ঘোড়ার আখ্যান
বহুকাল আগে থেকে ভারতবর্ষে আগমন হচ্ছে বহিরাগতদের। জানেন কি, তাদের অধিকাংশই এই এলাকায় এসেছিল ঘোড়ার পিঠে চড়ে?
শুরুটা নাহয় বৈদিক যুগের মানুষদের দিয়েই করা যাক। এই ইন্দো-ইউরোপীয়রা তাদের ঘোড়া সঙ্গে করেই নিয়ে এসেছিল। এরপর একে একে এসেছে গ্রিকরা, সিথিয়ানরা। এরপর আসে তুর্কি আর মঙ্গোলরা (যারা পরবর্তীতে মোগল নামে বিখ্যাত হয়)। সবার শেষে আসে ব্রিটিশরা, যাদের সঙ্গে এসেছিল দক্ষিণ আফ্রিকা ও অস্ট্রেলিয়ার নিউ সাউথ ওয়েলসের ঘোড়া। এদের অধিকাংশই এসেছি ভাগ্যান্বেষী ও বণিক হিসেবে, তবে অনেকের মনে ছিল ভূমি জয়ের আকাক্সক্ষা। এই শেষের শ্রেণির সফলতার অন্যতম কারণ ছিল তাদের কাছে থাকা ঘোড়া, যা স্থানীয়দের কাছে ছিল না!
ভারতবর্ষে ঘোড়ার ক্রমাগত আগমনের কারণ মূলত দুটো: প্রাণীটার শারীরবৃত্তীয় বৈশিষ্ট্য ও মানসিকতা এবং মানুষের কাছে ঘোড়ার গুরুত্ব।
নতুন চারণভূমির খোঁজে ঘোড়ারা সব সময়ই পথে থাকে। কারণ, গরু-ছাগল ঘাস খেলেও একেবারে মূল থেকে টেনে তোলে না, যা ঘোড়া করে থাকে। তাই একবার ওরা কোনো চারণভূমির ঘাস শেষ করে ফেললে, সেখানে আর নতুন করে ঘাস জন্মাতে কয়েক বছরও লেগে যেতে পারে!
প্রাচীন ইন্দো-ইউরোপীয় ঘোড়া ব্যবসায়ীরা তা-ই করত। এক চারণভূমির ঘাস শেষ হলে প্রয়োজনে অন্যের জমি দখল করে হলেও পশুগুলোর চাহিদা মেটাত তারা। এমনকি ঘোড়ার নামকরণের পেছনেও রয়েছে এই ব্যাপারটা। ঘোড়াকে সংস্কৃতে বলা হয় আমহা বা সীমাবদ্ধতা। এই শব্দ থেকেই উৎপত্তি হয়েছে ইংরেজি 'অ্যাংজাইটি', তথা দুশ্চিন্তা।
ভারতীয় আবহাওয়া ও অশ্বখাদ্য
সমস্যা একটাই- ভারতবর্ষ ঘোড়া পালনের জন্য খুব একটা উপযুক্ত জায়গা নয়!
