ধনী দেশের কৃষি ভর্তুকি কমানোর লাভ-ক্ষতি নিয়ে ভাবছে ঢাকা
উন্নত দেশে কৃষিতে ভর্তুকি কমানোর দাবি ওঠায় উভয় সংকটে পড়েছে বাংলাদেশ। ভর্তুকি কমালে উৎপাদিত কৃষি পণ্যের দাম বাড়বে, ফলে গম ও তুলার মতো সব কৃষিজাত পণ্য আমদানি খরচও বাড়বে।
তবে রপ্তানির অংশে, পরিমাণে এখনও যথেষ্ট কম হলেও, বিশ্ববাজারে টাটকা শাকসবজি ও ফলমূলের দাম বাড়লে তার সুবিধাভোগী হওয়ার সুযোগ রয়েছে বাংলাদেশের সামনে।
বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) কৃষি চুক্তির (এগ্রিমেন্ট অন এগ্রিকালচার) অধীনে সদস্য উন্নত দেশগুলোর সরকার কৃষকদের সহায়তায় ভর্তুকি দেওয়ার সুযোগ পায়। ফলে কৃষি পণ্যের বিশ্ব বাণিজ্যে ভারসাম্যহীন অবস্থার সৃষ্টি হয়। এতে নিজেদের বৈষম্যের শিকার হওয়ার কথা জানিয়ে, এটি বন্ধের দাবী তুলেছে উন্নয়নশীল দেশ ভারত।
কৃষিজ পণ্যের শীর্ষ উৎপাদক ও রপ্তানিকারক ভারত ইস্যুটি ডব্লিউটিও ফোরামে তোলে, দেশটির প্রস্তাবনায় বাণিজ্যে সমতা ফেরাতে, উন্নত দেশের কৃষি ভর্তুকি কমানোর দাবী জানানো হয়।
বাংলাদেশও ভারতীয় প্রস্তাবটি যাচাই-বাছাই করছে। এর তাৎক্ষণিক প্রভাবে উৎস দেশে মূল্যবৃদ্ধির কারণে বাংলাদেশের আমদানি ব্যয় বৃদ্ধির অনুমান করছেন কৃষি-অর্থনীতিবিদ ও বাণিজ্য বিশ্লেষকগণ।
কৃষি ভর্তুকির বিষয়ে সরকারের আগ্রাসী ও রক্ষণাত্মক অবস্থানের মাঝে ভারসাম্য রেখে চলা উচিত বলে পরামর্শ দেন তারা।
এনিয়ে গতকাল সোমবার বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে একটি আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। তবে বাংলাদেশের অবস্থান সম্পর্কে কোনো মন্তব্য করতে রাজী হননি মন্ত্রণালয়ের ডব্লিউটিও সেলের কর্মকর্তারা।
বাণিজ্য বিশ্লেষকগণ বলছেন, ডব্লিউটিও'র 'এগ্রিমেন্ট অন এগ্রিকালচার' নিয়ে সংস্থাটিতে অনেক আলাপ- আলোচনা চলছে। সেখানে অনেক প্রস্তাব উঠছে। ক্ষুদ্র কৃষকদের স্বার্থ রক্ষায় প্রয়োজনে আমদানি শুল্ক বাড়ানোর ব্যাপারে ভারত ডব্লিউটিওতে একটি প্রস্তাব দিয়েছে, তা সমর্থন করেছে বাংলাদেশ।
তবে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ওই প্রস্তাবের বিরোধীতা করে রপ্তানি উন্মুক্ত করার পক্ষে মত দিয়েছে। তার প্রেক্ষিতেই ভারত উন্নত দেশগুলোর কৃষি ভর্তুকি কমানোর প্রস্তাব করে।
এনিয়ে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি-অর্থনীতিবিদ ড. মোহাম্মদ সাইদুর রহমান বলেন, 'কৃষকের খরচের বোঝা লাঘব করার সঙ্গে সঙ্গে বাজারে পণ্যমূল্য কম রাখতে ভর্তুকি দেওয়া হয়। এটি কমানো হলে, মূল্য বেড়ে যাবে, ফলে বাংলাদেশকে আমদানিতে আরও বেশি টাকা খরচ করতে হবে।'
একইভাবে, কৃষিজ পণ্য রপ্তানি বাড়লেও বেশি দামের সুবিধাভোগী হবে বাংলাদেশ। তবে এখাতে বাংলাদেশের বিপুল আমদানির তুলনায় রপ্তানি অনেক কম। সাইদুর রহমানের মতে, 'রপ্তানির পরিমাণের ওপরই আমাদের সুবিধা পাওয়া, না পাওয়া নির্ভর করবে।'
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ-সিপিডি'র সম্মানীয় ফেলো অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান অবশ্য মনে করেন, উন্নত দেশগুলো ভর্তুকি কমালে বৈশ্বিক কৃষি পণ্যের ১১ লাখ কোটি ডলারের ঈপ্সিত বাজারে অন্যান্য অনেক দেশ প্রবেশের সুযোগ পাবে।
ড. মোস্তাফিজুর টিবিএস'কে বলেন, 'ভারতের প্রস্তাব বাংলাদেশের জন্য একইসঙ্গে রক্ষণাত্মক ও আগ্রাসী। কারণ, আমরাও কিছু কৃষিপণ্য রপ্তানি করি, যা ভবিষ্যতে আরও বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। আমাদের দেশেও বাণিজ্যিক কৃষি সম্প্রসারণ হচ্ছে। ধনী দেশগুলো ভর্তুকি কমালে আমাদের রপ্তানিও বাড়বে। আবার ধনী দেশ বিপুল পরিমাণ ভর্তুকি দেওয়ার কারণেই আমরা সস্তায় আমদানি করতে পারি। তবে তারা ভর্তুকি কমালে, এসব পণ্য অনেক বেশি দামে আমদানি করতে হবে।'
'যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও কানাডাসহ বিভিন্ন দেশ বেশি ভর্তুকি দেওয়ার কারণে, অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশ এখন কৃষিপণ্য রপ্তানি করতে পারছে না। ধনী দেশগুলোর ভর্তুকি কমে গেলে অনেক দেশ নতুন করে রপ্তানি শুরু করবে। তখন আন্তর্জাতিক বাজারে কৃষিপণ্যের বাণিজ্যে নতুন ভারসাম্য তৈরি হবে'- জানান তিনি।
বাংলাদেশে বেশিরভাগ নির্ধারিত পণ্যের এগ্রিগেট মেজারমেন্ট অব সাপোর্ট- এএমএস ধান ও গম উৎপাদনে মূল্য সহায়তা হিসেবে দেওয়া হতো। অন্যদিকে, অনির্ধারিত এএমএস-গুলোয় প্রাধান্য পেত সার আমদানিতে ভর্তুকির মতো কার্যক্রম।
এছাড়া স্থানীয় কৃষিকে ট্যারিফ সুরক্ষা দেয় বাংলাদেশ। স্থানীয় বাজারে পর্যাপ্ত সরবরাহ বজায় রাখতে বেশকিছু কৃষিপণ্যের রপ্তানিও নিয়ন্ত্রণ করা হয়। তবে অনেক কৃষিপণ্য রপ্তানিতে নগদ প্রণোদনা দিয়ে উৎসাহিত করা হয়।
স্থানীয় পর্যায়ে কৃষি সহায়তা নীতির আওতায়- কৃষি যন্ত্রপাতি কিনতে স্বল্প সুদের ঋণ, সরকারিভাবে চাল ও গম ক্রয়, সেচকাজে ব্যবহৃত বিদ্যুতের মূল্যে কম ট্যারিফ নির্ধারণসহ কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াকরণ শিল্পে কর অবকাশের সুযোগ দিচ্ছে সরকার।
এদিকে উন্নত ৩৮টি দেশের জোট ওইসিডি ২০১৭ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত ৫৪টি দেশের কৃষি উৎপাদকদের দেওয়া সরকারি সহায়তার হিসাব করেছে, যা তথ্য-পরিসংখ্যান সাইট স্ট্যাটিস্টা সূত্রে জানা যায়। উন্নত দেশগুলিতে উচ্চ কৃষি ভর্তুকি বিশ্বব্যাপী মূল্য হ্রাস করলেও, সেগুলো নিম্ন-আয়ের দেশের কৃষকদের আয় কমায়।
বিশ্বব্যাংকের এক গবেষণায় দেখা গেছে, শুধুমাত্র যুক্তরাষ্ট্রের ভর্তুকিই পশ্চিম আফ্রিকার তুলা রপ্তানি থেকে বার্ষিক আয় ২৫০ মিলিয়ন ডলার হ্রাস করে।
এধরনের একটি স্থানীয় ভর্তুকি হচ্ছে এএমএস, যা কোন দেশের সরকারের পক্ষ থেকে নির্দিষ্ট পণ্য উৎপাদক কৃষক ও সার্বিক কৃষিখাত উভয় ক্ষেত্রেই দেওয়া হয়।
সরাসরি উৎপাদনে প্রভাব ফেলায় ও উৎপাদিত কৃষিজ পণ্যের দাম কম রাখতে সহায়ক হওয়ায় স্থানীয় ও বৈশ্বিক বাজার ব্যবস্থায় ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টিকারী ভর্তুকি হিসেবে দেখা হয়।
এজন্যেই ভারতে গম উৎপাদক কৃষকদের প্রতি সরকারি সহায়তার ঘোষণা বা কানাডার চীনে ক্যানোলা তেল রপ্তানি নীতিতে পরিবর্তনের ফলে ইউক্রেন উদ্বিগ্ন। আবার চীন চালের মজুদ নিলামে বিক্রির উদ্যোগ নেওয়ায় তা যুক্তরাষ্ট্রের মাথাব্যথার কারণ হয়েছে।
ডব্লিউটিও'র ৩২টি সদস্য স্থানীয় কৃষিকে সহায়তা সর্বোচ্চ সহায়তা দেয়, যার মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও ইউক্রেনও রয়েছে। কিন্তু, এ দেশগুলোই আবার ডব্লিউটিও সেক্রেটারিয়েটে নিজ বাণিজ্যিক স্বার্থের বিপক্ষে যাওয়ায়, উন্নয়নশীল দেশের কৃষি সহায়ক নীতি নিয়ে অভিযোগ করছে।
ডব্লিউটিও'তে পাঠানো প্রস্তাবে ভারত উল্লেখ করে যে, উন্নত দেশের কৃষকদের মাথাপিছু উচ্চ হারে সহায়তা দেওয়া হয়, যার তুলনায় উন্নয়নশীল সদস্য দেশের কৃষকদের মাথাপিছু বরাদ্দ অনেক কম। ফলে উন্নত দেশের কৃষিপণ্যের ব্যাপক বাণিজ্যিক উৎপাদন সম্ভব হয় এবং তার ফলে বিশ্ববাণিজ্যের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে।
কৃষকদের সংখ্যা বেশ কম হওয়ায়, উন্নত দেশগুলো তাদের বাণিজ্যের ভারসাম্য নষ্টকারী সহায়তা দেওয়ার ক্ষেত্রেও বেশি সুযোগ পাচ্ছে। অন্যদিকে, উন্নয়নশীল সদস্য দেশগুলোর কৃষক সংখ্যা বেশি হওয়ায়, সকলকে সহায়তা দেওয়া সম্ভব হয় না।
যেমন- সুইজারল্যান্ডের একজন কৃষক বার্ষিক ৩৭ হাজার ৯৫২ ডলার ভর্তুকি পেলেও, একজন ভারতীয় কৃষক পান মাত্র ৪৫১ ডলার।
বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার কৃষি চুক্তির এএমএস সুবিধা সংক্রান্ত ৬.৩ নং ধারা কৃষি বাণিজ্যের নীতিতে উল্লেখযোগ্য হারে অসমতা সৃষ্টি করেছে এবং বেশিরভাগ উন্নয়নশীল দেশের স্বার্থ ক্ষুণ্ণ করছে বলে ভারতীয় প্রস্তাবনার নথিতে বলা হয়েছে।
