চিকিৎসক সংকটে স্বাস্থ্যসেবা বঞ্চিত উপজেলা হাসপাতালের রোগীরা
২৫০ শয্যাবিশিষ্ট ভোলা জেলা সদর হাসপাতালে ৫৮ জন চিকিৎসকের পদ থাকলেও বর্তমানে কর্মরত রয়েছেন ১০ জন। ৮ জন কনসালটেন্ট ও একজন মেডিকেল অফিসার ইমার্জেন্সি ডিপার্টমেন্ট, আউটডোর ও ইনডোরে সেবা দেয়। চিকিৎসক সংকটে আউটডোরে রোগীদের অ্যালোপেথিক ওষুধ দেয় একজন একজন আয়ুবের্দিক ডাক্তার।
সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ৩৩ জন চিকিৎসকের পদের বিপরীতে চিকিৎসক রয়েছেন চার জন। পদের বিপরীতে চিকিৎসক ঘাটতি রয়েছে ৮৭ দশমিক ৮৮ শতাংশ। এ হাসপাতালে রেসিডেন্ট মেডিকেল অফিসার, গাইনি ও প্রসূতি জুনিয়র কনসালট্যান্ট, অ্যানেস্থেটিস্ট জুনিয়র কনসালট্যান্ট সবগুলো পদ শূ্ন্য। চিকিৎসক সংকটের কারণে এ হাসপাতালে কোন ধরনের অপারেশন হয় না।
শুধু ভোলা সদর হাসপাতাল বা শ্যামনগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স নয়, দেশের ৫৮ শতাংশ উপজেলা হাসপাতালে চিকিৎসকের পদ খালি রয়েছে বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। কোনো কোনো বিভাগের উপজেলা হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসকের শূন্য পদের সংখ্যা ৮০ শতাংশের বেশি। চিকিৎসক সংকটের কারণে সেবা বঞ্চিত হচ্ছে রোগীরা।
ভোলার ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট জেলা সদর হাসপাতালের সুপারিন্টেন্ডেন্ট ড. মো. সিরাজুদ্দীন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "আমাদের হাসপাতালে ৩০০ জনের বেশি রোগী ভর্তি থাকে এবং প্রতিদিন বহিঃবিভাগে ৫০০ থেকে ৭০০ জন সেবা নেয়। এছাড়া জরুরি বিভাগে শতাধিক রোগী আসে। কিন্তু চিকিৎসক ও নার্স সংকট প্রকট। জনবল সংকটের কারণে আমাদের কর্মঘণ্টা বেড়ে যায়। আমরা রোগীদের সেবা দিতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করি, কিন্তু পর্যাপ্ত জনবল পেলে আরও উন্নত সেবা দিতে পারতাম।"
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রিয়েল টাইম হেলথ ইনফরমেশন ড্যাশবোর্ডের তথ্য বলছে, দেশের ৪২৪টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসকের পদ রয়েছে ১০,৪৭১টি, এর মধ্যে কর্মরত রয়েছে ৪,৩৪১ জন এবং পদ খালি আছে ৬,১৩০টি। চিকিৎসকের পদ খালি আছে ৫৮ দশমিক ৫ শতাংশ। গ্রেড ৯ এর চিকিৎসকের ঘাটতি সবচেয়ে বেশি, উপজেলা পর্যায়ের হাসপাতালগুলোতে গ্রেড ৯ চিকিৎসকের পদ খালি ৬১ দশমিক ৭ শতাংশ।
ড. সিরাজুদ্দীন বলেন, "ভোলা সদর হাসপাতালে ৯ম গ্রেডের ডাক্তার ২৬ জন থাকার কথা থাকলেও আছে মাত্র একজন। ৯ম গ্রেডের চিকিৎসক সংকটের কারণে রোগীর সেবা দিতে বেশি সমস্যা হচ্ছে।
চিকিৎসক সংকট বেশি বরিশালে, কম ঢাকায়
বরিশাল বিভাগে চিকিৎসক পদ সবচেয়ে বেশি খালি আর সবচেয়ে কম পদ খালি ঢাকা বিভাগে। বরিশাল বিভাগে ৭৩ দশমিক ৬ শতাংশ ও ঢাকা বিভাগে ৪২ দশমিক ৮ শতাংশ চিকিৎসকের পদ খালি। বরিশাল বিভাগে ৩৮টি উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা পদের বিপরীতে কর্মরত রয়েছেন ৩৭ জন, ৩২টি আরএমও পদের বিপরীতে কর্মরত রয়েছেন ১২ জন, ২২২টি জুনিয়র কনসালট্যান্ট পদের বিপরীতে রয়েছেন মাত্র ৩২ জন এবং ৫৫৫টি চিকিৎসক (গ্রেড-৯) পদের বিপরীতে ১৪৭ জন কর্মরত রয়েছেন।
ঢাকা বিভাগে ৮৭টি উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা পদের একটিও খালি না থাকলেও ৭৫টি আরএমও পদের বিপরীতে ৩৩ জন কর্মরত রয়েছেন। ৫২৪টি পদের বিপরীতে ২৭৯ জন জুনিয়র কনসালট্যান্ট রয়েছেন এবং এক হাজার ৪৭৪টি চিকিৎসক পদে কর্মরত রয়েছেন ৮২৭ জন।
ঢাকা বিভাগের গাজীপুর, নারায়নগঞ্জ, নরসিংদী, নবাবগঞ্জ, কেরাণিগঞ্জসহ ঢাকার আশেপাশের উপজেলা হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসকের পদ খালি নেই। ঢাকা বিভাগের কিশোরগঞ্জ হাওর অঞ্চলের উপজেলা হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসকের পদ খালি রয়েছে। কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্রাম উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসকের পদ খালি রয়েছে ৭০ দশমিক ৫৯ শতাংশ।