দক্ষিণ এশিয়ায় ঘোড়ার জন্য উত্তম চারণভূমি পাওয়া মুশকিল। তা ছাড়া এই প্রাণীগুলো এখানকার আবহাওয়ার সঙ্গে খাপও খাওয়াতে পারে না। এখানকার আর্দ্র উত্তাপ সহ্য করতে পারে না ঘোড়ারা। বর্ষার সময় তাদের খুর ভেজা মাটিতে ভেঙে গিয়ে জন্ম দেয় কষ্টদায়ক ক্ষতের।
ভারতীয় মাটিতে গৃহপালিত পশুর জন্য দরকারি ক্যালসিয়াম আর চুনাপাথর থাকলেও ঘোড়ার জন্য তা পর্যাপ্ত নয়। সে জন্যই এখনকার ঘোড়া পালকেরা খাবারের সঙ্গে ক্যালসিয়াম, ম্যাঙ্গানিজ, লোহা আর লবণ মেশায়।
তবে ভারতের ইতিহাসে আমরা যে ঘোড়াগুলোর দেখা পাই, তারা মূলত মধ্য এশিয়া কিংবা পারস্য (অথবা আরবি) এলাকা থেকে আগত...নতুবা তাদের বংশধর। আরবের অনেক অংশে গরম ভারতের চাইতে বেশি বৈ কম না, তবে আবার অনেক অংশ উল্লেখযোগ্য রকমের শীতলও। তার চেয়ে বড় কথা, এই এলাকাগুলোতে ভারতীয় বর্ষকাল নেই, যা ঘোড়া পালকদের কাছে উত্তাপের চাইতে বেশি ভয়ংকর। ওখানকার মাটিতে ভারতের চাইতে অনেক বেশি খনিজ পদার্থ পাওয়া যায়, যা ঘোড়ার টিকে থাকার জন্য সহায়ক হয়।
১৯৯৬ সালের দিকে ভারতে ঘোড়া উৎপাদনের মূল কেন্দ্র ছিল পাঞ্জাব, মহারাষ্ট্র, কর্ণাটক। এদিকে অসংকর ঘোড়ার জন্য শ্রেষ্ঠ স্থান ছিল কলকাতা, পুনে ও মুম্বাই। কাথিয়াবাড়ের ঘোড়াগুলো মরুভূমিতে চলার জন্য সেরা হলেও খুব একটা দ্রুতগামী কিংবা বিশালদেহী নয়; তাই যুদ্ধে ব্যবহারের অযোগ্য।
১২৯১ সালে দিকে ভারতবর্ষে আসেন মার্কো পোলো। অন্য সব ইউরোপীয়দের মতো তিনিও এই এলাকাকে ঘোড়া পালনের জন্য অনুপযুক্ত মনে করেন। বিশেষ করে মালাবারের অবস্থা দেখে বলেন: '[আমার] মন্তব্য হলো, এই প্রদেশের আবহাওয়া ঘোড়ার প্রজাতির জন্য অনুপযুক্ত, আর তাই তাদের উৎপাদন কিংবা পালনে সমস্যা দেখা দেয়...বড় আকৃতির ঘোটকীর গর্ভে ও উত্তম মানের ঘোড়ার ঔরসে জন্ম নেয় ছোটখাটো, অপুষ্ট ছানা; যার পা বাঁকা হয় এবং আরোহণের কাজে লাগানো যায় না!'
আগেই বলেছি, আবহাওয়ার পাশাপাশি এখানকার খাদ্যাভাসও এই সমস্যা বাড়াতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। মার্কো পোলো জোর দিয়ে বলেন, আবহাওয়ার পাশাপাশি বাজে খাবারের জন্যও ভারতবর্ষে ঘোড়া মারা যায়: 'এই এলাকায় চাল বাদে অন্য কোনো ফসল ফলে না বলে ঘোড়াকে খাবার হিসেবে দেওয়া হয় চাল-মাংস এবং মাংসেরই অন্যান্য তরকারি।'
মোগল রাজা আকবরের ইতিহাসবিদ আবুল ফজল (১৫৫১-১৬০২) বলেন যে ঘাসের পাশাপাশি ঘোড়াদের খেতে দেওয়া হয় খড়। যখন কোনোটাই পাওয়া যায় না, তখন দেওয়া হয় সিদ্ধ মটরশুঁটি বা শিমের বিচি, চিনি, ময়দা, লবণ, গুড় আর ঘি। অন্যান্য উৎস জানায়, ভারতবর্ষের ঘোড়ার খাদ্য মূলত গম, বার্লি ও কুলথি ডাল। এদের সঙ্গে অবশ্য মেশানো হতো আরও অনেক কিছু- গরুর দুধ, বাদামি চিনি এবং অনেক সময় ঘি-মিশ্রিত সেদ্ধ মাংসও! এদের মাঝে সবচেয়ে ক্ষতিকর হলো ঘি, যা যেকোনো তৃণভোজীর জন্য বিষতুল্য বলা চলে। এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাগ্রিকালচার অ্যান্ড রুরাল ইকোনোমির সাবেক অধ্যাপক এম টি ওয়ালেস জানান, ভারতীয় ঘোড়াদের সাধারণ খাবারে প্রত্যহ মেশানো হতো ২ পাউন্ড চিনি আর ১ থেকে ২ পাউন্ড ঘি!