সেখানে আরো বলা হয়, উন্নত সদস্যরা চুক্তিতে নির্ধারিত 'ডি মিনিমিস' এর চাইতে বিপুল অঙ্কের এএমএস সহায়তা দেওয়ার সুযোগ পাচ্ছে। তাই কৃষি ভর্তুকি সংশোধনের যেকোনো উদ্যোগ নেওয়া হলে, আগে কৃষি বাণিজ্যে উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের মধ্যে অসম ব্যবস্থা দূর করতে হবে। ''
ডি মিনিমিস হলো- ডব্লিউটিও'র 'এগ্রিমেন্ট অন এগ্রিকালচার' চুক্তিতে নির্ধারিত মূল্য সমর্থন ও উৎপাদনে সরাসরি ভর্তুকি সীমার আইনি পরিভাষা।
এই অনুসারে, উন্নত সদস্য দেশ তাদের মোট কৃষি উৎপাদন মূল্যের ১০ শতাংশ নির্দিষ্ট পণ্য ভিত্তিক সহায়তা দিতে পারবে। উন্নয়নশীল দেশের ক্ষেত্রে এই সীমা ২০ শতাংশ।
উন্নয়নশীল দেশ এই সীমার বাইরে স্থানীয় পর্যায়ে ভর্তুকি দিতে না পারলেও, বেশিরভাগ উন্নত দেশের এই সীমা ছাড়িয়ে যাওয়ার সুবিধা রয়েছে। ফলে বাণিজ্যে ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টি হচ্ছে, বলে ভারত যুক্তি দিয়েছে।
যেমন- ১৯৯৫ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত ৪৮ থেকে ৪২ শতাংশের মতো উচ্চ হারে ভর্তুকি দেয় জাপান, যা ছিল ডব্লিউটিও নির্ধারিত মোট কৃষিপণ্য মূল্য সীমার চেয়েও বেশি। একইসময়, নরওয়ের ৬১ থেকে ৩২ শতাংশ এবং সুইজারল্যান্ড ৪৩ থেকে ৩৮ শতাংশ ভর্তুকি দেয়, যাও ছিল সীমার বাইরে।
যুক্তরাষ্ট্রে নির্দিষ্ট পণ্যমূল্যের চেয়ে স্থানীয় ভর্তুকি ৫০ শতাংশের বেশি। এমনকি কিছু ক্ষেত্রে মোট বাজারমূল্যের চেয়েও বেশি। যেমন- ধান চাষে ৮২ শতাংশ ভর্তুকি দেয় মার্কিন সরকার, সূর্যমুখী চাষে দেয় ৬৫, তুলায় ৭৪ ও পশমে ২১৫ শতাংশ।
বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার নমনীয়তার সুযোগ দিয়ে নিজেদের কৌশলগত লক্ষ্যপূরণে ব্যস্ত উন্নত দেশগুলি। কিছু ক্ষেত্রে তারা বছরের পর বছর ধরে একটি একক পণ্যের জন্য সমর্থন দেয়। যেমন- যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডা ডেইরি শিল্পে দিচ্ছে। উদ্দেশ্যপূর্ণ হলে (বাজার দখলের পর) তারা নির্দিষ্ট পণ্যটিতে ধীরে ধীরে সহায়তা কমিয়ে- অন্যান্য পণ্যেও ভর্তুকি দেওয়া শুরু করে।
এই অসমতা দূর করতে, আগামী তিন থেকে পাঁচ বছরের মধ্যে ডব্লিউটিও'র সকল সদস্য দেশ কৃষি ভর্তুকি কমিয়ে নির্ধারিত সীমার মধ্যে আনবে- এমন প্রস্তাব দিয়েছে ভারত। এজন্য প্রত্যেক সদস্যকে সংস্থার কৃষি কমিটির কাছে তাদের প্রদত্ত এএমএস ও উৎপাদিত কৃষি পণ্যের বার্ষিক মূল্য জানাবে, যা এটির বাস্তবায়ন নজরদারির সহায়ক হবে।