২০৩০ সালের পরই কেবল স্বস্তি মিলবে যাত্রীদের
আগামী বছর আংশিকভাবে চালু হতে যাচ্ছে মেট্রোরেলের উত্তরা আগারগাঁও-উত্তরা অংশ। কিন্তু তাতে রাজধানী ঢাকায় দৈনন্দিন যানজটের দুর্ভোগ খুব একটা লাঘব হবে না। তবে ২০৩০ সাল নাগাদ মেট্রো রেলের তিনটি লাইন পুরোদমে চালু হলে, তা ব্যাপক প্রভাব ফেলবে।
এই তিনটি লাইনে প্রতিদিন ৩৮ লাখ যাত্রী বহন করা যাবে বলে জানিয়েছে প্রকল্পটি বাস্তবায়নকারী প্রতিষ্ঠান ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল)।
রাজধানীর উত্তরা, মতিঝিল, শাহবাগ, কমলাপুর, পূর্বাচল, মিরপুর-১০ ও বনানীকে ছুঁয়ে যাওয়া মোট ৭১ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের রেল নেটওয়ার্কটি যাতায়াতের সময় ৬৫-৮০ শতাংশ কমাবে।
এমআরটি-৬, ১ ও ৫ (উত্তর)—এ তিন লাইন যথাক্রমে ২০২৪ সালের জুন, ২০২৬ সালের ডিসেম্বর ও ২০২৮ সালের ডিসেম্বরে সম্পূর্ণরূপে চালুর লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে।
তবে কর্মকর্তারা বলছেন, বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ার কিছু বিলম্বের কারণে ১ ও ৫ লাইনের কাজ ২০৩০ সাল নাগাদ শেষ হবে।
ডিএমটিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) এম এ এন সিদ্দিক আশা প্রকাশ করেন, গাবতলী থেকে দেশেরকান্দী হয়ে রাসেল স্কয়ার পর্যন্ত ১৭ কিলোমিটারের বেশি দৈর্ঘ্যের এমআরটি-৫ (দক্ষিণ) লাইনটি হয়তো ২০৩০ সালের মধ্যে কার্যক্রম শুরু করতে পারবে। তবে প্রকল্পের অর্থায়নকারী এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের সঙ্গে ঋণ নিয়ে আলোচনা এখনও অসম্পূর্ণ থাকায়, এ সময়সীমাও নিশ্চিত নয়।
কিন্তু এমআরটি লাইন-২ (গাবতলী-চট্টগ্রাম রোড) এবং এমআরটি লাইন-৪ (কমলাপুর- নারায়ণগঞ্জ) নামের অপর দুটি লাইন আর্থিকভাবে লাভজনক হওয়ার সম্ভাবনা নেই, বলে জানিয়েছে উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সির (জাইকা) এক গবেষণায়। তবে এ দুটি লাইন ছাড়াও রাজধানীবাসীর কাজকর্মের গতিতে ব্যাপক পরিবর্তন আসবে।
এব্যাপারে নাম না প্রকাশের শর্তে একজন জাপানি এমআরটি বিশেষজ্ঞ বলেন, 'শুধু একটি লাইন (এমআরটি লাইন- ৬) চালু করে বড় কোনো সুফল পাওয়া যাবে না। তবে একবার লাইন ১ ও ৫-এর কাজ শেষ হলে, তার একটা মিলিত প্রভাব পড়বে। একইসাথে, যদি বাস র্যাপিড ট্রানজিট চালু হয়, তাহলে ঢাকা আমূল বদলে যাবে।'
দিল্লি ও জাকার্তায় এমআরটি প্রকল্প বাস্তবায়নের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন এ বিশেষজ্ঞ আরও বলেন, 'যাতায়াতের সময় সাশ্রয়সহ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড এবং পরিবেশগত প্রভাবের দিক থেকেও মেট্রোরেলের সুফল পাওয়া যায়। তবে টিকিটের দাম তুলনামূলক সস্তা হওয়ায়, বিশ্বব্যাপীই এমন প্রকল্পের আর্থিক রিটার্নের হার নিশ্চিত করাটা বেশ কঠিন।'
তবে মেট্রোরেল প্রকল্পের সার্বিক অগ্রগতি নিয়ে সন্তুষ্ট নন বিশেষজ্ঞরা।
ঢাকার বাসযোগ্যতা রক্ষায় একে অন্তিম প্রচেষ্টা হিসেবে উল্লেখ করে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. শামসুল আলম বলেন, প্রকল্পগুলো আর্থিকভাবে লাভজনক না হলে, সেগুলো বিনিয়োগকারী পেতেও ব্যর্থ হবে।
