ঝুট থেকে হাজার কোটির ব্যবসা, লাখো মানুষের কর্মসংস্থান
প্রায় ৫০ বছর ধরে 'কম্বলের গ্রাম' হিসেবে পরিচিতি পেয়ে আসছে বগুড়ার আদমদীঘির নশরতপুরের শাঁওল ও তার আশপাশের এলাকাগুলো। এখানে দেশের বিভিন্ন গার্মেন্টস থেকে আসা ঝুট কাপড় থেকে সুতা এবং কম্বল, চাদর, শালসহ বিভিন্ন শীতবস্ত্র তৈরি করা হয়ে থাকে। এসব শীতবস্ত্র আর সুতা বিক্রি করে বছরে আয় হয় প্রায় সাড়ে এক হাজার ২৭৮ কোটি টাকা। আর এই শিল্পে কর্মসংস্থান হয়েছে এলাকার অন্তত এক লাখেরও বেশি মানুষের। তার মধ্যে অর্ধেকের বেশি নারী।
তাঁত শিল্পের সঙ্গে জড়িত স্থানীয়রা জানান, এই এলাকায় বৃটিশ আমল থেকেই তাঁত শিল্পের ব্যবসা ছিল। ওই সময় এখানকার তাঁতিরা ভারত থেকে সুতা আমদানি করতেন। এরপর ১৯৭০ সালের দিকে ভারতের সাথে কোনো এক দ্বন্দ্বে সুতা আমদানি বন্ধ হয়ে যায়। তখন দেশীয় তাঁত শিল্প ধ্বংসের মুখে পড়তে থাকে। কিন্তু এর মধ্যে আলোর ঝলকানির দেখা মেলে ঢাকার মিরপুরের গার্মেন্টেসের ঝুট কাপড়ের মাধ্যমে।
১৯৮০ সালের দিকে গার্মেন্টেসের ঝুট নিয়ে বগুড়া, নওগাঁ, গাইবান্ধায় উলের সুতা তৈরি শুরু হয়। আগের সনাতন পদ্ধতি ও বর্তমানের আধুনিক পদ্ধতির সমন্বয়ে এখন এগিয়ে চলছে এখানকার তাঁত শিল্প।
শীতের পোশাক শাল চাদর তৈরির প্রধান উপাদান বা কাঁচামাল হিসেবে সোয়েটার ফ্যাক্টরির পরিত্যক্ত উলের সুতা ব্যাপক কাজে লাগা শুরু হয়। উলের সুতা থেকে শাল চাদর, মাফলার, কম্বল, সুতার দড়ি তৈরি হয়। এতে কর্মসংস্থান হয় লাখো নারী-পুরুষের। এসব শীতবস্ত্র খুচরা ও পাইকারি বিক্রি করার জন্য এক সময় গড়ে ওঠে শাঁওল বাজার। বাজারে কেনা-বেচা চলে রাত চারটা থেকে সকাল আটটা পর্যন্ত।
ব্যবসায়ীরা জানান, কম্বলের গ্রাম আদমদীঘির শাঁওল বাজারে শুধু সুতা বা ঝুট কাপড়ের কর্মকাণ্ডের উপর ভিত্তি করে ১৩ শতাধিক দোকান গড়ে উঠেছে। এর বাইরে বগুড়ার দুপচাঁচিয়া, কাহালু, শিবগঞ্জ, নওগাঁর রানীনগর, জয়পুরহাটের ক্ষেতলালে অসংখ্য দোকান বা মোকাম গড়ে উঠেছে। কয়েকটি উপজেলা মিলে কয়েক লক্ষ মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে এই ঝুট কাপড়কে কেন্দ্র করে। তবে শাঁওল এলাকায় তাঁতিরা স্বাধীনতার আগে থেকেই কম্বল, শাল, চাদর তৈরি সুনাম অর্জন করে এসেছে।
