বারকোড: ধ্বংসস্তূপ থেকে চট্টগ্রামের ফুড মোগলের উত্থান
চট্টগ্রামের শীর্ষস্থানীয় শিল্পপ্রতিষ্ঠান এন মোহাম্মদ গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা এন মোহাম্মদের বড় ছেলে মঞ্জুরুল হক। ২০১২ সালে বাবার মৃত্যুর শোক কাটিয়ে উঠতে তিনি বারকোড নামে একটি কফিশপ চালু করেন। সংযুক্ত আরব আমিরাতে জন্মানো ও বেড়ে ওঠা মঞ্জুরুল হক সিঙ্গাপুরের থেমস বিজনেস স্কুলে ব্যবসায় ব্যবস্থাপনা বিষয়ে পড়াশোনা করেছেন।
অল্পসময়েই বারকোড ক্যাফে জনপ্রিয়তা লাভ করলে মঞ্জুরুল হক চট্টগ্রামের মুরাদপুরে বাণিজ্যিকভাবে বারকোড সিফুড নামে অপর একটি রেস্তোরাঁ চালু করার সিদ্ধান্ত নেন। প্রায় এক কোটি টাকা খরচ করে তিনি রেস্তোরাঁর সকল ডেকোরেশন সম্পন্ন করেন। ২০১৫ সালের ২৩ মার্চ রেস্টুরেন্ট উদ্বোধনের দিনক্ষণ নির্ধারিত হয়। কিন্তু, উদ্বোধনের আগের রাতে অর্থাৎ, ২২ মার্চ এক অগ্নিকাণ্ডে রেস্তোরেন্টটি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়।
তবে এই ঘটনা দমাতে পারেনি মঞ্জুরুল হককে। তিনি আবারও রেস্টুরেন্টটি চালু করেন। এবার তিনি রেস্টুরেন্টের নামই দিলেন বারকোড অন ফায়ার! বর্তমানে চট্টগ্রামে ১৫টি রেস্টুরেন্টসহ মঞ্জুরুলের ২০টি রেস্টুরেন্ট রয়েছে। এর মধ্যে ঢাকায় চারটি ও সংযুক্ত সংযুক্ত আরব আমিরাতে রয়েছে একটি রেস্টুরেন্ট। এসব রেস্তোরাঁয় স্থানীয় ও কনটিনেনটাল খাবার পরিবেশন করা হয়। ৪০০ জনেরও বেশি মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করেছে বারকোডসহ মঞ্জুরুলের রেস্টুরেন্টগুলো।
দীর্ঘ পথ চলা এবং চট্টগ্রামের ফুড মোগল হিসেবে নিজের উত্থান নিয়ে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের প্রতিবেদক সামচ্ছুদ্দিন ইলিয়াসের সঙ্গে কথা বলেছেন মঞ্জুরুল হক।
রেস্টুরেন্ট শুরু করার চিন্তা কীভাবে আসল?
আমরা তিন ভাই। এক ভাই আমাদের প্লাস্টিক প্রতিষ্ঠান এবং আরেকজন সংযুক্ত আরব আমিরাতে আমাদের ব্যবসা দেখাশোনা করছেন। ২০১০ সালে যখন বাবার ক্যান্সার ধরা পড়ে তখন আসলে আমিই প্লাস্টিক কারখানার দায়িত্বে ছিলাম। বাবার অসুস্থতার পর পারিবারিক সব ধরনের ব্যবসা থেকে সরে যাই। ২০১২ সালের ১৫ মার্চ বাবার মৃত্যুর সময় পর্যন্ত আমি তার সঙ্গে কাটাই। বাবার মৃত্যু আমি খুব কাছ থেকে দেখেছি। মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছিলাম। তখন জীবন অর্থহীন বলে মনে হতো।
প্রচণ্ড অবসাদে ভুগছিলাম আমি। আমার পড়াশোনা ক্যান্টনমেন্ট স্কুল, চিটাগং কলেজ এবং সিঙ্গাপুরের থেমস বিজনেস স্কুল থেকে। দেশের বাইরে পড়ার সময় আমি রেস্টুরেন্টে কাজ করেছি। রেস্টুরেন্টের আগাগোড়া সবকিছুই জানা ছিল। শেষ পর্যন্ত, আমি একটি কফিশপ খোলার সিদ্ধান্ত নিই যেখানে মানুষ এসে বসবে, অবসর সময়গুলো সুন্দরভাবে কাটাবে। আসলে আমি এমন একটি ক্যাফের কথা ভাবছিলাম যেখানে গিয়ে আমি সিনেমা দেখা, গান শোনার পাশাপাশি বন্ধুদের সঙ্গে সময় কাটাতে পারব।
বিষণ্ণতা কাটিয়ে উঠতে আমি ২০১৩ সালের ৯ জুলাই আমার জন্মদিনের দিন বারকোডের যাত্রা শুরু করি। এখানে ক্যাফে স্থাপনের পেছনে আরেকটি কারণ ছিল। চট্টগ্রামে ভালো মানের অ্যামেরিকানো, ক্যাপোচিনো কিংবা ল্যাটে কফি পাওয়া যায় এমন ক্যাফে ছিল না। টাকা দিয়েও আপনি ভালো কফি পেতেন না। আর তাই আমরা ক্যাফে চালু করার পর তা দ্রুত সাড়া ফেলে।
মানুষের প্রতিক্রিয়া দেখে আমি উৎসাহ পাই। তখন আমার মনে হলো যে চট্টগ্রামে অনেক বিশেষায়িত খাবারই নেই। আর তাই আমি একে একে আমার রেস্টুরেন্টগুলোর মধ্য দিয়ে সেগুলো আনতে শুরু করি।
পারিবারিক ব্যবসায় আর যুক্ত হলেন না কেন?