'ডিএমটিসিএল ৬টি মেট্রোরেল লাইন নির্মাণের প্রকল্প নিয়েছিল। অন্যদিকে, সেতু বিভাগ ২৫০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের একটি সাবওয়ে নির্মাণের প্রকল্প নিয়েছে। কোনো বিনিয়োগকারী যদি এ দুটি প্রকল্পের একটিতেও আগ্রহ দেখান, তাহলে কিছু সময় পরই এ দুটির সাংঘর্ষিক পরিকল্পনার বিষয়টি বুঝতে পারবেন। তখন কেউই নিজের টাকা লগ্নিতে উৎসাহ দেখাবেন না,' যোগ করেন ড. শামসুল।
দুটি লাইন অর্থায়ন উপযোগী নয়
জাইকা ও ডিএমটিসিএল ২০৩০ সাল নাগাদ ১২৮ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের মোট ৬টি মেট্রো লাইন নির্মাণের পরিকল্পনা করেছে। এই নেটওয়ার্কে ৫১টি এলিভেটেড স্টেশন ও ৫৩টি আন্ডারগ্রাউন্ড স্টেশন থাকবে। ছয়টি লাইন মিলিতভাবে দিনে ৪৭ লাখ যাত্রী পরিবহন করতে পারবে।
তবে ২০১৮ সালে অনুমোদন পাওয়া এমআরটি লাইন-২ হয়তো বাস্তবায়িত হবে না। গাবতলী-নিউ মার্কেট-কমলাপুর পর্যন্ত সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বে (পিপিপি) সরকার এই লাইনটি নির্মাণ করতে চেয়েছিল। প্রাথমিকভাবে এতে আগ্রহও দেখায় জাপানি কোম্পানি মারুবেনি।
২৪ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের এ রেলপথে দৈনিক ১১ লাখ যাত্রী বহনের পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু প্রকল্পের পরামর্শক প্রাথমিক প্রতিবেদনে পিপিপির অধীনে প্রকল্পটি বাস্তবায়নযোগ্য নয় বলে উল্লেখ করেন। ফলে মারুবেনিও এখন সম্পৃক্ত হওয়ার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে সময় নিচ্ছে।
পরিকল্পনা ছিল, এমআরটি লাইন-৪ কমলাপুরকে নারায়ণগঞ্জের সঙ্গে বিদ্যমান নিয়মিত রেল লাইনের সমান্তরালে সংযুক্ত করবে। কিন্তু বাংলাদেশ রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ ইতোমধ্যে তাদের বিদ্যমান লাইনটিকে ডুয়েল গেজ রেল লাইনে রূপান্তরিত করার জন্য একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে। এর ফলে এমআরটি লাইন-৪ কখনোই লাভজনক হবে না- বলে মন্তব্য করা হয়েছে জাইকার এক গবেষণায়।
একটি সংশোধিত কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনায় এই প্রকল্পকে সবচেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। ওই পরিকল্পনায় বলা হয়, রেলওয়ে যদি তাদের যাত্রীসেবা কার্যকর করে, তবে এমআরটি লাইন-৪ বাস্তবায়নের প্রয়োজনই নেই।
অগ্রগতি প্রতিবেদন
উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত ২০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের এমআরটি লাইন-৬ প্রথম লাইন হিসেবে ২০২৪ সালের জুন থেকে পুরোপুরি চালু হবে। এই লাইনটি যেকোনো একটি দিকে প্রতিদিন প্রায় পাঁচ লাখ, অর্থাৎ ঘণ্টায় ১৬ হাজার যাত্রী পরিবহন করতে পারবে। পাঁচ বছর বিলম্বের পর, জাপানের অর্থায়নে ২০১৭ সাল থেকে প্রকল্পটির নির্মাণকাজ শুরু হয়।
২০১৯ সালে ৩১ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের এমআরটি লাইন-১-এর অনুমোদন দেওয়া হয়। লাইনটি বিমানবন্দর থেকে নতুনবাজার-কমলাপুর হয়ে পূর্বাচল পর্যন্ত বিস্তৃত হবে। এ লাইনে প্রতিদিন প্রায় ১৯ লাখ যাত্রী পরিবহন করা যাবে। লাইনের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে পৌঁছতে সময় লাগবে মাত্র ২৪ মিনিট। বর্তমানে সময় লাগে ১১৪ মিনিট।
কিন্তু প্রথম প্রকল্পের মতো এমআরটি-১ এর কাজ শুরু হতেও বেশ কয়েক বছর বিলম্ব হয়েছে। এখন ডিএমটিসিএল ২০২৬ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে লাইনটি চালু করার উদ্দেশ্যে ২০২২ সালের জুলাই থেকে নির্মাণ শুরুর পরিকল্পনা করেছে।
