ছাদ খোলা বাসে দূরদূরান্তে যাচ্ছেন ট্রেনের যাত্রীরা
চট্টগ্রাম থেকে ঢাকামুখী মহানগর এক্সপ্রেস ট্রেনে মঙ্গলবার (২৮ জানুয়ারি) ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় যাওয়ার কথা কাতার প্রবাসী উজ্জ্বল মিয়ার। রোববার (২৭ জানুয়ারি) রাত ১২টায় তিনি টিকেট কাটেন। তখনও বলা হয়নি ট্রেন চলবে না। অথচ যাত্রার সময় এসে জানতে পারেন, ট্রেন চলবে না। বাধ্য হয়ে বিআরটিসির ছাদ খোলা বাসে গন্তব্যে রওনা হয়েছেন তিনি।
উজ্জ্বল মিয়া দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "উপায় নেই। বাড়ি যেতে হবে। তাই বাসের খোলা ছাদে হলেও যেতে হবে। তবে গতকাল রাতে যদি জানানো হতো, তবুও দুর্ভোগ কমত না। ট্রেনে যাওয়ার জন্য সকালে না গিয়ে দুপুর সাড়ে ১২টার টিকেট কেটেছি।"
উজ্জ্বলের মতো আরো অনেকেই বিআরটিসির ছাদ খোলা বাসে করে গন্তব্যে ছুটেছেন বাধ্য হয়ে। আবার কেউবা টিকেট ফেরত দিয়ে রিফান্ড করে নিচ্ছেন। কিশোরগঞ্জের ভৈরবের যাত্রী মো. বাবুল মিয়া টিবিএসকে বলেন, "তিন দিন আগে টিকেট করেছি। স্টেশনে এসে শুনলাম, ট্রেন চলবে না। ভৈরবে যাওয়ার কথা। এখন ব্রাহ্মণবাড়িয়া পর্যন্ত যেতে হচ্ছে। ছাদ খোলা বাসের ছাদে করে, রোদের মধ্যেই যেতে হচ্ছে।"
চট্টগ্রাম রেলওয়ে স্টেশনের তথ্যমতে, চট্টগ্রাম থেকে দেশের বিভিন্ন রুটের মোট ১১টি ট্রেনে ৩৬৩৪টি টিকেট অনলাইন ও অফলাইনে বিক্রি করেছে রেলওয়ে। এসব টিকেট ফেরত দেওয়া হচ্ছে। বিকল্প হিসেবে ট্রেনের সময়সূচির সঙ্গে মিলিয়ে বিআরটিসির বাস ছাড়া হচ্ছে।
বিআরটিসির চট্টগ্রাম বিভাগীয় বাস ডিপোর ম্যানেজার জুলফিকার আলী টিবিএসকে বলেন, "আমাদের মোট ৬৭টি বাসের মধ্যে সাধারণত ৪২টি বাস চট্টগ্রাম থেকে ৩৫টি জেলায় যাতায়াত করে। কিন্তু আজ ট্রেন বন্ধ থাকায় আরো ২০টি বাস চলছে ট্রেনের সময়সূচির সঙ্গে মিলিয়ে। শহরের চলাচলকারী বাসগুলোও কাজে লাগানো হচ্ছে। স্কুল যেহেতু বন্ধ, তাই স্কুলের স্মার্ট বাসগুলো রাতে স্বল্প দূরত্বের গন্তব্যে ছেড়ে আবার ফিরিয়ে আনার চিন্তা চলছে। জেলা প্রশাসনের সঙ্গে আলাপ করা হবে। যদি চাহিদা থাকে, তাহলে চালানো হবে।"
তিনি আরো বলেন, "আজ দুপুর দেড়টা পর্যন্ত চারটি বাস ছাড়া হয়েছে। আমরা যাত্রীদের থেকে শুধু টিকেট জমা নিচ্ছি। বাকি আনুষ্ঠানিকতা পরে।"
রেলওয়ের চট্টগ্রাম বিভাগীয় বাণিজ্যিক কর্মকর্তা তৌষিয়া আহমেদ টিবিএসকে বলেন, "সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত সময়সূচির ট্রেনগুলোর জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। দুপুর সাড়ে ১২টা পর্যন্ত পাঁচটি ট্রেন বাতিল হয়েছে। যাত্রীরা চাইলে, টিকেট ফেরত দিয়ে রিফান্ড করতে পারেন। অথবা বিআরটিসি বাসে করেও গন্তব্যে যাত্রা করতে পারেন।"
বাংলাদেশ রেলওয়ের রানিং স্টাফদের কর্মবিরতির কারণে সারাদেশে ট্রেন চলাচল বন্ধ রয়েছে। গতকাল সোমবার (২৭ জানুয়ারি) মধ্যরাতের পর থেকেই রেল যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়।
তিন বছরেও মাইলেজ ইস্যুর সমাধান করেনি সরকার
ব্রিটিশ আমলে প্রতিষ্ঠিত যোগাযোগ সেবাখাত রেলওয়ে মূলত রানিং শেড মেন্যুয়াল এবং স্টাবলিশডমেন্ট কোড অনুসারে পরিচালিত হয়। সংস্থাটিতে টেকনিক্যাল ও দাপ্তরিক অনেক শাখা থাকায় নিজস্ব নিয়মে চলছে ১৮৬২ সাল থেকে।
রেলের নিয়মানুযায়ী, দৈনিক রানিং স্টাফদের ৮ ঘণ্টা অথবা চলন্ত ট্রেনে ১০০ মাইল ডিউটি পালন করেন। ১৯৯৮ সাল থেকে ট্রেন চালকসহ (লোকোমাস্টার) রানিং স্টাফরা অতিরিক্ত প্রতি ৮ ঘণ্টা ডিউটির জন্য একদিনের মূল বেতনের সমপরিমাণ মাইলেজ ভাতা পেয়ে আসছেন। অর্থাৎ প্রতি ঘণ্টায় ডিউটি করলে ১২ দশমিক ৫০ মাইল যুক্ত হতো তাদের নামে। ৮ ঘণ্টায় ১০০ মাইল যুক্ত হতো।
হেডকোয়ার্টারে (নিয়োগকৃত স্টেশন) নির্ধারিত ডিউটির পর টানা ১২ ঘণ্টা বিশ্রামের সুযোগ পেয়ে থাকেন রানিং স্টাফরা। আর হেডকোয়ার্টারের বাইরে অন্য স্টেশনে বিশ্রামের সময় পান টানা ৮ ঘণ্টা। অর্থাৎ এই সময়ের মধ্যে রানিং স্টাফদের ডিউটি করতে বাধ্য করা যায় না। তবে বিশ্রামের সময়ে অর্থাৎ আন্ডাররেস্টে ডিউটিতে যোগ দিলে অতিরিক্ত ৫০ শতাংশ মাইলেজ ভাতা (একদিনের মূল বেতনের অর্ধেক) পান। ডিউটির সময়ের কর্মঘণ্টাও যুক্ত হতো ওভারটাইমে। এছাড়া অবসরের পর মূল বেতনের সঙ্গে ৭৫ শতাংশ মাইলেজ ভাতা যুক্ত করা হতো। তা অনুসারে পেনশন ও আনুতোষিক পরিশোধ করা হতো।
২০২১ সালের ৩ নভেম্বর অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক আদেশে রেলওয়ের রানিং স্টাফদের ১০০ মাইলের বেশি অথবা ৮ ঘণ্টার অধিক সময় দায়িত্ব পালনের জন্য দৈনিক মূল বেতনের ৭৫ শতাংশের বেশি রানিং ভাতা প্রদান বন্ধের সিদ্ধান্ত নেয়। দায়িত্ব পালন করলেও মাইলেজ ভাতা ৩০ কর্মদিবস অর্থাৎ ৩০০০ মাইলের বেশি বিবেচনা করা হবে না। অবসরের পর রানিং স্টাফদের পেনশন ও আনুতোষিক হিসাবের ক্ষেত্রেও মূল বেতনের সঙ্গে ৭৫ শতাংশের বেশি যুক্ত করার বিষয়ে অসম্মতি জানানো হয় ওই আদেশে। ফলে দীর্ঘ ১৬০ বছরের বেশি সময় ধরে চলা নিয়ম বাতিল হয়।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রেলের পরিবহণ বিভাগের রানিং স্টাফদের মধ্যে যথাক্রমে লোকোমাস্টার (এলএম), সহকারী লোকোমাস্টার (এএলএম) ও সাব লোকোমাস্টার বা শান্টিং লোকোমাস্টার (এসএলএম), ক্যারেজ অ্যাটেনডেন্ট, গার্ড, টিকিট ট্রেকার (টিটিই) রয়েছেন। ট্রেন পরিচালনার সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত তারা। রেলের কর্মী সংকট দীর্ঘদিনের। এ কারণে রানিং স্টাফদের অতিরিক্ত ডিউটি করিয়ে চলছে রেল সেবা। নতুন নিয়মে মাইলেজ ভাতা মাসে সর্বোচ্চ ৩০ দিন বা ৩০০০ মাইল সীমিত করায় অনেকে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা ছিল। যেমন: অনেক রানিং স্টাফরা বেশি ডিউটি করে মাসে ৭-৮ হাজার মাইলও অর্জন করছেন।
মাইলেজ সুবিধা সীমিত করার বিষয়টি নিয়ে ২০২২ সালের ১০ এপ্রিল অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ নির্দেশনা জারি করে। এরপর আন্দোলনের মুখে ১৩ এপ্রিল তা আবার প্রত্যাহার করা হয়। এরপর নতুন প্রজ্ঞাপন জারির কথা থাকলেও তা করা হয়নি। এজন্য বেতন-ভাতা পুরাতন নিয়মে বহাল হলেও রানিং স্টাফের অবসরের পেনশন নির্ধারণ নিয়ে জটিলতা তৈরি হয়েছে।
রেলওয়ের তথ্যমতে, রেলের দুই অঞ্চলে বর্তমানে রানিং স্টাফদের মঞ্জুরিকৃত পদের সংখ্যা ৩৬৮৫টি। বর্তমানে এর অর্ধেকেরও কম সংখ্যক স্টাফ রয়েছে।
রানিং স্টাফ ও শ্রমিক কর্মচারী ঐক্য পরিষদের সাংগঠনিক সম্পাদক ওমর ফারুক টিবিএসকে বলেন, "আমরা অনেকবার আন্দোলন করেছি। বারবার আমাদের আশ্বাস দেওয়া হয়েছে। কিন্তু ২০২১ সালের প্রজ্ঞাপনটি বাতিল করা হয়নি। অর্থ উপদেষ্টা, অর্থ সচিবদের বক্তব্যে স্পষ্ট হয়েছে যে, আমাদের অবসরের পরে পেনশন নিয়ে জটিলতা তৈরি হবে। তাই আমাদের দাবি, ২০২১ সালের প্রজ্ঞাপনটি বাতিল করতে হবে। আর নতুন প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে পূর্বের সব সুবিধা বহালের ঘোষণা দিতে হবে।"