এই খাদ্যাভ্যাসের কারণে নানা ধরনের রোগ হতো ঘোড়াদের, বিশেষ করে হতো 'যকৃতে চর্বি জমা-সংক্রান্ত সমস্যা'। এই ধরনের খাবারে অভ্যস্ত হতে বেশির ভাগ সময় চার থেকে পাঁচ মাস পর্যন্ত লেগে যেত। সহিস এক হাতে ঘোড়ার জিব ধরে রেখে, অন্য হাতে গলার ভেতর ঢুকিয়ে দিত খাবার। সকালে দুই পাউন্ড রুক্ষ, কালো চিনির সঙ্গে সমপরিমাণ ময়দা আর এক পাউন্ড মাখন মিশিয়ে খাওয়ানো হতো অবলা প্রাণীগুলোকে। সকালবেলা অবশ্য কিছুটা ঘাস পেত তারা; তবে এমনভাবে ধুয়ে নেওয়া হতো, যেন তাতে মাটি লেগে না থাকে।
ঘোড়াকে ঘি খাওয়ানোর ফল খুবই ভয়াবহ হলেও বেদে উল্লেখ আছে: একটা ঘোড়াকে মুক্ত করে দেওয়া হয়েছিল, যাতে সে ঘি খেতে পারে। 'অশ্বশাস্ত্র'ও জানায়: ঘোটকী আর বাচ্চা ঘোড়াদের ঘি খাওয়াতে হবে।
ভারতবর্ষের সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে ঘোড়া পালন
অনেকেই বলেন: আবহাওয়া নয়, বরং সংস্কৃতিগত কারণেই ভারতে ঘোড়া টিকতে পারে না। খাবারদাবার ও আবহাওয়া তো আছেই, সেই সঙ্গে রাজরাজড়া এবং তাদের কর্মচারীদের ঘোড়া পালনের ব্যাপারে বিন্দুমাত্র ধারণা না থাকাও একটা গুরুত্বপূর্ণ কারণ।
এই যেমন মার্কো পোলো বলেন: 'যত্ন নেবার কিংবা চিকিৎসা করার মতো দক্ষ লোক না থাকার কারণেই বোধ হয় এদের ৩০০টিও [যে পালের কথা বলা হচ্ছে, তাতে মোট পাঁচ হাজার ঘোড়া ছিল] বাঁচবে না। আর সে কারণেই বছর বছর নতুন ঘোড়া আমদানি করতে হয়...'
মার্কো পোলো অবশ্য আরেকটি কারণের দিকেও দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন, যা ঘোড়া ব্যবসায়ীদের সঙ্গে সম্পর্কিত। এই অদক্ষদের হাতে সেবা ও চিকিৎসা ছেড়ে দেওয়ার ব্যাপারটাও 'দুর্ঘটনা' নয়। কারণ, 'বিক্রি করার জন্য যেসব বণিক এই ঘোড়াগুলোকে নিয়ে আসে, তারা সঙ্গে করে সহিস আনে না। কারণ, তারা চায়, এই রাজাদের ঘোড়াগুলো যেন রোগে ভোগে এবং দলে দলে মারা যায়। সে ক্ষেত্রে তারা আবার তাদের ঘোড়া বিক্রি করতে পারবে এবং প্রতিবছর বিস্তর অর্থ কামাতে পারবে।'
স্টিফেন ইংলিশ এমন একটা ধারণাকেই সমর্থন জানিয়ে বলেন: 'আমার পছন্দের গল্পগুলোর একটা হলো, কীভাবে ধূর্ত আরব ব্যবসায়ী দক্ষিণ ভারতের মানুষের কাছ থেকে শত শত বছর ধরে নাল পরানোর কৌশল লুকিয়ে রেখেছিল। তাই অবলা পশুগুলো ভার টানতে টানতে একপর্যায়ে ক্লান্ত হয়ে মারা যায়। এর ফলে ঘোড়াকে স্থানীয়ভাবে দেখা হয় স্বল্পজীবী, আধা-ঐশ্বরিক প্রাণী হিসেবে (এবং আরবদেরও ক্রমাগত ব্যাবসা মেলে)।'
ভারতবর্ষের জন্য অশ্ব মানেই বিলাসিতা
ভারতীয় শাসকেরা সফলভাবে উন্নত জাতের ঘোড়া উৎপাদন করতে পারেননি বলে ঘোড়া আমদানি পরিণত হয় 'ভারতের প্রধান অপব্যয়ে'। বিশেষ করে পশ্চিম আর মধ্য এশিয়া থেকে আমদানি করা হতো এই ঘোড়াগুলো। পরবর্তীতে ৬০০ খ্রিষ্টাব্দে যোগ হয় পারসিয়ান ঘোড়া, এরপর পারসিয়ান ও আরবি ঘোড়ার চাহিদা ক্রমেই বাড়তে থাকে। দাক্ষিণাত্যের সুলতান এবং তাদের শত্রু, মহারাষ্ট্র, রাজস্থান ও বিজয়নগরের হিন্দু রাজারা অধিক পরিমাণে আরবি ঘোড়া আমদানি শুরু করেন। যেহেতু ঘোড়া উৎপাদনের জন্য ঘোটকীর দরকার বেশি হয় এবং ভারতীয়রা ঘোটকীই আমদানি করত, তাই রাজা ও সুলতানদের উদ্দেশ্য আমাদের সামনে পরিষ্কার।
প্রতিটা যুদ্ধজয়ের পর, শাসকেরা তাদের ঘোড়ার পাল আবার নতুন করে গড়ে তুলতেন। নায়াক ও বিজয়নগরের রাজবংশের শেষদিককার রাজাদের ঘোড়া কেনার নেশা ইতিহাসে লিপিবদ্ধ আছে। এমনকি জানা যায়: বিজয়নগরের ষোলো শতাব্দীর এক রাজা প্রতিবছর তার ও তার আমলাদের ব্যবহারের জন্য ১৩ হাজার ঘোড়া আমদানি করতেন। পায়েজ, নুনেজ আর ডিয়াজের মতো পর্তুগিজ বণিকেরা এই ব্যবসা সম্পর্কে বিস্তারিত লিখেছেন। তারা জানান, প্রতিবছর ১০ হাজার আরবি আর পারসিয়ান ঘোড়া মালাবারে আমদানি করা হতো...তাদের উচ্চমূল্য সত্ত্বেও।
মূল কথা হলো: নতুন নতুন জাতের ঘোড়া আমদানি করার জন্য পুরো ব্যাপারটাই অত্যন্ত ব্যয়বহুল হয়ে ওঠে। দেশি-বিদেশি উৎস থেকে আমরা জানতে পারি: দক্ষিণ ভারতীয়রা প্রতিবছর প্রায় চৌদ্দ হাজার ঘোড়া আমদানি করত, যার দাম হবে 'লাল স্বর্ণের' ২২ লাখ দিনার! এই উচ্চমূল্যের আরেকটি কারণ হলো সাগরপথে আসার সময় ঘোড়ার মৃত্যু। মৃত ঘোড়াদের দামও গুনতে হতো রাজাদের। ঘোড়া বমি করতে পারে না বলে সমুদ্রপথে অসুস্থ হয়ে পড়লে তীব্র পেটের ব্যথা এবং প্যাঁচানো নাড়ির কারণেই মারা যেতে পারে!
অথচ খরচ অনেক হলেও ভারতবর্ষে ঘোড়া থেকে বলতে গেলে কোনো সুবিধাই পাওয়া যায় না। গরু কিংবা মহিষের মতো তারা লাঙল টানতে অক্ষম, গৃহপালিত পশুদের মতো দুধও দেয় না। ভারতের রাজস্থান, সিন্ধু আর পাঞ্জাব বাদে কোথাও সওয়ারি হিসেবে ঘোড়া ব্যবহারের নজির তেমন নেই, এমনকি মাল টানার জন্যও এদের ব্যবহার করা হয় না। এদিকে সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা চিন্তা করলে গ্রামবাসীদের পক্ষে ঘোড়া কেনাটাও সম্ভবপর ছিল না। যদি কোনো কৃষক ঘোড়া কেনার মতো অর্থ জমিয়েও ফেলত, তাহলে সেটা দিয়ে কিনত দুটো গরু কিংবা একটা মহিষ! তাই মিশর বা আয়ারল্যান্ডের মতো ভারতে ঘোড়া কখনো নিত্যনৈমিত্তিক কাজে ব্যবহৃত পশু হতে পারেনি।
ঘোড়াকে পোষ মানানো
ঘোড়ার সঙ্গে মানুষের প্রথম যে সম্পর্কটা ছিল, সেটা হলো শিকারের; এমনকি ঘোড়াকে পোষ মানাবার আগেও। গুহার দেয়ালচিত্রে দেখা যেত তাদের ছুটে যেতে, পিছু ধাওয়া করত মানুষ। কিন্তু পোষ মানাবার পর সম্পর্কটা বদলে যায়।
তবে প্রথম ঘোড়াকে যখন পোষ মানানো হয়, তখনো তাদের ব্যবহার করা হতো সেই খাবার হিসেবেই। অবশ্য অল্প কয়েক বছরের মাঝেই গুরুত্বের কারণে ভিন্ন দৃষ্টিতে দেখা হতে থাকে প্রাণীগুলোকে। অতঃপর ঘোড়াদের প্রথমে সওয়ারি হিসেবে ব্যবহার করা হয়, সব শেষে জোতা হয় লাগামের সঙ্গে।
আজকাল বুনো ঘোড়া বলতে গেলে দেখাই যায় না। যা পাওয়া যায়, সেগুলোও আসলে পোষ মানানো...তবে ছাড়া পেয়ে বুনো হয়ে গেছে।
বেশ কিছু সংস্কৃতিতে ঘোড়াকে পোষ মানাবার পদ্ধতি তুলে ধরা হয়েছে নেতিবাচক আঙ্গিকে। আবার ভারত, গ্রিস কিংবা মধ্যযুগীয় ইউরোপ ও ব্রিটেনের কিংবদন্তি অনুসারে, বুনো মানুষদের সভ্যতার দিকে এগিয়ে নিয়ে গেছে ঘোড়া।
অনেক ঘোড়সওয়ারই এই প্রসঙ্গে ঘোড়াকে 'পোষ মানানো' না বলে, তাদের 'শান্ত করা' বলে...যার ফলে এই পশুগুলোর বুনো স্বভাবকে আমরা আমাদের সুবিধায় ব্যবহার করতে পারি এবং তাদেরও ক্ষতি না হয়। সত্যি বলতে কী, মানুষ কখনো সফলভাবে ঘোড়াকে পোষ মানাতে পারেনি! বরং ঘোড়া এমন এক প্রাণী, যা সব সময় নিজের স্বাধীনতার সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রেখে চলেছে।
আজও আমরা শক্তির একক হিসেবে যন্ত্রের ক্ষমতা বোঝাবার জন্য হর্সপাওয়ার এককটি ব্যবহার করি। কিন্তু ঘোড়া তো যন্ত্র নয়। যারা এই পশুর সঙ্গে কাছ থেকে কাজ করে, তারা বলে- ঘোড়াকে কখনো নিয়ন্ত্রণ করা যায় না, কোনো না কোনোভাবে সে সর্বদাই বুনো থাকে।
তাই বলা চলে: ঘোড়া, বাস্তবিক অর্থে এবং ভারতীয় কিংবদন্তি অনুসারে, পোষ মানানোর প্রাণী না, বরং উল্টোটাই সত্যি...তারা পোষ মানা মানুষের ভেতর থেকে বুনো স্বভাবকে বের করে আনে। বেদে অশ্বমেধ যজ্ঞ অনুসারে- যেটা সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ রাজকীয় যজ্ঞ- ঘোড়া এক বছরের জন্য স্বাধীনভাবে ঘুরে বেড়ায়, সঙ্গে থাকে রাজার সৈন্য। ঘোড়াটি যে এলাকায় পা রাখে, সেটাই দখল করে নেয় সৈনিকেরা। এক হিসেবে ব্যাপারটা স্বাধীনতার প্রতীক...যখন ঘোড়াটাকে হত্যা করা হয়, তখন সেই স্বাধীনতা সে তুলে দেয় রাজার হাতে। অর্থাৎ একেবারে সাধারণ একটি ঘোড়াও তার মালিককে নিজের বুনো স্বভাব এবং স্বাধীনতার স্বাদ পাইয়ে দেয়।
ব্যাপারটিকে তাই 'ঘোড়াকে উৎসর্গ' করা না বলে, 'ঘোড়া কর্তৃক উৎসর্গ' বলাই ভালো। যারা ঘোড়া পালন করে, তারা এই আদান-প্রদানকেই মহান হিসেবে উপস্থাপন করে। তারা জানায়: ঘোড়ারা হাসে, কাঁদে, কথা বলে...এবং তার সঙ্গী মানুষকে এতটাই ভালোবাসে যে তার জন্য জীবন দিতেও প্রস্তুত!