এই লাইনটি যাতায়াতের ক্ষেত্রে দারুণ প্রভাব ফেলবে বলে আশা করা হচ্ছে।
এমআরটি-৫ (উত্তর) লাইনও ২০১৯ সালে অনুমোদন পায়। ২০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের এই লাইনটি মিরপুর ১০ ও বনানী হয়ে হেমায়েতপুর থেকে ভাটারা পর্যন্ত নির্মিত হবে। এই লাইনে প্রায় ১৫ লাখ যাত্রী পরিবহন করা যাবে। ভ্রমণের সময়ও বর্তমানের ১২২ মিনিট থেকে কমে ৩২ মিনিটে নেমে আসবে।
কিন্তু এখনও পর্যন্ত ডিএমটিসিএল তাদের প্রকৃত নির্মাণের শিডিউল ঘোষণা করতে পারেনি। কাগজে-কলমে এটি ২০২৮ সালের শেষের দিকে সম্পন্ন হওয়ার কথা আছে। তবে কর্মকর্তারা বলছেন, লাইনটি ২০৩০ সালের আগে প্রস্তুত হবে না।
২০১৯ সালে অনুমোদন পাওয়া আরেক প্রকল্প এমআরটি ৫-এর (দক্ষিণ) কাজ আরও ধীর হয়ে গেছে। ২০২৩ সালের মাঝামাঝি নাগাদ প্রাথমিক কাজ শেষ করার লক্ষ্যে গত এপ্রিল থেকে কাজ শুরু করেছেন প্রকল্পটির কারিগরি পরামর্শক। কিন্তু এখন পর্যন্ত কর্তৃপক্ষ তাদের আর্থিক বরাদ্দের ৮ শতাংশেরও কম ব্যয় করেছে। প্রকল্পটির কাজ কতটা দুর্বলভাবে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে, এটা তারই লক্ষণ।
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) অতিরিক্ত সচিব ড. পিয়ার মোহাম্মদ দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, আগে এমআরটি লাইন-৫-এর (দক্ষিণ) জন্য এডিবির সঙ্গে আর্থিক আলোচনা সম্পন্ন করতে হবে। এডিবি থেকে ঋণ অনুমোদন এবং সরকারের সঙ্গে চুক্তির আগেই দীর্ঘ সময় লেগে যাবে।
আর্থিক লাভ
সবগুলো এমআরটি নেটওয়ার্ক থেকে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে আর্থিক ও সামাজিক লাভ হবে, বলে আশা করা হচ্ছে।
জাইকার এক গবেষণায় দেখা গেছে, ২০২৬ সালে এমআরটি লাইন-১ পুরোদমে চালু হলে এই লাইনের কল্যাণে প্রতি বছর যানবাহন পরিচালনা খরচ ১ হাজার ৪৬০ কোটি টাকা এবং ৪ হাজার ৬৩৫ কোটি টাকা মূল্যের ভ্রমণের সময় বাঁচাবে।
২০৩৫ সাল নাগাদ প্রতি বছর প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকা সমমূল্যের ভ্রমণের সময় বাঁচাবে। লাইনটি ভ্রমণের সময় ব্যয় ৯ হাজার ৪০০ কোটি টাকা সমমূল্যের ভ্রমণের সময় খরচও সাশ্রয় করবে। এমআরটি শহরে কার্বন নিঃসরণও কমাবে।
এমআরটি-১ নির্মাণে খরচ হবে ২৩ হাজার ২০৩ কোটি টাকা। ৩০ বছর পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনার পর, নির্মাণ ব্যয়সহ এর পেছনে মোট খরচ হবে ৭০ হাজার কোটি টাকা। জাইকার অনুমান, এই সময়ের মধ্যে লাইনটি থেকে ১ লাখ ২০ হাজার ৮৯৪ কোটি টাকার আয় হবে। ফলে মুনাফার পরিমাণ দাঁড়াবে ৫০ হাজার কোটি টাকারও বেশি।
যানজটের কারণে যাত্রীরা যে ক্ষতির শিকার হন, সেই ভ্রমণ সময় খরচও অন্তর্ভুক্ত ছিল জাইকার জরিপে। জরিপটিতে বলা হয়েছে, যানজটের জন্য একটি কারের যাত্রী প্রতি মিনিটে ৮ দশমিক ৯ টাকা লোকসান দেন। যানজটের কারণে মোটরসাইকেল যাত্রী প্রতি মিনিটে ৪ দশমিক ২ টাকা এবং বাস যাত্রীরা ২ দশমিক ৫ টাকা লোকসান গোনেন।
শহরে যানবাহন পরিচালনার খরচের ভিত্তিতে গাড়ির অপারেটিং খরচ হিসাব করা হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, প্রতি কিলোমিটারে একটি গাড়ির খরচ হয় ১৫ টাকা, মোটরসাইকেলের খরচ হয় ২ টাকা এবং বাসের খরচ হয় ২৩ টাকা।