পেরিলা তেল রপ্তানির সম্ভাবনা দেখছে বাংলাদেশ
সাধারণ ভোজ্য তেলের চেয়ে বাড়তি পুষ্টিগুণ সম্পন্ন হাই ভ্যালু তৈল ফসল পেরিলার বাণিজ্যিক চাষ শুরু হয়েছে বাংলাদেশে। স্থানীয়ভাবে উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে আমদানি হয়ে আসা পেরিলা তেলে বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয়ের পাশাপাশি রপ্তানিতেও ভালো সম্ভাবনা দেখছেন উদ্যোক্তা ও পেরিলা ফসল নিয়ে গবেষণাকারীরা।
জানা গেছে, কোরিয়া থেকে আমদানি করা প্রতি লিটার 'পেরিলা তেল' বাংলাদেশের বাজারে ২২০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। বাড়তি পুষ্টিগুণের কারণে ধনী শ্রেণির মধ্যে এই তেলের বিশেষ চাহিদা রয়েছে।
পেরিলা ফসলের চাষাবাদ সারা দেশে ছড়িয়ে দিতে পারলে এরচেয়ে অনেক কম মূল্যে পেরিলা তেল বাজারজাত করা সম্ভব হবে।
গবেষকরা বলছেন, দেশে এ বছরই প্রথম বাণিজ্যিকভাবে সাউ পেরিলা-১-এর চাষাবাদ শুরু হয়েছে। বাণিজ্যিক উৎপাদনের প্রথম বছরেই উচ্চমূল্যের এই তৈল ফসলটি ৪৫টি উপজেলার ১৭ হেক্টর জমিতে চাষ হচ্ছে। সেখান থেকে প্রতি কেজি তৈল বীজ ১২০-১৫০ টাকা কেজি দরে বিক্রির আশা করছেন কৃষকরা।
২০২০ সালের জানুয়ারিতে জাতীয় বীজ বোর্ড সাউথ কোরিয়ান ভ্যারাইটির সাউ পেরিলা-১ (গোল্ডেন পেরিলা বিডি) নামে জাতটির নিবন্ধন দেয় এবং স্থানীয় কৃষকদের জন্য অবমুক্ত করা হয়। জাতটি দেশের আবহাওয়ার উপযোগী করে উদ্ভাবনে শের-ই-বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষিতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. এইচ এম তারিক হোসেনের তত্ত্বাবধানে গবেষণা করেছেন কৃষি কর্মকর্তা মোহাম্মদ আবদুল কাইয়ুম মজুমদার-সহ একদল গবেষক।
জাতটি অবমুক্তির পর ২০২০ সালেই ১৪টি উপজেলায় ( প্রতি উপজেলায় এক বিঘা করে) পরীক্ষামূলক চাষ হয়েছে। ভালো উৎপাদনের পর চলতি বছরেই বাণিজ্যিকভাবে চাষ শুরু হয়েছে। বাংলাদেশের প্রচলিত তেল জাতীয় ফসলগুলো শীতকালে চাষ হলেও এই ফসলের উৎপাদনকাল গরমকাল।
গবেষকরা বলছেন, ভালো দামের কারণে উচ্চমূল্যের তৈল ফসল পেরিলা চাষে কৃষকের মধ্যে আগ্রহ তৈরি হয়েছে। বর্তমানে ফসলটির উৎপাদন মৌসুম চলছে।
তেতুলীয়া উপজেলার কৃষি উদ্যোক্তা সৈয়দ রুকন ১০-১২ বিঘা জমিতে এবার পেরিলার চাষ করেছেন। তিনি দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'আমরা এবার বিনামূল্যে বীজ পেয়েছি। গাছে ফুল এসেছে। নভেম্বরে ফসল তোলা যাবে।'
তিনি বলেন, 'পরবর্তীকালে আর বীজের দরকার পড়বে না। কারণ সরিষার মতো এখান থেকেই চাষের জন্য বীজ সংরক্ষণ করা যাবে।'
কৃষি উদ্যোক্তারা জানান, এটির সরিষার মতোই দানাদার বীজ হয়, যা থেকে মাড়াই করে তেল পাওয়া যায়।
গবেষকরা বলছেন, মাড়াইয়ের পর ৪০ শতাংশ তেল পাওয়া যায়, যেখানে সরিষা থেকে পাওয়া যায় ৪০-৪২ শতাংশ তেল।
