চট্টগ্রামে মণ্ডপে হামলা: ডাকসুর সাবেক ভিপি নুরের দলের কর্মীসহ ১০ জন গ্রেপ্তার
চট্টগ্রাম নগরের প্রধান পূজামণ্ডপ জেএমসেন হলে হামলার ঘটনায় নেতৃত্বদানকারী ও সাধারণ মুসল্লিদের হামলায় উসকানিদাতাদের শনাক্ত করেছে পুলিশ।
বৃহস্পতিবার রাতভর অভিযানে ডাকসুর সাবেক ভিপি নুরুল হক নূরের নেতৃত্বাধীন যুব অধিকার ও ছাত্র পরিষদের নয় নেতাকর্মীসহ দশজনকে গ্রেপ্তারের পর এ বিষয়ে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানিয়েছেন কোতোয়ালী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নেজাম উদ্দিন।
তিনি বলেন, 'হামলার ঘটনার কিছু সিসিটিভি ফুটেজ ও স্থিরচিত্র আমাদের হাতে এসেছে। এসব বিশ্লেষণ করে আমরা হামলায় নেতৃত্বদানকারী ও উসকানিদাতাদের শনাক্ত করেছি। এর মধ্যে একজন ইতোমধ্যে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দিও দিয়েছে। দেশকে অস্থিশীল করতে পুরো ঘটনাই ছিল পূর্বপরিকল্পিত।'
ওসি নেজাম উদ্দিন জানান, বৃহস্পতিবার রাতে চট্টগ্রামের সাতকনিয়া, নগরের চকবাজার ও ষোলশহর এলাকায় অভিযান চালিয়ে হামলায় জড়িত দশজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। সব মিলিয়ে ওই ঘটনায় এখন পর্যন্ত মোট ১০০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
বৃহস্পতিবার রাতে যারা গ্রেপ্তার হয়েছেন, তারা হলেন—যুব অধিকার পরিষদ চট্টগ্রাম মহানগরের আহ্বায়ক মো. নাছির (২৫), সদস্য সচিব মিজানুর রহমান (৩৭), বায়েজিদ থানা শাখার আহ্বায়ক ডা. মো. রাসেল (২৬), ছাত্র অধিকার আন্দোলনের দপ্তর সম্পাদক ইমন (২১), ইয়ার মোহাম্মদ (১৮), ইয়াসিন আরাফাত (১৯), হাবিবুল্লাহ মিজান (২১) ও টেরিবাজারের ব্যবসায়ী ইমরান হোসেন। এর বাইরে দুই কিশোরকেও গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তারা হলেন—মো. মিজান (১৭) ও গিয়াস উদ্দিন (১৬)।
ওসি নেজাম উদ্দিন টিবিএসকে বলেন 'হামলার মূল পরিকল্পনায় ছিলেন যুব অধিকার পরিষদ নেতা নাছির, মিজানুর ও রাসেল। তাদের পরিকল্পনাতেই জুমার নামাজ শেষে তাৎক্ষণিক মিছিল ও সমাবেশ করা হয়। পরে সেই মিছিল থেকে হামলা চালানো হয়। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে এ তিনজন ও আন্দরকিল্লা মদিনা হোটেলের ম্যানেজার ইমরান হোসেন হামলার ঘটনার বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়েছে।'
'তবে আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদের আশপাশের টেরিবাজারের দোকানদারদের হামলার জন্য সংঘটিত করেন বিএনপি কর্মী ইমরান মাজেদ রাহুল। তিনি নগরের দেওয়ানবাজার ওয়ার্ড বিএনপির সিনিয়র সহসভাপতি মো. ইলিয়াছের ছেলে। মণ্ডপে হামলার পরপরই রাহুলকে গ্রেপ্তার পুলিশ,' বলেন ওসি।
নেজাম উদ্দিন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানান, হামলায় রাহুলের ইন্ধনের কথা আদালতে স্বীকার করেছে তারই সহযোগী আমির হোসেন (৩০)। তিনি ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছেন। বৃহস্পতিবার চট্টগ্রামের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট শফিউদ্দিনের আদালতে তিনি এ জবানবন্দি দেন। পরে তার দেওয়া স্বীকারোক্তির ভিত্তিতে অনেককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
