লাইসেন্সবিহীন পেমেন্ট গেটওয়েগুলোর উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় নতুন আইন
লাইসেন্সবিহীন পেমেন্ট গেটওয়ে ফস্টারের বিরুদ্ধে কিউকমসহ বিভিন্ন ই-কমার্স কোম্পানিগুলোর বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচারের অভিযোগ পাওয়ার পর গেটওয়েগুলোর উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় নতুন আইন প্রণয়নের কাজ শুরু করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
ই-কমার্স কেনাকাটায় এসক্রো সার্ভিস বাধ্যতামূলক করার পর হঠাৎ করেই বিপুল পরিমাণ অর্থপ্রবাহ বাড়ায় বাংলাদেশ ব্যাংকের লাইসেন্স ছাড়া পেমেন্ট গেটওয়ে সেবাদান নিষিদ্ধ করে আইনের খসড়া তৈরি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
'পেমেন্ট এন্ড সেটেলমেন্ট সিস্টেমস অ্যাক্ট ২০২১'- আইনের খসড়া অনুযায়ী, এর আওতায় সংঘটিত অপরাধগুলো ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। আইন লঙ্ঘনের দায়ে মামলা হলে তা জামিন অযোগ্য হবে এবং অভিযোগ প্রমাণিত হলে দায়ী ব্যক্তিদের সর্বোচ্চ ৫০ লাখ টাকা জরিমানা ও পাঁচ বছরের কারাদণ্ড ভোগ করতে হবে।
অন্যদিকে, ই-কমার্স কোম্পানি বা গেটওয়েগুলোতে গ্রাহকের আটকে থাকা টাকা ফেরত দেওয়ার উপায় বের করাসহ নতুন করে কোন কোম্পানি যাতে প্রতারণা করতে না পারে, সেজন্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব এএইচএম সফিকুজ্জামানের নেতৃত্বে একটি আন্তঃমন্ত্রণালয় কমিটি গঠন করেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। কমিটিতে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিভিন্ন সংস্থাসহ গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর প্রতিনিধিরাও রয়েছেন।
এতে ই-কমার্স কোম্পানিগুলোর প্রতারণা মোকাবেলা করা সহজ হবে জানিয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কেন্দ্রীয় ডিজিটাল কমার্স সেলের প্রধান মো. হাফিজুর রহমান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন সংস্থার প্রতিনিধিদের নিয়ে কমিটি গঠিত হওয়ায় আন্তঃসংস্থা সমন্বয়ও সহজ হবে।
তবে প্রতারণার অভিযোগে গ্রেপ্তার বা পালিয়ে থাকা ই-কমার্স কোম্পানিগুলোতে অর্ডার করা ক্রেতারা সহসাই পরিশোধ করা অর্থ ফেরত পাচ্ছেন না বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা।
তারা বলছেন, পেমেন্ট গেটওয়েতে আটকে থাকা এসব অর্থ কিভাবে ক্রেতাদের ফেরত দেওয়া যাবে, সে বিষয়ে উচ্চ আদালতের নির্দেশনা নিয়ে সে মোতাবেক অর্থ ফেরত দিতে পেমেন্ট গেটওয়েগুলোকে নির্দেশনা দেবে বাংলাদেশ ব্যাংক।
এছাড়া, যেসব ই-কমার্স কোম্পানির ব্যবসায়িক কার্যক্রম চলমান রয়েছে, তাদের সঙ্গে পেমেন্ট গেটওয়েগুলোর লেনদেন ও ক্রেতাদের রিফান্ড পাওয়ার প্রক্রিয়া সুনির্দিষ্ট করতে একটি নীতিমালা প্রণয়নের কাজও শুরু করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
তদন্ত, বিচার হবে ফৌজদারি কার্যবিধি অনুযায়ী
