তেল, গ্যাস, কয়লার পর এবার সৌর মডিউলের বাজারেও দর বৃদ্ধির আগুন ছড়াচ্ছে
উন্নত দেশে টিকাদানের কল্যাণে মহামারির তীব্রতা কমে এসেছে, অধিকাংশ দেশেই লক্ষ্য করা যাচ্ছে সংক্রমণ পরিস্থিতির উন্নতি। ফলে ভ্রমণ ও ব্যবসা-বাণিজ্যের পরিবেশে উন্নতি হয়েছে, বেড়েছে পণ্যভোগের চাহিদা। কিন্তু, সরবরাহ স্বল্পতার কারণে একইসঙ্গে দেখা দিয়েছে তেল, গ্যাস ও কয়লার মতো প্রধান প্রধান প্রচলিত জ্বালানির সংকট। যা এবার নবায়নযোগ্য ও দূষণমুক্ত শক্তি উৎপাদনের গুরুত্বপূর্ণ পণ্য- সৌরকোষ উৎপাদনেও প্রভাব ফেলছে।
আন্তর্জাতিক বাজারে বেড়েই চলেছে সোলার মডিউলের দাম। প্রতিবেশী ভারতে বর্তমান মূল্যে মডিউল কিনে প্রতি কিলোওয়াট-ঘণ্টা বিদ্যুৎ উৎপাদনের খরচ বেড়ে ২৮ সেন্টে উন্নীত হয়েছে। ২০১৯ সালের পর ভারতে সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনের এটাই সর্বোচ্চ খরচ।
চীনে ব্যাপক বিদ্যুৎ সংকটই সৌরখাতে চড়া দরের প্রধান কারণ। বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহৎ অর্থনীতির এ সংকটে ব্যাহত হয়েছে কারখানা কার্যক্রম। চাহিদা পূরণে দরকারি সোলার মডিউল উৎপাদন সম্ভব হচ্ছে না।
অথচ বাণিজ্যিকভাবে সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদন প্রকল্পের ৬০ ভাগ খরচই হয় মডিউল কিনতে। এধরনের চড়া দাম তাই অন্তর্বর্তী আয় অর্জনের হার কমিয়ে, বিমুখ করবে নতুন বিনিয়োগকারীদের।
দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে বড় অর্থনীতি ভারতে মহামারির আগেই বাণিজ্যিক পর্যায়ে সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনের বেশকিছু বড় প্রকল্প শুরু হয়। এরমধ্যেই, পুঁজি লগ্নীকারী কোম্পানিগুলো নির্দিষ্ট দরে সরকারি কর্তৃপক্ষের কাছে বিদ্যুৎ সরবরাহের চুক্তি করেছে। তাছাড়া, বাড়তি দাম কমে আসার অপেক্ষায় হাত গুটিয়ে অপেক্ষা করারও উপায় নেই। ভারতের কঠোর কমিশনিং বিধিমালার কারণে, নির্দিষ্ট সময়ে পূর্ণ সক্ষমতায় উৎপাদনে পৌঁছাতে না পারলে জরিমানা দিতে হবে।
সংকট সবদিকেই। সময়মতো সরবরাহ পাওয়াটাই বড় সমস্যা। সোলার প্যানেল উৎপাদক কোম্পানিগুলো ভারতে প্রকল্প বাস্তবায়নকারী প্রতিষ্ঠানের অর্ডার করা ৫ গিগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনে সক্ষম বিপুল পরিমাণ সোলার প্যানেল ডেলিভারি আগামী বছরের ৩১ মার্চ পর্যন্ত স্থগিত করেছে।
সৌরবিদ্যুৎ সরঞ্জাম উৎপাদক চীনের একটি বড় প্রতিষ্ঠান- ট্রিনা সোলার লিমিটেডসহ অন্যান্য কোম্পানি ইতোমধ্যেই আনুষ্ঠানিক নোটিশ দিয়ে তাদের ভারতীয় গ্রাহকদের নির্ধারিত সময়ে সরবরাহে করতে না পারার কথা জানিয়েছে।