গ্রামে যেতে অনীহার কারণে চিকিৎসক সংকট
চিকিৎকদের গ্রামে যাওয়ার অনীহার কারণে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের হাসপাতালগুলোতে জনবল সংকট বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, ঢাকা মেডিকেল কলেজ, সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজসহ বড় বড় মেডিকেল কলেজগুলোতে প্রয়োজনের অতিরিক্ত চিকিৎসক কর্মরত রয়েছে। পড়াশোনাসহ বিভিন্ন কারণ দেখিয়ে তারা ঢাকায় থাকছে, আর গ্রামের রোগীরা সেবা বঞ্চিত হচ্ছেন।
নেত্রকোনা জেলার সিভিল সার্জন ডা. মো. সেলিম মিঞা বলেন, "দুর্গম জনপদের কারণে হাওর অঞ্চলে কেউ থাকতে চায় না। কাউকে এখানে নিয়োগ দেয়া হলে যোগদানের কিছুদিনের মধ্যেই বদলির জন্য তদবির শুরু করেন। অনেকে রাজনৈতিক তদবিরে বদলি হয়ে চলে যান। আউটসোর্সিং পদ্ধতিতে কিছু জনবল নিয়ে আমরা সংকট সমাধানের চেষ্টা করে যাচ্ছি।"
সহায়ক নীতিমালার অভাবে ডাক্তাররা গ্রামে থাকতে চান না
চিকিৎসকদের জেলা, উপজেলা বা গ্রামীণ অঞ্চলে অনুপস্থিতির কারণ অনুসন্ধানে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের মানবসম্পদ উন্নয়ন ইউনিট, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের জেমস পি গ্রান্ট স্কুল অব পাবলিক হেলথ একটি গবেষণা পরিচালনা করে।
'রিটেইনিং ডক্টরস ইন রুরাল বাংলাদেশ: আ পলিসি অ্যানালাইসিস' শীর্ষক গবেষণায় বলা হয়, নিয়োগে অস্বচ্ছতা, দেরিতে পদোন্নতি, উচ্চতর শিক্ষার সুযোগের অভাব- চিকিৎসকদের ঢাকার বাইরে থাকতে না চাওয়ার কারণ। পদোন্নতির ক্ষেত্রে রাজনৈতিক প্রভাব, গ্রামে নারী চিকিৎসকদের পরিবারের সদস্যদের ছাড়াই অবস্থানের কারণে চিকিৎসকরা গ্রামে থাকতে চান না। আবার ঢাকার বাইরে নির্ধারিত দুই বছরের দায়িত্ব শেষে শহরে আসার সুযোগ না থাকায় অনেকে সেখানে থাকতে অনীহা দেখান।
চিকিৎসকদের গ্রামে থাকতে না চাওয়ার কারণ নিয়ে গবেষণা করেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের জনস্বাস্থ্য ও তথ্য বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. খালেকুজ্জামান। চিকিৎসকদের গ্রামে রাখতে সহায়ক নীতিমালা ও উন্নত পরিবেশের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি।
ড. খালেকুজ্জামান টিবিএসকে বলেন, গ্রামে সাধারণত নতুন পাশ করা চিকিৎসকরা যান, তাদের যোগদানের দু্ই বছর পর উচ্চতর শিক্ষার জন্য শহরে যাওয়ার স্বচ্ছ নীতিমালা থাকতে হবে। হাসপাতালের তৃতীয়-চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী, ওষুধসহ সব ধরনের লজিস্টিক সাপোর্ট দিতে হবে, এছাড়া তাদের ভালো বসার জায়গা দেওয়া, এসব মৌলিক সুবিধাদি দিতে হবে। তাহলেই গ্রামেও চিকিৎসকরা কাজ করতে আগ্রহী হবে্ন।
সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক এবিএম খুরশীদ আলম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "উপজেলা হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসক সংকটের বিষয়ে আমরা অবগত আছি। রাতারাতি হয়তো আমরা বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক তৈরি করতে পারব না। তবে প্রতিটি হাসপাতালে যাতে কনসালটেন্ট ও প্রয়োজনীয় চিকিৎসক নিয়োগ দেওয়া যায় সেজন্য আমরা কাজ করছি।"
তিনি বলেন, "আমরা লিস্ট করছি কোথায় কী পরিমাণ চিকিৎসক প্রয়োজন, সে অনুযায়ী নিয়োগ দেওয়া হবে এবং চিকিৎসকদের সেসব এলাকায় থাকতে হবে। কোভিড মোকাবেলায় বিশেষ বিসিএস এর মাধ্যমে ৪,০০০ চিকিৎসক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তাদের নন-কোভিড রোগীর সেবায় কাজে লাগানো হবে।"