কিডনি প্রতিস্থাপনে জটিলতা কাটেনি
দেশে প্রতিবছর ১০ হাজার রোগীর কিডনি ট্রান্সপ্ল্যান্ট বা প্রতিস্থাপনের প্রয়োজন হয়, যাদের মধ্যে দেশে বছরে গড়ে মাত্র ২৫০ জনের কিডনি প্রতিস্থাপন করা হয়। 'ডোনার' সংকটের কারণে দেশে প্রয়োজনের তুলনায় খুব কম কিডনি প্রতিস্থাপন করা হয়। ডোনার সংকট দূর করতে হাইকোর্ট অনাত্মীয় হলেও কোনো ব্যক্তিকে কিডনি দান করার বিধান রেখে আইন সংশোধনের রায় দিয়েছিল ২০১৯ সালে। দেড় বছরেও আইন সংশোধন করে বিধিমালা হয়নি। তাই এখনো কিডনি ট্রান্সপ্ল্যান্ট জটিলতায় ভোগান্তিতে কিডনি রোগীরা।
চিকিৎসকেরা জানান, বাংলাদেশে প্রতি বছর ৪০ হাজার মানুষের কিডনি বিকল হয়। কিন্তু প্রয়োজনের তুলনায় খুবই নগণ্যসংখ্যক প্রতিস্থাপন হচ্ছে। ডোনার থাকলে দেশে মাত্র ২ থেকে ৩ লাখ টাকা ব্যয় করে কিডনি প্রতিস্থাপন করা সম্ভব, বিদেশে এ খরচ কমপক্ষে ২০ থেকে ৪০ লাখ টাকা।
গণস্বাস্থ্য ডায়ালাইসিস সেন্টারের সমন্বয়ক ডা. মুহিব উল্লাহ খন্দকার দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "কিডনি ট্রান্সপ্ল্যান্ট একটি সহজ অপারেশন, এটি বাইপাসের মতোও জটিল না। আইনি জটিলতার কারণে রোগীরা ডোনার না পেয়ে বিদেশে গিয়ে ১০-২০ লাখ টাকা খরচ করে ট্রান্সপ্ল্যান্ট করছে। ট্রান্সপ্ল্যান্ট পরবর্তী ফলোআপেও লাখ লাখ টাকা খরচ হয়। কিন্তু আদালতের নির্দেশনা বাস্তবায়িত হলে কম খরচে রোগীরা দেশেই ট্রান্সপ্ল্যান্ট করতে পারতো। কারণ আদালতের নির্দেশনার কারণে আইনে এখন ডোনেশনের উপায় অনেক বিস্তৃত হয়েছে"।
উল্লেখ্য, মানবদেহে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংযোজন আইন-১৯৯৯ এ দাতার সংজ্ঞায় ২৪ জনকে নিকটাত্মীয় নির্ধারণ করা হয়।
গত ৫ ডিসেম্বর হাইকোর্টের এক রায়ের পর নিকটাত্মীয়ের সংজ্ঞার বাইরে বিশেষ পরিস্থিতিতে পরিচিত কোনো ব্যক্তি যাচাই-বাছাই সাপেক্ষে 'ইমোশনাল ডোনার' হিসেবে কাউকে কিডনি দিতে পারবেন এমন সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। সংশোধিত মানবদেহে অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সংযোজন আইনের এ সংক্রান্ত ধারা ও বিধান ছয় মাসের মধ্যে সংশোধন করে পদক্ষেপ নিতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
হাইকোর্টের রায়ে বেঁধে দেয়া ৬ মাসের পর দেড় বছর পেরিয়ে গেছে কিন্তু এখনও কোন উদ্যোগ নেয়া হয়নি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একজন অতিরিক্ত সচিব বলেন, "অরগান ট্রান্সপ্ল্যান্ট আইন সংশোধনের বিষয়ে হাইকোর্টের রায়ের পর আইন মন্ত্রণালয়ের মতামত চাওয়া হয়েছে। আইন মন্ত্রণালয়ের মতামতের পর পরবর্তী পদক্ষেপ নেয়া হবে"।
ডা. মুহিব উল্লাহ খন্দকার বলেন, "বাংলাদেশের আইনে যে সীমাবদ্ধতা ছিল তা সংশোধনে আদালত নির্দেশ দিয়েছিল। কিন্তু স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এখনো তা আপডেট করেনি"।
"কিডনি ট্রান্সপ্ল্যান্ট করলে একজন রোগীর ডায়ালাইসিসে যে খরচ হয় তার ৫০% খরচ কমে যাবে। পাশাপাশি ভোগান্তি অনেক কমে যাবে। আমাদের হাসপাতালে অনেক রোগী ডায়ালাইসিস করে, যারা ডোনারের অভাবে ট্রান্সপ্ল্যান্ট করতে পারছেনা। তাই রোগীদের ভোগান্তি কমাতে আদালতের নির্দেশনার বাস্তবায়ন জরুরি", বলেন ডা. মুহিব উল্লাহ।
৩৯ বছরে মাত্র ১৫০০ কিডনি ট্রান্সপ্ল্যান্ট
চিকিৎসকেরা বলেন, বাংলাদেশে হাসপাতাল, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকসহ কিডনি ট্রান্সপ্ল্যান্টের সব ধরণের সক্ষমতা থাকলেও শুধু আইনি জটিলতার কারণে ৩৯ বছরে মাত্র ১৫০০ কিডনি ট্রান্সপ্ল্যান্ট করা হয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ৮০০ কিডনি ট্রান্সপ্ল্যান্ট করা হয়েছে বেসরকারি হাসপাতালে।
৭ বছর কিডনি ট্রান্সপ্ল্যান্ট বন্ধ থাকার পর এ বছরের আগস্টে আবারও কিডনি ট্রান্সপ্ল্যান্ট হয়েছে জাতীয় কিডনি ইনস্টিটটিউট ও হাসপাতালে। করোনাকালে দেড় বছর বন্ধ থাকার পর ৯ অক্টোবর পুনরায় কিডনি প্রতিস্থাপন করেছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালও (বিএসএমএমইউ)।
বিএসএমএমইউয়ের ইউরোলজি রেনাল ট্রান্সপ্ল্যান্ট সার্জারি বিভাগের অধ্যাপক ডা. হাবিবুর রহমান দুলাল টিবিএসকে বলেন, "আমরা আবার কিডনি ট্রান্সপ্ল্যান্ট শুরু করেছি। আমাদের টার্গেট প্রতি সপ্তাহে একটি করে ট্রান্সপ্ল্যান্ট করার। বিএসএমএমইউ, ঢাকা মেডিকেল এবং জাতীয় কিডনি ইনস্টিটটিউট ও হাসপাতাল এই তিন সরকারি ব্যবস্থায় আমরা এখন নিয়মিত কম খরচে কিডনি ট্রান্সপ্ল্যান্টের পরিকল্পনা করছি। কিন্তু সমস্যা হলো, ডোনার সংকট ও দালালদের বিদেশে রোগী টেনে নেয়ার প্রবণতা রয়েছে। আইনি জটিলতা কমলে ট্রান্সপ্ল্যান্ট আরো বাড়বে"।