এনিয়ে প্রকল্প সংশ্লিষ্ট ভারতীয় কোম্পানিগুলোর একজন কর্মকর্তা নাম না প্রকাশের শর্তে স্থানীয় অর্থনৈতিক গণমাধ্যম লাইভমিন্টকে জানান, "সোলার মডিউলের বাড়তি দাম নিঃসন্দেহে প্রকল্পের আর্থিক দিকে চাপ সৃষ্টি করবে। শুধু সরবরাহ ব্যাহত হয়েছে তা নয়, বরং পরবর্তীতে কেমন দামে কিনতে হবে- সেটাও আমাদের জানা নেই।"
আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে জাহাজে পণ্য পরিবহন শিল্পের সংকট বাড়তি দামের চাপ আরও বাড়াচ্ছে। স্বাভাবিক পরিবহন ব্যাহত হওয়ায় বেড়েই চলেছে জাহাজ ভাড়া ও কন্টেইনার স্বল্পতার মতো আমদানি খরচ।
এদিকে স্থানীয় পর্যায়ে উৎপাদনকে উৎসাহিত করতে, আমদানিকৃত সৌর কোষ, মডিউল ও ইনভার্টারের ওপর আগামী বছরের পহেলা এপ্রিল থেকে বাড়তি শুল্ক কার্যকর করতে ভারত সরকার। ফলে আমদানির খরচ বহুগুণে বাড়বে।
ভারতে নবায়নযোগ্য শক্তি উৎপাদনে বিদেশি কোম্পানিগুলোও বিনিয়োগ করেছে। স্থানীয় কোম্পানিগুলোর সঙ্গে যৌথভাবে প্রকল্প বাস্তবায়নে যাচ্ছে তারা। এমনই একটি কোম্পানি ফিনল্যান্ডের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ফরটুম ওওয়াইজে।
প্রতিষ্ঠানটির ভারতীয় ব্যবসায়িক শাখা- ফরটুম ইন্ডিয়া প্রাইভেট লিমিটেডের প্রেসিডেন্ট সঞ্জয় আগরওয়াল বলেন, "এখনই সজাগ হওয়ার সময়। ট্যারিফ আরোপকালে নীতিনির্ধারকরা জরুরি সংকট দেখা দেওয়ার ব্যাপারে ভাবেননি। সরকার এই মুহূর্তে উদ্যোগী না হলে, বিনিয়োগের উদ্যোগগুলো ব্যাহত হবে। তখন আর কিছুই করার থাকবে না। সৌর খাত এখনও বিনিয়োগের জন্য অত্যন্ত আকর্ষণীয়। কিন্তু, বাস্তবতা মেনে পদক্ষেপ না নিলে, মন্দা আসতেও সময় লাগবে না।"
তাছাড়া, বিদ্যুৎ উৎপাদনে উদীয়মান অর্থনীতি ভারতের কয়লা নির্ভরতা নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা রয়েছে। চাহিদা মেটাতে সম্প্রতি কয়লা আমদানিও বাড়িয়েছে দেশটি। কিন্তু, সেপ্টেম্বর ও চলতি অক্টোবরে ইন্দোনেশিয়া থেকে আমদানিকৃত কয়লার দাম বেড়ে টনপ্রতি ২০০ ডলারে পৌঁছেছে, মার্চ মাসে যা ছিল মাত্র ৬০ ডলার। ফলে কয়লা নির্ভর ভারতীয় তাপ-বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোয় শক্তি উৎপাদন কমেছে।
এদিকে বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ নবায়নযোগ্য শক্তি উৎপাদক হওয়ার পরও, দেশটির স্থানীয় কোম্পানিগুলোর সৌরকোষ উৎপাদন সক্ষমতা মাত্র ৩ গিগাওয়াট। সৌর মডিউল উৎপাদন ক্ষমতা খানিকটা বেশি, ১৫ গিগাওয়াট।
চাহিদা মেটাতে আমদানিই ভরসা। গত ২০২০-২১ অর্থবছরে চীন থেকে প্রায় ৫৭ কোটি ১৬ লাখ ডলারের সৌরকোষ ও মডিউল আমদানি করে ভারত। যা আগের অর্থবছরে ছিল ১৬৮ কোটি ডলার।
- সূত্র; লাইভমিন্ট