গবেষক ও কৃষি কর্মকর্তারা জানান, ফসলটি মাঠ পর্যায়ে থাকা অবস্থাতেই বিভিন্ন ব্যবসায়ী ও বড় কিছু গ্রুপ এটি কিনে নেওয়ার আগ্রহ দেখাচ্ছে। কারণ দেশের বাজারের মতোই রপ্তানিতে এর ভালো বাজার রয়েছে। দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া, তথা দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান, চীন, নেপাল, ভিয়েতনাম ও ভারতের কিছু অঞ্চলে ফসলটির নিয়মিত চাষ হয়। কোরিয়া, জাপান ও চীনে ভোজ্য তেল হিসেবে পেরিলার তেলের ব্যপক চাহিদা রয়েছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মোহাম্মদ আবদুল কাইয়ুম মজুমদার কয়েক বছর ধরে এই গবেষণা করছেন। তিনি মাঠেও ফসলটির সম্প্রসারণে প্রতিনিয়ত কাজ করে যাচ্ছেন।
এই গবেষক দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'প্রথম বছরেই কৃষকদের মধ্যে যেমন আগ্রহ তৈরি হয়েছে, ঠিক তেমন আগ্রহ দেখাচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। কারণ এটি দেশে যেমন চাহিদা রয়েছে, বিদেশেও প্রচুর চাহিদা রয়েছে।'
'সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে দ্রুত এই হাই ভ্যালু ক্রপটির প্রসার ঘটানো সম্ভব। ব্যাপকভাবে উৎপাদন হলে বাংলাদেশে এই তেল অনেক কম দামে পাওয়া যাবে,' যোগ করেন তিনি।
এই কর্মকর্তা আরও জানান, গত বছর পরীক্ষামূলকভাবে আবাদ হওয়ার পর বীজগুলো ৩০০ টাকা কেজি দরে কিনে নিয়ে এ বছর কৃষকদেরকে বিনামূল্যে দেওয়া হয়েছে।
চলতি বছরের ১৫ আগস্ট সায়েন্টিফিক পাবলিকেশন জার্নাল 'বাইনেট'-এ 'ক্যারেক্টারাইজেশন অব ফ্যাটি অ্যাসিডস অ্যান্ড নিউট্রিয়েন্ট কম্পোজিশন অব এসএইউ পেরিলা-১ [(পেরিলা ফ্রুটসেনস (এল.) ব্রিটন] সিডস গ্রোন উইথ অ্যাগ্রো ক্লাইমেটিক কন্ডিশনস ইন বাংলাদেশ' শীর্ষক একটি গবেষণা প্রকাশিত হয়।
গবেষণায় বলা হয়, উচ্চগুণসম্পন্ন ও উচ্চমূল্যের একটি ভোজ্য তৈল ফসল পেরিলা। এই তেলের শতকরা ৬৫ ভাগই ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড, যা হার্টের জন্য উপকারি। মোট ফ্যাটের শতকরা ৯১ ভাগ অ-সম্পৃক্ত। এটি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়, উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করে। এটি চোখের জন্য উপকারি। একইসঙ্গে অসম্পৃক্ত ফ্যাটি অ্যাসিড হৃদযন্ত্র, মস্তিষ্ক ও ত্বকসহ ডায়াবেটিস রোগ প্রতিরোধে কার্যকর ভূমিকা রাখে।
গবেষকরা জানান, সায়েন্টিফিক বিশ্লেষণে পুষ্টি উপাদানের মধ্যে ৫১ শতাংশ ওমেগা-৩ পাওয়া গেছে।
বাংলাদেশের আবহাওয়া উপযোগী এই ফসল সমতলের মতো পাহাড়ি অঞ্চলেও চাষ উপযোগী। যারা মাল্টা, লেবু, আমের বাগান করছেন, তারাও একই বাগানে ফসলটি চাষ করতে পারবেন। ১১০ দিনের মধ্যে এটি থেকে ফলন পাওয়া যায় বলে জানান গবেষকরা।
গবেষকরা বলেন, সাধারণভাবে সরিষা ভাঙানোর মতো করেই এই তেল পাওয়া যায়। তবে এর জন্য একটু ভালো মেশিনারিজ ব্যবহার করা উচিত। কারণ উচ্চমূল্যের এই তেল পরিচ্ছন্নভাবে উৎপাদন করতে না পারলে মান কিছুটা কমে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে।