যদি পৃথিবীর ঘূর্ণন থেমে যায়
মান্না দের গাওয়া সেই রোমান্টিক গানটাই সবার আগে মনে পড়ছে? বেশ কটা যদি আছে তাতে:
১. যদি হিমালয় আল্পসের সমস্ত জমাট বরফ একদিন গলেও যায়;
২. যদি নায়াগ্রা জলপ্রপাত একদিন সাহারার কাছে চলে যায়;
৩. যদি প্রশান্ত মহাসাগরে এক ফোঁটা জল আর না-ও থাকে;
৪. যদি গঙ্গা-ভলগা হোয়াংহো নিজেদের শুকিয়েও রাখে;
৫. যদি ভিসুভিয়াস-ফুজিয়ামা একদিন জ্বলতে জ্বলতে জ্বলতে জ্বলেও যায়;
৬. যদি পৃথিবীকে ধ্বংস করতে একদিন তৃতীয় মহাযুদ্ধও বাধে;
৭. যদি নিভেও যায় কোনো দিন যতটুকু আলো আছে ওই সূর্য আর চাঁদ;
৮. যদি সাইবেরিয়ার তুষার কখনো সবুজ ফসল ফলেও যায়।
যদি এই তালিকার যেকোনো একটা কিংবা একাধিক কিংবা সবগুলোই ঘটে যায়, তবুও তুমিই আমার।
গানের এই ৮টি যদির ৬টি যদি ঘটে, তাহলে মান্না দে যাই শোনান না কেন, পৃথিবীর প্রায় সকল মানুষের মৃত্যু অনিবার্য; আশাব্যঞ্জক জীবনমুখী মাত্র ২টি: নায়াগ্রা যদি সাহারার কাছে যায় আর সাইবেরিয়ার তুষারে যদি সবুজ ফসলের সমারোহ দেখা যায়।
এখন গানের বাইরে পৃথিবীর ঘূর্ণন যদি হঠাৎ থেমে যায়। পৃথিবী যে ঘোরে শ পাঁচেক বছর আগে। এটাই তো মানুষের অজানা ছিল। পৃথিবী নিজের অক্ষে ঘোরে আবার সৌর অক্ষে সূর্যের চারদিকে ঘোরে। কোথায় সূর্য ঘুরবে, সে কথা না বলে পৃথিবীরে ঘুরিয়ে কী যে মহাবিপদে পড়েছিলেন কোপার্নিকাস।
আমরা মেনে নিয়েছি পৃথিবীই ঘুরছে- ঘূর্ণায়মান পৃথিবী। পৃথিবীটা সত্যি যে ভনভন ঘুরছে, এ নিয়েও মান্না দের একটা গান রয়েছে। সেই ভনভন ঘূর্ণন যদি হঠাৎ থেমে যায় তাহলে কী হবে?
১৯৫১ সালের হলিউড সিনেমা, মানে সত্তর বছর আগে দ্য ডে দ্য আর্থ স্টুড স্টিল যারা দেখেছেন, জানেন ভিন্ন গ্রহ থেকে আসা ক্লাটুর তার রোবট সহযোগী গোর্ট তারের এলিয়েন প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে ঘূর্ণায়মান পৃথিবীর ভনভন থামিয়ে গ্রহটাকে একেবারে নিশ্চল করে দিল- এর একটুও এগোতে পারল না মানে আর এক চক্করও যেতে পারল না। তারপর বন্ধ হয়ে গেল বাতি, কারখানা, টেলিভিশন কাজকর্ম সব। অদ্ভুত এক জাগতিক নিস্তবতা বিরাজ করতে থাকল। এবার ভাবুন ব্যাপারটা যদি সত্যি সত্যিই ঘটে যেত, তাহলে কী ভয়ংকর ধ্বংসযজ্ঞ শুরু হয়ে যেত।
তাই যদি প্রশ্ন করা হয় হঠাৎ পৃথিবীর ঘূর্ণন থেমে যায়, তাহলে কী ঘটবে?
প্রায় সকল কিছুরই মৃত্যু ঘটবে। আর বেশ মজার কিছু ঘটনাও ঘটবে। বিষুবরেখাতে ভূপৃষ্ঠ প্রতি সেকেন্ড ৪৭০ মিটার বেগে অর্থাৎ ঘণ্টায় এক হাজার মাইলের কিছু বেশি বেগে ঘুরে। যদি পৃথিবী থেমে যায় কিন্তু বাতাস না থামে তাহলে ঘণ্টায় হাজার মাইল বেগে ঝড়ো হাওয়া বইতে থাকবে। সবচেয়ে বেশি বাতাস বইবে বিষুবরেখাতে এবং ৪২ ডিগ্রি উত্তর এবং ৪২ ডিগ্রি দক্ষিণের অন্তর্গত পৃথিবীর ৮৫ ভাগ মানুষ হঠাৎ সুপারসনিক গতির বাতাসের ছোঁয়া লাভ করবে, এটি একটি দুর্লভ অভিজ্ঞতা। ভূপৃষ্ঠের ওপর এই ঝড়ো বাতাস মাত্র কয়েক মিনিট প্রবাহিত হবে, তারপর মাটির সাথে ঘর্ষণে এই বেগ ধীরে ধীরে কমে আসবে। তবে সেই কয়েক মিনিটই মানুষকে গুঁড়িয়ে ধ্বংসযজ্ঞে পরিণত করার জন্য যথেষ্ট।
পদার্থবিদ র্যানডাল মুনরো বললেন, বোস্টনে তার বাড়িটা পড়েছে সুপারসনিক বাতাস জোনের বাইরে, কিন্তু তারপরও সেখানে ঝড়ো বাতাস হবে সবচেয়ে শক্তিশালী, টর্নেডোর চেয়ে দ্বিগুণ শক্তিশালী। বিভিন্ন ভবন, কুঁড়েঘর থেকে শুরু করে আকাশছোঁয়া স্কাইস্ক্যাপার একেবারে ভিত্তি থেকে উৎপাটিত হবে, হুমড়ি খেয়ে পড়ে ছাতুগুঁড়ো হয়ে যাবে।
উত্তর ও দক্ষিণ মেরুতে বাতাসের গতি কম হবে। তবে ট্রাম্প টাওয়ার হোক কি বুর্জ খলিফা, কোনোটাই বিষুবরেখা থেকে তেমন দূরে নয় যে ধ্বংস হওয়া ঠেকাতে পারবে। মোট কথা পৃথিবীর কোনো দেশে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানো কোনো স্থাপনাই নিজ অবস্থানে দাঁড়িয়ে থাকতে পারবে না। হুমড়ি খেয়ে পড়বে। ভূপৃষ্ঠদেশের বাতাস থেমে গেছে, সবকিছু অদ্ভুত ঠেকছে। হঠাৎ থমকে যাওয়া বাতাসের ঝাপটাগুলো রূপান্তরিত হবে উত্তাপের ঝাপটায়। বাতাসের গতিশক্তি হঠাৎ থমকে গিয়ে উত্তপ্ত হয়ে উঠবে। গায়ে আগুনের ফোস্কা ধরানো উত্তাপ তখন ভূপৃষ্ঠে সিক্ত ও জলীয় অঞ্চলে শুরু হবে বজ্রপাত। যে বাতাস সমুদ্রের ওপর দিয়ে বয়ে যাবে, তা সমুদ্র মন্থন করবে- কিছু সময়ের জন্য সমুদ্রপৃষ্ঠ বলে কিছুই থাকবে না- কোথায় সমুদ্রের সূচনা, তা-ও বলা যাবে না। এই সময়টা পেরিয়ে গেলে শীতল সমুদ্রের উপরিস্তরের নিচে তাপমাত্রা কমবেশি ৪ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড। ঝড় সমুদ্রতল থেকে শীতলতা যখন ওপরে ছড়িয়ে দেবে- ভীষণ উত্তপ্ত বাতাসে শীতলতার তীব্রতা কেটে গিয়ে এমন এক অদ্ভুত পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে, যার সাথে পৃথিবী মোটেও