জীবন অনেক ছোট। আর তাই নিজের স্বপ্ন ও ইচ্ছাকে প্রাধান্য দেওয়া উচিত। আমি আমার আগ্রহের জায়গা ধরেই এগিয়ে চলছি। আমার বাবার ইচ্ছা ছিল আমি প্লাস্টিক ও ইঞ্জিনিয়ারিং ছাড়াও নতুন কিছু করব। আমার কঠোর শ্রম তার ফল নিয়ে এসেছে। বাবা আমার জীবনে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। আমি তাকে পরিশ্রম ও সততার মধ্য দিয়ে সফল হতে দেখেছি।
তিনিই আমাকে আমার বর্তমান ব্যবসার সঙ্গে এগিয়ে যাওয়ার পথ দেখিয়েছেন। আমার ব্যবসার ক্ষেত্রে আমি শতভাগ সৎ। স্রেফ লাভের আশায় কোনো অবস্থাতেই আমার গ্রাহকদের ঠকাব না।
খাবারের ব্যবসার চ্যালেঞ্জগুলো কী?
রেস্টুরেন্ট শিল্পের জন্য মহামারি একটি বড় বিপর্যয় ছিল। যেসময় আমরা ব্যবসায় ভালো একটি অবস্থানে যাওয়া শুরু করি, তখনই কোভিড-১৯ আঘাত হানে। সবকিছু থমকে যায়। এরসঙ্গে ভ্যাট প্রদানের মতো বিষয়গুলো আমাদের চূড়ান্তভাবে পর্যুদস্ত করে।
ছোট ব্যবসার জন্য ব্যক্তিগত ও অনিয়মিত উপায়ে হ্যান্ড লোনের সুযোগ বাড়ছে। অন্যদিকে, বৃহৎ ব্যবসাগুলোকে আরো বেশি করে ব্যাংক ঋণের দিকেই ঝুঁকতে হচ্ছে। সরবরাহকারী, বিভিন্ন পরিষেবা দানকারী ও কর্মীদের আপনি বেতন দিতে অসমর্থ হলে তা ভয়ঙ্কর।
অন্য ব্যবসা ও ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে আমি বেতন ও অন্যান্য খরচ চালাতে সক্ষম হই। মহামারির সময় আমার এক কোটির বেশি টাকা লোকসান হয়। রেস্টুরেন্টগুলোকে যখন কেবল টিকে থাকার জন্য লড়াই করতে হচ্ছে, তখন সরকার রেস্টুরেন্টগুলোর ওপর বাড়তি সব কর ও ভ্যাট চাপিয়ে দিচ্ছে।
ফুচকা কেন?
আমি ফুচকা ভালোবাসলেও সবসময় তা খেতে পারতাম না। কেননা, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা বেশ অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বানানো হয়ে থাকে। আর তাই আমি 'স্বাস্থ্যকর' ফুচকা আনার সিদ্ধান্ত নিই। ২০১৫ সালে আমি বার্গউইচ টাউন চালু করি। পরিচ্ছন্ন পরিবেশে ফুচকা খাওয়ার এমন বিশেষায়িত একটি রেস্টুরেন্ট ছিল বড় ধরনের পরিবর্তন।
মেজবান নিয়ে কী বলবেন?
চট্টগ্রামের সবচেয়ে বিখ্যাত ঐতিহ্যবাহী খাবার হলো মেজবান। মেজবান কেবল বিশেষ অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রেই খাওয়া যায়। এছাড়া, চট্টগ্রামের বাইরে থেকে যারা আসেন তারাও মেজবানের স্বাদ নিতে চান। কিন্তু, আমন্ত্রণ ছাড়া কোনো মেজবানে খাওয়া বিব্রতকর একটি বিষয়। আমন্ত্রিত হয়ে আপনি দুই-একজন অতিথিকে নিয়ে আসতে পারেন, কিন্তু পাঁচজন বা বিশজনকে নিয়ে আসা তো কঠিন!
