তাই নতুন সড়ক তৈরির উদ্যোগ নেন। সেই সড়ক তৈরির জন্য বিভিন্ন কারাগার থেকে কয়েদিদের নিয়ে আসা হয়। ১৮১৭ সালে এই সড়ক তৈরির শ্রমিকদের মাঝে এক অদ্ভুত রোগ দেখা দিল। হঠাৎ করে ঘন ঘন ভেদবমি ও মলত্যাগের মধ্য দিয়ে আক্রান্ত শ্রমিকদের খুব দ্রুত মৃত্যু হলো। এই ব্যাধির নতুন নাম রাখা হয় 'এশিয়াটিক কলেরা'। আশ্চর্য হলেও সত্যি, ম্যালেরিয়ার প্রথম মহামারি আকারে সংক্রমণও ঘটেছিল এই যশোরে; তা-ও আবার কাছাকাছি সময়ে- ১৮২৪-২৫ সালে।
সাধারণত বর্ষার শেষে, জলাবদ্ধতার দিনগুলোতে এসব রোগের প্রাদুর্ভাব মহামারি আকার ধারণ করত। এ ছাড়া উৎসব বা তীর্থযাত্রায় লোকসমাগম হলে সেখানেও এসব রোগ, বিশেষত কলেরা ছড়িয়ে পড়ত। সেকালের পত্রপত্রিকা আর স্মৃতিকথাতে এসবের প্রমাণ মেলে। কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত ১৮৫৪ সালে জলপথে গোটা পূর্ববঙ্গ ঘুরে বেড়িয়েছিলেন। তাঁর সেই ভ্রমণকথা 'ভ্রমণকারি বন্ধুর পত্র' নামে নিয়মিত ছেপেছিলেন নিজ পত্রিকা সংবাদ প্রভাকর-এ। বাংলার মানুষের রোগব্যাধি আর অপ্রতুল চিকিৎসাব্যবস্থার কথা সেখানে বিস্তাারিত উঠে এসেছে। রাজশাহী পৌঁছে লিখেছেন-
'এবারকার অতি বৃষ্টিতে পদ্মা অত্যন্ত প্রবলা হওয়াতে অনেকের ঘর, বাটী, পথ, ঘাট ও স্থল সকল জলে প্লাবিত হইয়াছিল, স্থানে স্থানে অদ্যাপি সে জলের শেষ হয় নাই। খানা ডোবা সমুদয় পরিপূর্ণ রহিয়াছে, এজন্য ভূমি অত্যন্ত আদ্র হওয়াতে মধ্যে প্রায় একমাস জ্বর রোগের অত্যন্ত প্রাবল্য হইয়াছিল, তাহাতে বহু প্রাণির হানি হইয়াছে, এইক্ষণে জগদীশ্বরের অণুকম্পায় ক্রমে তাহার ন্যুনতা হইয়া আসিতেছে।'
রাজশাহীর মতন দিনাজপুর, রংপুরের অবস্থাও ছিল ভয়াবহ। সোমপ্রকাশ পত্রিকা রংপুর বিষয়ে ১৮৬৩ সালে লিখেছিল- 'প্রতি গৃহেই প্রায় তৃতীয়াংশের একাংশ লোক পীড়িত। জঙ্গল ও দূষিত বায়ুই এই রোগের কারণ।' উনিশ শতকের শেষভাগে এসব জেলায় প্রতি হাজারে প্রায় ২৫ জনের মৃত্যুর কারণ ছিল জ্বর। অবশ্য এসব জ্বরের কত ভাগ ম্যালেরিয়ার কারণে হয়েছিল, তার কোনো সঠিক উপাত্ত পাওয়া কঠিন। তবে রেলপথের আগমনে বাংলায় ম্যালেরিয়ার প্রকোপ নিশ্চিতভাবে বৃদ্ধি পায়। রেলপথ নির্মাণের জন্য যে উঁচু রাস্তা তৈরি করা হয়, তা নদী এবং অন্যান্য জলধারার স্বাভাবিক গতিপথকে বিঘিœত করে। ফলে বিভিন্ন স্থানে স্থায়ী জলাবদ্ধতা তৈরি হয়। নতুন নির্মিত রেলপথের আশপাশের গ্রামগুলোতে জলাবদ্ধতা থেকে জন্ম নেয় ম্যালেরিয়া। বর্ধমানের মানুষকে এ জন্য সবচেয়ে বড় মাশুল গুনতে হয়। ১৮৫০-এর দশকেও লোকে স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধারে যে বর্ধমানে যেত, গোটা জেলাজুড়ে রেলপথের বিস্তারে সেখানে ম্যালেরিয়া