পরিচিত নয়। নিশ্বাস গ্রহণ যাদের প্রয়োজন, সমুদ্রের তিমি কিংবা ডলফিন সমুদ্র ও বায়ুমণ্ডলের সঙ্গমস্থলে কঠিন সংকটে পড়ে যাবে। মন্থিত সমুদ্রের বিশাল ঢেউ পূর্ব হতে পশ্চিমে পৃথিবীর ওপর দিয়ে প্রবাহিত হবে। পূর্বমুখী প্রতিটি সমুদ্রসৈকত পৃথিবীর ইতিহাসের সবচেয়ে বড় ঝড়ো জলোচ্ছ্বাসের মোকাবেলা করবে। দ্বীপসমূহ তলিয়ে যাবে। পেছনে দৃষ্টি গেলে দেখা যাবে, উঁচু প্রাচীর হয়ে সমুদ্র থেকে উঠে আসা পুরু ঢেউয়ের বিশাল দেয়াল-এগোচ্ছে সুনামির মতো। কোথাও এই ঢেউ আছড়ে পড়বে বেশ কয়েক মাইল দূরের দ্বীপে।
ঝড়ের উল্লাস বায়ুমণ্ডলে ঢুকিয়ে দেবে ধূলিকণা এবং লক্ষ কোটি ধ্বংসাবশেষ চূর্ণ। একই সঙ্গে সমুদ্রের উপরিভাগ ছেয়ে যাবে ঘন কুয়াশার নিরবচ্ছিন্ন চাদরে।
এভাবে একসময় পৃথিবীর তাপমাত্রা ক্রমান্বয়ে নেমে আসতে থাকবে।
যদি পৃথিবী আর না ঘুরে অর্থাৎ নিজের অক্ষের ঘূর্ণন বন্ধ হয়ে যায় তাহলে ছয় মাসের জন্য দিন ও রাতের চক্র বন্ধ হয়ে যাবে। যে নামেই ডাকা হোক দিন কিংবা রাত কিংবা অন্য কিছু- চব্বিশ ঘণ্টা পরিস্থিতি প্রায় একই রকম। পৃথিবীর ঘূর্ণন বন্ধ হলে সূর্যের ঘূর্ণন বন্ধ হয়ে যাবে এমন নিশ্চয়ই কেউ মনে করবেন না; পৃথিবীর সর্বোচ্চ অক্ষাংশ নরওয়ের মালবার্ড দ্বীপ শক্তিশালী সাইক্লোনের আঘাতে ধ্বংস হয়ে যাবে। এই কিছুটা নিরাপদ জায়গা হবে ফিনল্যান্ডের হেলসিংকি। তবে এর উঁচু অক্ষাংশ ৬০ ডিগ্রি নর্থের বেশি হলেও বাতাসের ঘূর্ণিও ঘর্ষণের আওতার বাইরে নয়। কাজেই বিস্ময়কর স্থাপনাগুলোর এখানেও টিকে থাকার গ্যারান্টি নেই।
আসলে কোনো ভবনই নিরাপদ হবে না, প্রবল ঘূর্ণিঝড় প্রতিরোধক্ষমতাসম্পন্ন এমনকি পর্যাপ্ত শক ট্রান্সমিশন ইউনিট লাগানো ভবনও ঝুঁকির মুখে থাকবে। যদি ঝড়ো বাতাসপ্রতিরোধক সামগ্রীতে তৈরি কোনো ভূগর্ভস্ত বাঙ্কারে কেউ অবস্থান করেন, তাহলে কি বেঁচে যাবেন? আপনার প্রতিবেশীদের বাঙ্কার যখন উড়বে আর আপনার বাঙ্কারের ওপর ছিটকে পড়বে, পারবে কি সেই চাপ সহ্য করতে? সুরক্ষিত বাঙ্কারই ঝড়ো বাতাসের ঘূর্ণনে ছিঁড়ে বেরিয়ে আকাশে উড়তে থাকবে, আপনার বাঁচার সম্ভাবনা নেই।
এবার প্রশ্ন হতে পারে: তখনই কি মানবজাতি বিলুপ্ত হয়ে যাবে? না যাবে না। ভূপৃষ্ঠের অনেক ওপর হাতে গোনা যে কজন থাকবেন তারা বেঁচে যাবেন। গভীর সাগরের টানেলে যারা থাকবেন তারাও বেঁচে যেতে পারেন। মানে ভূপৃষ্ঠের অনেক ওপর এবং অনেক নিচে বেঁচে যাবার সম্ভাবনা বেশি। আরও কিছু ভাগ্যবান লোক বেঁচে যাবেন। দক্ষিণ গোলার্ধে আমুন্ডসেন-স্কট রিসার্চ স্টেশনের বিজ্ঞানী ও কর্মচারীরা বাতাসের ঝাঁপটা থেকে বেঁচে থাকবেন। তবে তারা বিস্মিত হয়ে জানবেন যে বাইরের পৃথিবী হঠাৎ নিস্তব্ধ ও যোগাযোগবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। এই রহস্যজনক নীরবতা কিছু সময় ধরে তাদের হতবুদ্ধি করে রাখলেও তা কেটে যাবে, যখন তারা দেখবেন সূর্য নড়ছে না।
তখন পৃথিবীকেই মহাবিশ্বের কেন্দ্র বলে দাবি জানাতে একালের কোনো কোপার্নিকাসকে কারাবন্দী করতে কেউ ছুটে আসবেন না, এ আশা করা যায়। পৃথিবীর ঘূর্ণন থামায় পৃথিবী স্থির হয়ে গেছে। দিনও নেই রাতও নেই, কারণ পৃথিবী না ঘোরাতে সকালের সূর্যোদয় আর সন্ধ্যার অস্তগমন দেখার আর সুযোগ নেই। এ অবস্থায় প্রতিবছর মাত্র একবার সূর্য উদিত হবে, একবারই অস্ত যাবে- ৩৬৫ দিনে কিংবা লিপ ইয়ারের ৩৬৬ দিনে মাত্র একবার এক দিন। এমনকি বিষুবরেখাতেও দিন হবে ছয় মাস দীর্ঘ রাত হবে ছয় মাস। দিনের বেলা অবিরাম সূর্যতাপে সবকিছু ভাজাভাজা হয়ে যাবে- এই অবস্থা চলবে ছয় মাস। পরের ছয় মাস রাত প্রচণ্ড শীতল। সূর্যের তলদেশের ভূপৃষ্ঠে কেবলই ঝড়ঝঞ্ঝা বইতে থাকবে।
দিনের দৈর্ঘ্য এবং রাতের দৈর্ঘ্য যতই বাড়ুক ১৮২ দিন মাসের হিসাবে সামান্য পরিবর্তনও ঘটবে না। পৃথিবীর ঘূর্ণন থেমে গেছে থামুক। কিন্তু পৃথিবীকে ঘিরে চাঁদের যে ঘূর্ণন, তা তো আর থামেনি। সুতরাং চন্দ্রমাস যেমন ছিল তেমনই থাকবে। কিন্তু পৃথিবীর ঘূর্ণনে চাঁদ যে জোয়ার-ভাটার শক্তি পেত, তা তো বন্ধ হয়ে যাবে, সূর্যের আলো প্রাপ্তিতে হিসাবের গড়মিল শুরু হয়ে যাবে চাঁদ পৃথিবী থেকে দূূরে সরতে থাকবে।
এখন কথা হল, এতক্ষণ যা বলা হলো তা আদৌ সঠিক কি না, পরীক্ষা করে দেখার জন্য আপনি কি বেঁচে থাকবেন?
পৃথিবীর ঘূর্ণন হঠাৎ বন্ধ হয়ে গেলে হাজার মাইল বেগে পূর্বমুখী ছুটে আসা একটি পাথরখণ্ড আপনার মাথায় এমন এক ঘা বসিয়ে দেবে, তাতেই ঘিলু ছিটকে পড়বে, আপনি একেবারে চিড়েচ্যাপ্টা। তারপরও যদি বেঁচে যান, টানা ছয় মাসের কড়া রোদে শুকিয়ে শুঁটকি হয়ে যাবেন ঝরাপাতার মতো এখানে ওখানে পড়ে থাকবেন।
ভাগ্যিস ক্লান্ত পৃথিবী এখনো ঘূর্ণন বন্ধ করেনি। অবশ্য এটা স্বীকার করতে হবে, ঘূর্ণনের গতি কমে আসছে প্রতি এক শ বছরে ১.৭ মিলি সেকেন্ড। ঘূর্ণায়মান পৃথিবীকে অবশেষে আমাদের সশ্রদ্ধ অভিবাদন। তোমাকে অভিবাদন মাদার আর্থ।