আমি বহুবার এ ধরনের পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছি। আর তাই আমি মেজবান চালু করার সিদ্ধান্ত নিই। এমন একটি রেস্টুরেন্ট যেখানে সত্যিকারের মেজাবানি খাবার পাওয়া যায়। কাঠের চুলার প্রথাগত রন্ধন পদ্ধতি অনুসরণ করে এখানে রান্না করা হয়। মানুষ যদি চট্টগ্রামে এসে মেজবানের প্রকৃত স্বাদ নিতে চান, তাহলে আমার রেস্টুরেন্টে এসে তারা যেন তা পান, সেটি আমি নিশ্চিত করেছি। আমি ঐতিহ্যবাহী খাবারের পদগুলো নিয়ে কাজ করছি যেগুলো এখন শহর থেকে ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে। আমার রেস্টুরেন্ট মেজবাহ গ্রাহকদের আকর্ষণ লাভে সক্ষম হয়েছে।
বীর চট্টলা কেন?
আবারও আমার মনে হয়েছে যে এমন একটি রেস্টুরেন্ট থাকা উচিত যেখানে স্থানীয় খাবারের রোজকার পদ যেমন সাদা-ভাত, ডাল, ভর্তা, কাচ্চি-বিরিয়ানি, মোরগ-পোলাও বা চিরাচরিত বিয়ে বাড়ির খাবার মিলবে।
আমি নিজেও স্থানীয় খাবার পছন্দ করি। আর সেখান থেকেই বীর চট্টলা রেস্টুরেন্টের জন্ম। নামটিও আমার খুব পছন্দের। এমন একটি শব্দ যা আমি ছোট থেকে শুনছি। আর তাই আমি রেস্টুরেন্টের নাম রেখেছি বীর চট্টলা। আমার রেস্টুরেন্টগুলোতে ভিন্ন ধারার পদগুলো মিলিয়ে না ফেলার চেষ্টা করি। আর তাই শুধুমাত্র তেহারির জন্য বিশেষায়িত রেস্টুরেন্ট চালু করেছি যার নাম 'তেহারিওয়ালা'।
নতুন কী আছে?
২৩ সেপ্টেম্বর থেকে কনটিনেনটাল খাবারের জন্য শোলকবাহারে আমরা ওমেট্রা নামে নতুন একটি রেস্টুরেন্ট চালু করেছি। এটি একটি প্রিমিয়াম রেস্টুরেন্ট। খাবারের দাম বিভিন্ন কারণে বেশি রাখা হতে পারে। অন্যান্য দামি পদের সঙ্গে তাই ৯০ টাকার তেহারিও আছে। আমরা সব ধরনের গ্রাহকদের কাছে বিভিন্ন স্বাদের খাবার পৌঁছে দিতে চাই।
আপনার রেস্টুরেন্টের সবচেয়ে জনপ্রিয় পাঁচ পদ কী?
চিকেন স্টিক মিল, ইংলিশ রোস্ট চিকেন, ফুচকা, দোসা ও মেজবান।
আপনার রেস্টুরেন্টগুলো কেন জনপ্রিয়তা লাভ করছে বলে মনে করেন?
আমরা সৎ। আমরা কখনো গ্রাহকদের ঠকাই না কিংবা বাসি-পঁচা খাবার পরিবেশন করি না। আমরা কোনো মেয়াদোর্ত্তীর্ণ খাদ্য উপাদানও ব্যবহার করি না। আমাদের দুটি রেস্টুরেন্ট বীর চট্টলা ও মেজবান হাইলে আইয়ুন-এ কোনো রেফ্রিজারেটর নেই। কেননা, আমরা মনে করি এ ধরনের খাবার ফ্রিজে রাখা বা পরে পরিবেশন করার মতো নয়। গ্রাহকদের কাছে আমরা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ এবং আমরা কখনোই বাসি বা ভেজাল খাবার পরিবেশন করব না।
ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম এবং সশরীরে বিক্রির মধ্যে পার্থক্য কী?
ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে আমরা প্রায় ২০ শতাংশ এবং সশরীরে আগত গ্রাহকদের কাছে ৮০ শতাংশ খাবার বিক্রি করে থাকি।
চট্টগ্রামে খাবারের ব্যবসার ভবিষ্যৎ কী?
এখানে খাবারের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল। নারীরা এখন ঘরের বাইরে বিভিন্ন কাজে এবং ক্যারিয়ার নিয়ে ব্যস্ত। ফলে, তারা রান্নার তেমন সময় পান না। আর তাই বাইরে খাওয়া দিনদিন জনপ্রিয় হচ্ছে। এছাড়া, আমরা ন্যায্য দামে অথেনটিক খাবার বিক্রি করি। দাম যুক্তিসংগত হওয়ায় ঘরে কিংবা বাইরে খাওয়ার খরচের মধ্যে বিশেষ কোনো পার্থক্য নেই। সময়ের সঙ্গে তাই এর জনপ্রিয়তা বাড়ছে।
ব্যক্তিগত সময় ব্যবস্থাপনা করেন কীভাবে?
আমি খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠি এবং সাধারণত দিনে সাড়ে তিন ঘণ্টার বেশি ঘুমাই না। শুক্রবার ও শনিবার বিকালে পরিবারের সঙ্গে সময় কাটাই, যখন আমার বাচ্চাদের কোনো স্কুল থাকে না। দেশে-বিদেশে ঘুরতে ভালোবাসি। এছাড়া, নিত্যনতুন ধারণা পেতে তরুণ গ্রাহকদের সঙ্গে কথা বলতেও পছন্দ করি।