এর বাইরে হামলায় অংশ নেওয়া ও গ্রেপ্তার হওয়াদের অধিকাংশই নগরের বৃহৎ পাইকারি কাপড়ের বাজার টেরিবাজারের দোকানমালিক ও কর্মচারী। এদের রাজনৈতিক কোনো পরিচয় নেই, ধর্মীয় অনুভূতিকে কাজে লগিয়ে রাহুলই তাদের সংঘটিত করেন।
পুলিশের হাতে থাকা সিসি ক্যামেরার ফুটেজ এবং স্থিরচিত্রে দেখা গেছে, ১৫ অক্টোবর জুমার নামাজের পর বেলা ১টা ৩০ মিনিটের দিকে কয়েকজনের নেতৃত্বে ৫০০ থেকে ৭০০ জন লোক আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদের সামনে 'কুমিল্লার ঘটনার প্রতিবাদ' জানিয়ে সমাবেশ ও মিছিল করে। মিছিলের নেতৃত্বে দেখা যায় যুব অধিকার পরিষদ নেতা নাছির, মিজানুর ও রাসেলকে।
বেলা ১টা ৪০ মিনিটের দিকে নিউমার্কেট এলাকা থেকে হাজারখানেক লোকের একটি মিছিল তুলসীধামের মন্দির এবং নন্দনকানন লোকনাথ মন্দির হয়ে আন্দরকিল্লায় আসার চেষ্টা করে। এ সময় মিছিলটি নন্দনকানন বোস ব্রাদার্স মোড়ে কোতোয়ালী জোনের সহকারী কমিশনার মো. মুজাহিদুল ইসলাম ও ওসি নেজাম উদ্দির নেতৃত্বে থাকা পুলিশের বাধার মুখে পড়ে। পরে মিছিলের একটি অংশ সিনেমা প্যালেস হয়ে আন্দরকিল্লা মোড়ে এসে বিক্ষোভে মিলিত হয়।
সেখান থেকে কয়েক হাজার মানুষের মিছিলটি জেএমসেন হলের দিকে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। শুরুতেই তারা আন্দরকিল্লা মোড়ে পুলিশের বাধার মুখে পড়ে ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। কয়েকটি গ্রুপে বিভক্ত হয়ে পড়ে মিছিলটি। এর মধ্যে একটি গ্রুপ সিরাজদ্দৌল্লা সড়কে, একটি গ্রুপ রেডক্রিসেন্ট গলিতে এবং অপর একটি গ্রুপ মসজিদে ঢুকে পড়ে।
তবে এই ফাঁকে শ'খানেক লোক চলে যায় চেরাগি পাহাড় মোড়ের দিকে। এই গ্রুপটিই মূলত মোমিন রোড অতিক্রম করার সময় পেছন থেকে কয়েকজন জেএমসেন হলের তোরণের ব্যানার ও কাপড় ছিঁড়ে নেয় এবং মন্দিরের দিকে যাওয়ার চেষ্টা করে। এ সময় মিছিলে থাকা বাকিরাও এতে যোগ দেয়। এ সময় পুলিশ টিয়ারশেল ও ফাঁকা গুলি ছুঁড়ে হামলাকারীদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়।
ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী টিপু দাশ টিবিএসকে বলেন, 'হামলাকারীরা শুরুতেই মণ্ডপের তোরণ ভাঙচুর করে, পরে মণ্ডপে প্রবেশের চেষ্টা করে। তবে জেএমসেন হলের মূল ফটক বন্ধ থাকায় তারা প্রবেশ করতে পারেননি। এ সময় সনাতন ধর্মালম্বীরা প্রতিরোধ গড়ার চেষ্টা করলেও পুলিশ তাদের বাধা দেয়।'
চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটনের উপপুলিশ কমিশনার (ডিসি) বিজয় বসাক টিবিএসকে বলেন, 'পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশ শুরু থেকেই সচেষ্ট ছিল। তাই মিছিলের মূল অংশটি মন্দিরের পথে আসতে পারেনি। মন্দিরের সামনেই পুলিশের এপিসি ও গাড়ি দিয়ে একটি প্রতিবন্ধতা তৈরি ছিল। কিন্তু হঠাৎ একদল লোক মণ্ডপের দিকে ধেয়ে যায়। পুলিশের এ্যাকশনের মুখে তারা দুই মিনিটও ঘটনাস্থলে টিকতে পারেনি।'