পেমেন্ট গেটওয়ে কোম্পানিসহ এই আইনের আওতায় সংশ্লিষ্ট কোন প্রতিষ্ঠানের অপরাধ ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে উল্লেখ করে 'পেমেন্ট এন্ড সেটেলমেন্ট সিস্টেমস অ্যাক্ট ২০২১' খসড়ায় বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছে, এসব অপরাধের তদন্ত, বিচার, আপিল এবং সংশ্লিষ্ট অন্যান্য বিষয় ফৌজদারি কার্যপ্রণালী অনুযায়ী নিষ্পত্তি হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক খোরশেদ আলম বলেন, তত্ত্বাবধান ও নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে পেমেন্ট সিস্টেমের ঝুঁকি হ্রাস করা ও গ্রাহক স্বার্থ সুরক্ষায় একটি আইন প্রণয়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
আইনের খসড়ায় বলা হয়েছে, আইন লঙ্ঘনের দায়ে দেশে কার্যরত সকল পরিশোধ ব্যবস্থা পরিচালনাকারী, পরিশোধ ব্যবস্থায় অংশগ্রহণকারী ও পরিশোধ সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারবে বাংলাদেশ ব্যাংক।
এই আইনের অন্যতম অপরাধ হলো, লাইসেন্সপ্রাপ্ত না হয়ে পরিশোধ কার্যক্রম পরিচালনা করা বা প্রাপ্ত লাইসেন্স বাতিল হবার পরও পরিশোধ কার্যক্রম অব্যাহত রাখা।
এই আইনে বলা হয়েছে, ঋণখেলাপি ব্যক্তি এসব প্রতিষ্ঠানের পরিচালক হতে পারবে না এবং পরিচালকরা বাংলাদেশ ব্যাংকের পূর্বানুমোদন ছাড়া শেয়ার হস্তান্তর করতে পারবে না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের একাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, খসড়াটি ভেটিংয়ের জন্য আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। পরে মন্ত্রিসভার অনুমোদন শেষে আইনটি বিল আকারে সংসদে উত্থাপন করা হবে।
আইনের খসড়ায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশ ব্যাংক কর্মকর্তারা পরিশোধ ব্যবস্থার সঙ্গে জড়িত সকল প্রতিষ্ঠানের যে কোনো কার্যালয় পরিদর্শন করতে পারবে এবং অনিয়ম পেলে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেবে।
এছাড়া ওই প্রতিষ্ঠানের সেবাদানকারী হিসাব বই নিরীক্ষার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক 'বাংলাদেশ চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টস অর্ডার ১৯৯৩' এর ২ এর উপধারায় আইন অনুসারে যোগ্য প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তিকে অডিটর হিসেবে নিয়োগ দিয়ে নিরীক্ষা করতে হবে।
এই আইনের কোনো বিধান লঙ্ঘনের দায়ে প্রতিষ্ঠান এবং ওই প্রতিষ্ঠানের পরিচালক, প্রধান নির্বাহী ও সংশ্লিষ্ট অন্যান্য কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বাংলাদেশ ব্যাংক এক বা একাধিক ব্যবস্থা নিতে পারবে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কেন্দ্রীয় ডিজিটাল কমার্স সেলের প্রধান মো. হাফিজুর রহমান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের লাইসেন্সহীন ফস্টারের কাছে কিউকমের বিপুল পরিমাণ অর্থ আটকে আছে বলে জানা গেছে। এসক্রো সার্ভিসের আওতায় ই-কমার্স গ্রাহকদের স্বার্থ সুরক্ষায় বাংলাদেশ ব্যাংক প্রয়োজনীয় বিধিবিধান প্রণয়ন করছে বলে জানান তিনি।
পেমেন্ট গেটওয়ে থেকে রিফান্ড পেতে দেরি হবে
পঞ্জি স্কিম ও মাল্টিলেভেল মার্কেটিং (এমএলএম) পদ্ধতিতে পরিচালিত হওয়া ই-কমার্স কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে গত জুন থেকে ব্যবস্থা নেওয়ার অংশ হিসেবে গ্রাহকের অর্থ আত্মসাত, অর্থপাচারসহ বিভিন্ন অভিযোগে ইভ্যালি, ই-অরেঞ্জ, ধামাকা শপিং, কিউকম, নিরাপদ বিডিডটকমসহ বিভিন্ন কোম্পানির মালিকদের গ্রেপ্তার করার পর এসব কোম্পানির ব্যবসায়িক কার্যক্রম এখন কার্যত বন্ধ রয়েছে।
এসব কোম্পানিতে অর্ডার করা ক্রেতাদের অর্থ পেমেন্ট গেটওয়ে থেকে ফেরত দেওয়ার উপায় জানতে উচ্চ আদালতের নির্দেশনা নেবে বাংলাদেশ ব্যাংক।
কোম্পানিগুলো বন্ধ হওয়ার আগে এসক্রো সার্ভিসের মাধ্যমে ক্রেতারা যেসব অর্ডার করে মূল্য পরিশোধ করেছেন, সেসব অর্থও পেমেন্ট গেটওয়েগুলোতে আটকে রয়েছে। এসব অর্ডারের কী পরিমাণ ডেলিভারি হয়েছে এবং কী পরিমাণ ডেলিভারি হয়নি, তার তথ্য পেমেন্ট গেটওয়েতে সরবরাহ করেনি ই-কমার্স কোম্পানিগুলো। তাই এসক্রো সার্ভিসের আওতায় এসব কোম্পানিতে অর্ডারকারী গ্রাহকদের পাওনা ফেরত পেতে দেরি হওয়ার আশঙ্কা করছেন তারা।
অন্যদিকে, এসক্রো সার্ভিসের আওতায় ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানে কোন পণ্যের অর্ডার করার পর ক্রেতা ঐ অর্ডার বাতিল করে কিভাবে পেমেন্ট গেটওয়ে থেকে অর্থ ফেরত পেতে পারে, সে বিষয়েও একটি নীতিমালা তৈরির কাজ শুরু করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
কারণ, কোন ক্রেতা অর্ডার করার পর তা কতোদিনের মধ্যে বাতিল করে রিফান্ড দাবি করতে পারবে, বা শুধু ক্রেতার অনুরোধেই অর্ডার বাতিল করা যাবে, নাকি বাতিল করার আগে সংশ্লিষ্ট ই-কমার্স কোম্পানির অনুমোদন লাগবে- সেসব বিষয় এসক্রো সার্ভিসের সার্কুলারে স্পষ্টভাবে উল্লেখ নেই।
গ্রাহকের অর্থ আত্মসাত ও অর্থ পাচারের অভিযোগে গত জুন মাস থেকে ইভ্যালিসহ বিভিন্ন ই-কমার্স কোম্পানির মালিকদের গ্রেপ্তার অভিযান পরিচালনার পর খাতটিতে শৃঙ্খলা ফিরে এসেছে। তবে পেমেন্ট গেটওয়েগুলোতে কাস্টমার ও ই-কমার্স কোম্পানিগুলোর আটকে থাকা বিপুল পরিমাণ টাকা ফেরত পাওয়ার প্রক্রিয়া কী হবে, তা নিয়ে চিন্তিত বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ব্যাংক ও বাংলাদেশ ই-কমার্স এসোসিয়েশনের (ই-ক্যাব) কর্মকর্তারা।
প্রবৃদ্ধি কমে গেছে ই-কমার্সের
করোনা মহামারির সময় লকডাউনের সুযোগে দ্রুত বিকশিত হতে থাকা ই-কমার্স খাতের প্রবৃদ্ধি এখন কমে গেছে বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। তারা বলছেন, ইভ্যালি, ই-অরেঞ্জ, ধামাকা শপিংসহ বিভিন্ন কোম্পানিতে অর্ডার করে বিপুল পরিমাণ ক্রেতা প্রতারিত হওয়ায় এ খাতের উপর ক্রেতাদের আস্থা কমেছে।
সরকার এসব কোম্পানির মালিকদের গ্রেপ্তার করার পাশাপাশি বেশকিছু কোম্পানির আয়-ব্যয় খতিয়ে দেখার উদ্যোগ নেওয়ায় এমএলএম পদ্ধতিতে গ্রাহক ঠকানো কোম্পানিগুলো বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। তবে আগে থেকে যেসব কোম্পানি গ্রাহকদের আস্থা ধরে রেখে সময়মত পণ্য ডেলিভারি দিচ্ছে, তাদের ব্যবসা কমেনি, উল্টো বেড়েছে।
ই-ক্যাবের সাধারণ সম্পাদক আবদুল ওয়াহেদ তমাল দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'ই-কমার্সখাত এখন শৃঙ্খলাবদ্ধভাবে চলছে। প্রতারণার সঙ্গে জড়িত কোম্পানিগুলো বন্ধ হয়ে গেছে, যারা ভালোভাবে পরিচালিত হচ্ছিলো, তারা আগের মতোই ভালোভাবে ব্যবসা করছে। ফলে সামগ্রিকভাবে ই-কমার্স সেক্টরে গ্রোথ কমে গেছে'।
যেসব কোম্পানি বন্ধ হয়ে গেছে, তাদের ক্রেতাদের টাকা পেমেন্ট গেটওয়ে থেকে কিভাবে ফেরত দেওয়া হবে, সে বিষয়ে হাইকোর্টের মতামত নেবে বাংলাদেশ ব্যাংক। আর চালু কোম্পানিগুলোর গ্রাহকরা কিভাবে এসক্রো সার্ভিস থেকে রিফান্ড পেতে পারে, সে বিষয়েও কাজ করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
'ক্রেতাদের রিফান্ড পাওয়ার প্রক্রিয়া সহজ করা না হলে সম্ভাবনাময় ই-কমার্সখাতের উপর ক্রেতাদের আস্থা প্রতিষ্ঠা হবে না', যোগ করেন তিনি।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব ও ডাব্লিউটিও সেলের মহাপরিচালক মোঃ হাফিজুর রহমান বলেন, 'এসক্রো সার্ভিস চালুর পর ক্রেতাদের প্রতারিত হওয়ার অভিযোগ কমে গেছে। তবে পেমেন্ট গেটওয়ে থেকে ই-কমার্স কোম্পানিগুলোর অর্থ ছাড় পাওয়া ও ক্রেতাদের রিফান্ড পাওয়া নিয়ে কিছু অভিযোগ রয়েছে'।
'সমস্যাগুলো সমাধান করা সম্ভব হলে সম্ভাবনাময় ই-কমার্স খাত দ্রুত বিকশিত হবে' বলে মনে করেন তিনি।
হাফিজুর রহমান বলেন, 'ইভ্যালিসহ একই বিজনেস মডেল অনুসরণ করে যেসব কোম্পানি গ্রাহকদের অর্থ আত্মসাত করেছে, সেগুলোর কার্যক্রম গুটিয়ে গেছে। তবে যেসব কোম্পানি আগে থেকেই ক্রেতাদের আস্থা ধরে রেখে ব্যবসা করে আসছে, তাদের ব্যবসার পরিধি আরও বেড়েছে'।
দারাজ বাংলাদেশ লিমিটেডের চিফ কর্পোরেট অ্যাফেয়ার্স অফিসার এ.এইচ.এম. হাসিনুল কুদ্দুস (রুশো) বলেন, 'ই-কমার্সখাতে শৃঙ্খলা নিশ্চিত করতে সরকারের নেওয়া বিভিন্ন পদক্ষেপ অত্যন্ত প্রশংসনীয়। এই অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতেও গ্রাহকরা দারাজের প্রতি আস্থা হারায়নি। ফলে ই-কমার্স খাতের এই বিরূপ অবস্থা দারাজের ব্যবসার সার্বিক পরিস্থিতিতে কোন উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলেনি'।
তিনি বলেন, 'বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের পথনির্দেশনামূলক এসওপি ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতিমালা জনসাধারণের আস্থা অনেকটাই ফিরিয়ে আনবে বলে আমরা আশা করি। ই-কমার্স একটি সম্ভাবনাময় খাত, সরকারের নিবিড় পর্যবেক্ষণ ও গঠনমূলক পদক্ষেপ দ্বারা এই খাতই হতে পারে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে অন্যতম মুখ্য অংশীদার'।