মহাবিপর্যয় ডেকে আনে। ১৮৬২ সালে ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়ে বর্ধমানের মোট জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশ প্রাণ হারায়। ম্যালেরিয়ার নাম হয়ে যায় 'বর্ধমান জ্বর'। মহামারির এই সর্বগ্রাসী ধারা অব্যাহত থাকে, পরবর্তী বছরগুলোতে ঢাকা-ময়মনসিংহ, আসাম-বেঙ্গল রেলওয়েসহ যে যে এলাকায় রেলপথ তৈরি হয়েছে, সেসব এলাকার জনগণ হয়ে উঠেছে ম্যালেরিয়ার অবশ্যম্ভাবী শিকার। ঢাকা প্রকাশ পত্রিকায় ঢাকা এবং পার্শ্ববর্তী এলাকায় ম্যালেরিয়ার ব্যাপক প্রাদুর্ভাবের পেছনে কারণ হিসেবে দায়ী করা হয় পাট চাষকে। ১৮৯১ সালের এক সংখ্যায় বিষয়টি উল্লেখ করা হয় এভাবে- 'পাটে দেশের সর্ব্বনাশ করিল, পাটে জীবনপ্রদ শস্য হানি, পাটে ভূমির উব্বর্রতা হানি, পাটে স্বাস্থ্য হানি, পাটে জীবন হানি করিতে বসিয়াছে। এদেশে যখন এত পাট ছিল না, মেলেরিয়ার কথাও এত ছিল না।' এ সময় অন্য যেকোনো রোগের তুলনায় ম্যালেরিয়ায় আক্রান্তের ও মৃত্যুর সংখ্যা ছিল বহু গুণে বেশি। পূর্ববঙ্গের প্রধান ও বৃহত্তম চিকিৎসাকেন্দ্র মিটফোর্ড হাসপাতালের ১৮৯৫ সালের এক পরিসংখ্যানমতে সে বছর হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়া রোগীর মধ্যে ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ছিল ৩৫৯০ জন। এর বিপরীতে কলেরা রোগীর সংখ্যা ছিল মাত্র ১৫৫ জন। বিশ শতকের প্রথমভাগে প্রকাশিত কের্ডস অব ম্যালেরিয়া সার্ভে অব ইন্ডিয়া গ্রন্থে বলা হয়, সে সময়কার রোগব্যাধিজনিত মৃত্যুর কমপক্ষে অর্ধেকের কারণ ছিল ম্যালেরিয়া। পশ্চিমবঙ্গে ম্যালেরিয়ার সংক্রমণ সব সময়ই পূর্ববঙ্গের তুলনায় বেশি ছিল।
ম্যালেরিয়ার প্রতিষেধক হিসেবে ইংরেজ সরকার ব্যাপকভাবে কুইনাইন সরবরাহের পদক্ষেপ নেয়। ১৮৬০ পরবর্তীকালে ডিস্পেন্সারি থেকে শুরু করে দেশজুড়ে ছড়িয়ে থাকা পোস্ট অফিস, প্রাইমারি স্কুল, পুলিশ স্টেশনের মাধ্যমে প্রচুর পরিমাণে কুইনাইন বিক্রয় এবং অনেক ক্ষেত্রে বিনা মূল্যে সরবরাহের ব্যবস্থা করা হয়। প্রথমদিকে কিছু ফলও পাওয়া যায়। তবে তা ছিল ক্ষণস্থায়ী; দেখা যায়, ম্যালেরিয়ায় মৃত্যু বেড়েই চলেছে। এর পেছনে কাজ করেছে বিবিধ কারণ। একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী কুইনাইনের বিপণন নিয়ে শুরু করে কালোবাজারি। স্থানীয় ডিস্পেন্সারিগুলোতে প্রয়োজনের তুলনায় কম মাত্রার কুইনাইন ভেজাল মিশিয়ে রোগীদের মাঝে বিক্রি করা হতো। ফলে দেখা যেত, বহু কষ্টে তেতো স্বাদের কুইনাইন সেবনের দুই সপ্তাহ পরে আবার জ্বর ফেরত আসত। এ ছাড়া দীর্ঘ শোষণ ও বঞ্চনার কারণে বহু মানুষ ইংরেজদের আরোপিত চিকিৎসাব্যবস্থার ঘোর বিরোধী ছিল। ফলে কুইনাইনকে তারা সহজে গ্রহণ করেনি। এ সময় স্থানীয় সাময়িকপত্রসহ বিভিন্ন প্রকাশনায় কুইনাইনের ব্যাপক বিরোধিতা লক্ষণীয়। অণুবীক্ষণ নামে এক সাময়িকী এ সময় মন্তব্য করে, 'কুইনাইন সেবন করিয়া জ্বর নিবারণ করিলে জ্বর কিছুদিনের মধ্যে পুনরায় ফেরে। পূর্বে যেরূপ উপকার হইত বর্তমান হয় না, কুইনাইন আমাদের শরীরে প্রধান অনিষ্টকারক ঔষধ।' চিকিৎসক নামে অপর এক পত্রিকার অভিযোগ- 'কুইনাইনের নাম শুনিলে লোকে আজকাল চমকিত হয় কেন? যে কুইনাইন একদিন সকলের অদরণীয় ছিল ও মুটেমজুর পর্যন্তের বিশ্বাস ছিল একটু খাইলেই জ্বর আসিতে পারিবে না, সে কুইনাইন আজ সকলের কাছে ঘৃণিত কেন? কেন লোকে হলাহল সেবনে প্রস্তুত তথাপি, কুইনাইন সেবনে স্বীকার হন না?...শুধুমাত্র কুইনাইনই নয়, কুইনাইন ছাড়াও ইউরোপীয় ব্রান্ডি, পোর্ট ও পারাঘটিত ওষুধের বিষক্রিয়া সম্পর্কে জানতে তাদের বাকি রইল না।'
কুইনাইনের বিকল্পের খোঁজে যখন বাংলার মানুষ ব্যস্ত, তখন বাজারে এল 'অত্যাশচর্য্য বটিকা', 'সরকার টনিক', 'সর্বজ্বরাঙ্কুশ', 'চৈতন্য বটিকা', 'বিজয় বটিকা' ইত্যাদি দেশি নামের অনেক অনেক ওষুধ। এর মাঝে অনেকগুলো ছিল বিদেশ থেকে আমদানি করা ওষুধ। বিদেশি ওষুধ নতুন মোড়কে দেশের বাজারে বিক্রি করার বিষয়টিকে প্রভাতকুমার বলেন- 'এলোপ্যাথিক ঔষধে সংস্কৃত নাম জুড়ে দিয়ে শোধণ।' বাংলা পঞ্জিকাগুলোর পাতার পর পাতা ভরে উঠল চটকদার বিজ্ঞাপনে, যেখানে এসব ওষুধকে কুইনাইনের বিপরীতে বহু গুণে কার্যকর দাবি করা হলো। কেমন ছিল যেসব বিজ্ঞাপন? সেসবের প্রভাব জনসাধারণের ওপর কেমন ছিল? বিষয়টি খতিয়ে দেখা যাক।
পঞ্জিকা এবং রোগ নিরাময়ে বিজ্ঞাপন
উনিশ শতকে ছাপাখানার বহুল প্রসারে পঞ্জিকা পৌঁছে যায় বাঙালির ঘরে ঘরে। একশ্রেণির জ্যোতিষী ও প-িতদের পরামর্শে বাঙালির নিত্যদিনের জীবন তখন পঞ্জিকার সাথে বাঁধা। তবে ঔপনিবেশিক যুগে ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের বিধানের সাথে যোগ হলো অভিনব সব বিষয়- ডাকমাশুল, আদালতের ফি, জোয়ার-ভাটার সময় নির্দেশ, রেলওয়ের টাইমটেবিল, স্ট্রিট ডিরেক্টরি এ রকম আরও কত কী। ক্ষীণকায় পঞ্জিকার আকার বড় হতে থাকল; পরিণত হলো নিত্যনৈমিত্তিক জরুরি তথ্যের এক আকরে। বিজ্ঞাপনদাতারা পঞ্জিকার এই বহুল প্রসারকে কাজে লাগাল। একের পর এক বিবিধ পণ্যের বিজ্ঞাপনে ভরে উঠল পাতা। ছাপার অক্ষরে সেসব বিজ্ঞাপনের প্রতি পাঠকদের একধরনের ভক্তি কাজ করত। একসময় পঞ্জিকার চার ভাগের তিন ভাগজুড়ে থাকল বিজ্ঞাপনে। অনেক বিজ্ঞাপনদাতা পণ্যের বিজ্ঞাপনভরা পুস্তিকা ছাপিয়ে পঞ্জিকা প্রকাশকের দপ্তরে পৌঁছে দিলেন; প্রকাশক সেই পুস্তিকা ক্রোড়পত্রের মতন জুড়ে দিলেন নিয়মিত পঞ্জিকার সাথে। এতে পঞ্জিকা প্রকাশকের লাভ দুই দফা- আলাদা করে বিজ্ঞাপন ছাপানোর ঝামেলায় যেতে হলো না, আবার পত্রিকার কাটতি কিংবা অর্থপ্রাপ্তি নিয়েও চিন্তা থাকল না। বিজ্ঞাপনের কল্যাণে পঞ্জিকা ব্যবসা ফুলেফেঁপে উঠল। বাজারে তখন পি এম বাকচি, বেণীমাধব দে এন্ড কোং, গুপ্ত প্রেস আর বঙ্গবাসী পঞ্জিকার রমরমা ব্যবসা। তবে উল্লিখিত সবগুলোই ছিল হিন্দু ধর্মীয় আচারভিত্তিক পঞ্জিকা। মুসলিমদের চাহিদা মেটাতে ১৮৯২ সালে প্রকাশিত হয় বৃহৎ মহম্মদীয় পঞ্জিকা। এক দশকেই এর কলেবর বেড়ে আড়াই শ পৃষ্ঠা ছাড়িয়ে যায়।
জ্বরজারি আর ম্যালেরিয়া শতভাগ সারানোর প্রতিশ্রুতি নিয়ে তখন পঞ্জিকায় বিজ্ঞাপনের ছড়াছড়ি। পঞ্জিকায় ছাপা বিজ্ঞাপনের সিংহভাগ ছিল কবিরাজি ওষুধের। বিজ্ঞাপনের চটকদারি ভাষার তখন রীতিমতো প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গিয়েছে। ক্রেতাকে ভোলাবার জন্য পঞ্জিকাগুলোতে বিজ্ঞাপনের একটা আলাদা ভাষা গড়ে উঠল। সেসব বর্ণনায় পাঠকের ধারণা জন্মাল, ওই ওষুধে রোগীর সব রোগ তো সারবেই, মৃতপ্রায় রোগীও পাবে নতুন জীবন। ক্রেতার আস্থা অর্জনের জন্য সেসব বিজ্ঞাপনে কাঠখোদাই মাধ্যমে ছাপা হতো আকর্ষণীয় সব ছবি। বিজ্ঞাপন জনপ্রিয় হলে একই ছবির ব্যবহার চলত বছরের পর বছর। ডাক বিভাগের সুবিধা পৌঁছে গিয়েছিল বাংলার প্রত্যন্ত জনপদে। ফলে মানি-অর্ডার কিংবা বেয়ারার পোস্টের মতো সেবার মাধ্যমে গ্রামগঞ্জের রোগীরা খুব সহজেই কলকাতাকেন্দ্রিক ওষুধ প্রস্তুতকারী বা বাজারজাতকারী প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে ম্যালেরিয়ার ওষুধ সংগ্রহ করতে পারতেন। ম্যালেরিয়া শতভাগ নিরাময়ের প্রতিশ্রুতি জুড়ে দেওয়া সে রকম কিছু জনপ্রিয় বিজ্ঞাপন এখানে উল্লেখ করা হলো।
বটকৃষ্ণ পালের 'এডোয়ার্ডস টনিক'
কলকাতার বিদেশি ওষুধের এজেন্টদের সাথে যুক্ত হয়ে লন্ডন থেকে অ্যালোপ্যাথি ওষুধ আনতে শুরু করেন বটকৃষ্ণ পাল। সেসব ওষুধের চাহিদা তখন ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। উনিশ শতকের শেষার্ধে সাহেব কোম্পানিগুলোকে পেছনে ফেলে রমরমা হয়ে ওঠে তাঁর ওষুধের ব্যবসা। নিজস্ব গবেষণাগারে সম্পূর্ণ দেশজ উপায়ে সস্তায় তৈরি করেন ম্যালেরিয়ার এলোপ্যাথি ওষুধ। ব্যবসায়িক বুদ্ধির জোরে 'বটকৃষ্ণ পাল এন্ড কোম্পানি'র বিজ্ঞাপনে শুধু পঞ্জিকাই নয়, কলকাতার অলিগলি, রাজপথও ভরে যায়। ব্রিটিশরাজ সরকারের শাসনকালে বিলাতি পণ্যের পাশাপাশি অনেক দেশি পণ্যেও সম্রাট এডওয়ার্ড, মহারানি ভিক্টোরিয়া এসব নাম ব্যবহৃত হত। বটকৃষ্ণ পালের টনিক ছিল সে ধারারই অনুকরণ। টনিকের বিজ্ঞাপনে উল্লেখ করা হয়- 'By appointment to H.R.H. the Prince of Wales.'
ডি. গুপ্তর টনিক
দেশীয় ওষুধের ব্যবসায় এগিয়ে এসেছিলেন পশ্চিমা চিকিৎসাবিদ্যায় শিক্ষিত অনেক বাঙালি। তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ব্যক্তি হলেন ডা. দ্বারকানাথ গুপ্ত। কলকাতা মেডিক্যালের প্রথম ব্যাচের ছাত্র ছিলেন দ্বারকানাথ। ১৮৪০ সালে, মাত্র বাইশ বছর বয়সে প্রতিষ্ঠা করেন মেসার্স ডি. গুপ্ত এন্ড কোং। তাঁর পেটেন্ট করা সকল ওষুধের মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় ছিল এক অ্যান্টিপাইরেটিক মিক্সচার, লোকে একে 'ডি. গুপ্ত টনিক' নামেই চিনত। ভারতের বাইরে আফ্রিকাতেও তাঁর এই টনিক রপ্তানি করা হতো। 'ডি. গুপ্ত টনিক'-এর সংগৃহীত লেবেলে দেখা যায় টাইপোগ্রাফি কাঠখোদাইয়ে লেখা 'ফলেন পরিচায়তে'। এর সাথে যোগ করা আছে বিবরণ- 'দেশব্যাপিত পুরাতন জ্বর, ম্যালেরিয়া জ্বর, পালা ও কম্প জ্বর, প্লীহা ও যকৃৎ সংযুক্ত জ্বর, পৈত্তিকের জ্বর, বিষম দ্বৌকালিন ও মজ্জাগত জ্বরের বিশেষ শান্তিকারক মহৌষধ।' বিশ্বাসযোগ্যতার স্বার্থে বোতলের লেবেলে ডি গুপ্তর স্বাক্ষর ছাপানো থাকত।
শ্রীযদুনাথ মুখোপাধ্যায়ের 'সর্বজ্বরাঙ্কুশ'
উনিশ শতকের শেষভাগ নাগাদ অনেক বাঙালি এলএমএস লাইসেন্স পেয়েছিলেন, অল্প কজন পেয়েছিলেন ডক্টর অব মেডিসিন ডিগ্রি। চিকিৎসাবিদ্যায় শিক্ষিত অনেকে এ সময় ওষুধ ব্যবসায় এগিয়ে আসেন। তাঁদেরই একজন শ্রীযদুনাথ মুখোপাধ্যায়। প্রথম জীবনে ডাক্তার যদুনাথ নিজের লেখা মেডিক্যাল নির্দেশিকাগুলোতে ম্যালেরিয়া প্রতিষেধক হিসেবে কুইনাইনের ব্যাপক প্রশংসা করেছিলেন। ১৮৮৮ সালের মার্চে তিনি নিজ আবিষ্কারের নতুন ওষুধ 'সর্বজ্বরাঙ্কুশ' নামে বাজারে আনেন। পঞ্জিকায় বিজ্ঞাপন বেরোয় যে 'নতুন তৈরি এই ওষুধ স্বল্প-বিরাম জ্বর এবং সবিরাম জ্বর দুইয়েরই মহৌষধ।'
দেবদেবীর ছবির ব্যবহার- শিবশক্তি বটিকা
দেবদেবীর ছবিসহযোগে ম্যালেরিয়া ও জ্বর সারানোর ওষুধের আকর্ষণ বাড়ানোর চেষ্টাও চলেছে। সে রকম একটি নমুনা হলো 'শিবশক্তি বটিকা'র বিজ্ঞাপন। কাঠখোদাই ছবিতে দেখা যায়- বিছানায় শয্যাশায়ী কংকালসর্বস্ব এক রোগীর মাথায় হাত রেখে সেবা করছেন এক রমণী, পেছনে মাথায় সাপ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন শিব। যেন এখনই রোগীকে বড়ি খাইয়ে সুস্থ করে তুলবেন। বিজ্ঞাপনে একে 'সর্ব্বপ্রকার জ্বরের এই একমাত্র ঔষধ' রূপে উল্লেখ করা হয়েছে। তবে অনুরূপ দাবি প্রায় সব বিজ্ঞাপনেই দেখা যায়। 'পূর্ণচন্দ্র আয়ুর্বেদীয় ঔষধালয়' নিজেদের তৈরি 'সর্ব্বজ্বরারি যোগ'কে 'জ্বর-বিজ্বরে সেব্য', 'ম্যালেরিয়া জ্বরের অব্যর্থ মহৌষধ' আখ্যা দেয়।
'বিজয়া বটিকা'র অভিনব বিজ্ঞাপন
ওষুধের বিজ্ঞাপনে নতুনত্ব নিয়ে আসে বি বসু অ্যান্ড কোম্পানির বিজয়া বটিকা। শুধু একটি ওষুধকে নিয়ে গোটা ক্রোড়পত্রই না, ওষুধের উৎপাদন প্রক্রিয়া কতটা আধুনিক এবং কী কী যন্ত্রপাতি ব্যবহার হচ্ছে, তারও পাতাজুড়ে বিজ্ঞাপন দিত এই কোম্পানি। 'বৈজ্ঞানিক উপায়ে যন্ত্রের মাধ্যমে বিশুদ্ধ বড়ি হবে' আর সেই বড়ি খেলে ম্যালেরিয়া থেকে শুরু করে দুনিয়ার তাবৎ জ্বর, জ্বালা থেকে মুক্তি মিলবে বলে দাবি করা হয়। কুইনাইনের সাথে তুলনা করে লেখা হয়- 'কুইনাইন খাইয়া যে জ্বর যায় নাই, বিজয় বটিকায় সহজে ও শীঘ্র তাহা বন্ধ হইবে।' এদের বিজ্ঞাপনে বিদেশি মেমসাহেব ও বাঙালি গৃহিণী উভয়ের ছবি ছাপানো হতো, যাতে সকলের কাছে বটিকাটি গ্রহণযোগ্যতা পায়।
ঢাকায় তৈরি ওষুধের বিজ্ঞাপন
কলকাতা তখন বাংলা মুদ্রণের প্রধান কেন্দ্র হওয়াতে অধিকাংশ পঞ্জিকা এবং সাময়িকী সেখান থেকেই ছাপা হতো। ঢাকা থেকে প্রকাশিত পঞ্জিকার সংখ্যা ছিল হাতে গোনা এবং এতে বিজ্ঞাপন প্রচারও লাভজনক ছিল না। তাই উনিশ শতকে ঢাকায় উৎপাদিত পণ্যের বিজ্ঞাপনের জন্য কলকাতা থেকে প্রকাশিত পঞ্জিকার ওপর নির্ভর করতে হতো। তবে বিশ শতকে ঢাকা থেকে প্রকাশিত পত্রপত্রিকায় উভয় বাংলায় উৎপাদিত ওষুধের বিজ্ঞাপন বৃদ্ধি পায়। অধ্যক্ষ মথুরামোহন চক্রবর্তী ১৯০১ সালে প্রতিষ্ঠা করেন 'শক্তি ঔষধালয়'। ঢাকার এই আয়ুর্বেদিক ওষুধের খ্যাতি ছিল গোটা বাংলাজুড়ে। ঢাকার বাইরে কলকাতাসহ বিভিন্ন শহরে এর ব্যবসা বিস্তৃত ছিল। এ সময়ে ছাপানো এক বিজ্ঞাপনে 'শক্তি ঔষধালয়' তাদের পণ্য 'অমৃতারিষ্ট'কে ম্যালেরিয়া প্রতিরোধে 'অমোঘ মহৌষধ' হিসেবে উল্লেখ করে। 'সাধনা ঔষধলায়ের' বিজ্ঞাপন দেখতে পাই সাহিত্য পত্রিকা দেশ-এর ১৯৪৫ সালের এক সংখ্যায়। ম্যালেরিয়াসহ অন্য সকল জ্বরের চিকিৎসায় তাদের উৎপাদিত ওষুধের নাম ছিল 'সর্ব্বজ্বরবটী'। ক্রেতার আস্থা লাভের জন্য এসব বিজ্ঞাপনে প্রতিষ্ঠাতাদের শিক্ষাগত যোগ্যতা এবং অভিজ্ঞতাকে বিশেষভাবে উল্লেখ করা হতো।
থার্মোমিটারের আদি বিজ্ঞাপন
সেবনযোগ্য ওষুধের পাশাপাশি ঘরে বসে জ্বর মাপার জন্য থার্মোমিটারের বিজ্ঞাপনও লক্ষণীয়ভাবে বৃদ্ধি পায়। শুধু মুখে সেবনযোগ্য ওষুধই নয়, পঞ্জিকায় একধরনের লকেটের বিজ্ঞাপনও ছাপানো হয়, যা পরিধানে ম্যালেরিয়া প্রতিরোধ করা সম্ভব! এ থেকে বোঝা যায় যে সে সময় প্রকৃত ব্যবসায়ীর পাশাপাশি সুযোগসন্ধানী অনেকে শুধুমাত্র লাভের খাতিরে চিকিৎসাপণ্যের ব্যবসায় যুক্ত হয়েছিল। এর ফলে বিপুলসংখ্যক ক্রেতা প্রতারণার শিকার হয়; ক্রেতাদের মধ্যে তৈরি হয় আস্থাহীনতা। শত শত চটকদার বিজ্ঞাপন ওষুধের কার্যকারিতা নিয়ে ব্যাপক বিভ্রান্তি তৈরি করে। ১৯১৭ সালে জনৈক করালীচরণ রায়ের লেখা 'বঙ্গে ম্যালেরিয়া' ছড়ায় ভুক্তভোগী জনসাধারণের দুর্দশা কিছুটা আঁচ করা যায়। আজ থেকে শত বর্ষের বেশিকাল আগে লেখা হলেও ছড়ার মূল বক্তব্যর সাথে অতিমারি আক্রান্ত একালের পাঠক সহজেই যোগসূত্র খুঁজে পাবেন। একালের পাঠকের জন্য নিবন্ধের শেষে দীর্ঘ সেই ছড়াটির একাংশ যুক্ত হলো।
ম্যালেরিয়া বাড়ে যত পেটেন্ট ঔষধ তত
চারিদিকে হ'তেছে উদয়।
দু'চারিটি বাদে তার কোনটিতে নাহি সার
শুধু তাহা প্রবঞ্চনাময়।
ম্যালেরিয়া উপদ্রবে জর্জরিত হ'য়ে সবে
খোঁজে তার আশু প্রতিকার
সুযোগ বুঝিয়া হেন দুষ্ট ব্যবসায়ীগণ
ছাই ভস্ম করিছে প্রচার।
অনভিজ্ঞ জনগণে নানাবিধ বিজ্ঞাপনে
ফেলে যেন মোহিত করিয়া,
সে কুহকে পড়ি তারা হ'য়ে সবে জ্ঞান হারা
ছাই ভস্ম কেনে অর্থ দিয়া।
মূল রোগ নাহি নাশে নানা উপসর্গ আসে
বাড়ায় রোগের জটিলতা।
এতেও নিস্তার নাই আবার দেখিতে পাই
নানা দিকে পাতা নানা ফাঁদ,
দৈব বা সন্যাসী দ- মহৌষধ মহাসত্ত্ব
হাতে দেয় আকাশের চাঁদ।
কবচ, মাদুলি, ডুরি বলয়, তাগা, অঙ্গুরি
নানা ছল করি প্রবর্তনা।
অসাধু মানব সব বর্ণি, গুণ অসম্ভব
অনভিজ্ঞে করে প্রতারণা।
সহায়ক সূত্র:
১. আত্মস্মৃতিতে পূর্ববঙ্গ (১ম খ-), মুনতাসীর মামুন, বাংলা একাডেমি, ২০১৮
২. আদি পঞ্জিকা দর্পণ, অসিত পাল
৩. Malaria and Mortality in Bengal, 1840-1921 by Ira Klein, The Indian Economic & Social History Review, 1972.