এই বাজারে ১২ বছর ধরে সুতার ব্যবসা করছেন মো. মাহফুজুর রহমান। উদীয়মান এই ব্যবসায়ী বলেন, অর্থনৈতিক দিক বিবেচনায় শাঁওল বাজার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এখাণে ঢাকা থেকে প্রতিদিন অন্তত ১৫ গাড়ি (বড় ট্রাক) করে ঝুট কাপড় কিংবা সুতা আসে। এক গাড়ি ঝুটের দাম গড়ে ১২ লাখ টাকা। এই হিসাবে প্রতিদিন এই বাজারে এক কোটি ৮০ লাখ টাকার ঝুট কাপড় বা সুতা নিয়ে আসা হয়। মাসে বিক্রি হয় ৫৪ কোটি টাকা। আর বছরের হিসাবে এর পরিমাণ দাঁড়ায় ৬৪৮ কোটি টাকা।
প্রতিদিন এই বাজার এলাকায় ঝুট থেকে উৎপাদিত ৫ থেকে ৭ গাড়ির মতো ভালো সুতা বিক্রি হয়। এই সুতার বাজারমূল্য (প্রতিগাড়ি) ২০ থেকে ২৫ লাখ টাকা। এই হিসাবে বছরে সুতা বিক্রি করে এখানকার ব্যবসায়ীরা গড়ে আয় করেন ৬৩০ কোটি টাকা। অর্থাৎ মোট লেনদেনের পরিমাণ দাঁড়ায় এক হাজার ২৭৮ কোটি টাকা।
কেবল তাই নয় অর্থনীতিতে এই এলাকার নারী পুরুষের অবদানও ভিন্ন মাত্রা যোগ করেছে। এই কর্মযজ্ঞের সাথে শাঁওল ও এর আশপাশের অন্তত ৫০ হাজার মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে বলে জানান মাহফুজুর রহমান।
গত বুধবার শাঁওল হাটের দিন ফরিদপুরের ভাঙা উপজেলা থেকে শীতবস্ত্র কিনতে এসেছিলেন আইয়ুব আলী। তিনি বলেন, "দেশের মধ্যে কম্বল ও চাদরের জন্য অন্যতম প্রধান এই বাজার। এখানে কম দামে পণ্য কিনে আমরা এলাকায় বিক্রি করে থাকি। আবার এখানে তৈরি কম্বল ও চাদরের মানও খুব ভালো।"
তবে, অন্য বছরের চেয়ে এবার চাদর ও কম্বলের পাইকারি দাম বেশি বলে অভিযোগ আইয়ুবের। তার এই অভিযোগ স্বীকারও করছেন স্থানীয় ব্যবসায়ীরা। দেলোয়ার হোসেন নামের এক তাঁতি ও ব্যবসায়ী বলেন, "করোনার কারণে এবার ঝুটের দাম দ্বিগুণ। ফলে বেড়েছে সুতার দাম। বাধ্য হয়ে তাঁতিরা তাদের উৎপাদিত পণ্যের দাম বাড়িয়েছেন।"
বগুড়ার শাঁওল বাজারে ২০০ থেকে শুরু করে ৪০০ টাকার কম্বল, আর ২০০ থেকে ৬০০ টাকার মধ্যে ভালো মানের শাল পাওয়া যায়। প্রতিদিন অন্তত ৮ হাজার কম্বল তৈরি হয় এলাকাজুড়ে। শাঁওল বাজার এলাকায় মৌ এন্টারপ্রাইজের মালিক অবসরপ্রাপ্ত সরকারি চাকরিজীবী ওয়াহেদ আলী ২০০ জন নারী শ্রমিক নিয়ে সুতা ও কম্বল তৈরির নেওয়ার্ক গড়ে তুলেছেন। এসব শ্রমিকেরা নিজেদের বাড়িতেই কাজ করেন। ওয়াহেদ বলেন, "এই এলাকায় গার্মেন্টেসের ঝুট সুতা ও তাঁতের কাজ আশীর্বাদের মতো। কারণ এতে শত শত অসহায় নারীর কর্মসংস্থান হয়েছে।
কম্বল তৈরি করে শাঁওল বাজারের মাসুমা বেগম তার তিন ছেলেকে পড়াশোনা করিয়েছেন। একই এলাকায় বিয়ে হয়েছে তার। বাড়িতে বসে স্বামী মকবুল হোসেনের সঙ্গে কম্বল তৈরি করছেন মাসুমা। ৫০ বছর বয়সী এই নারী বলেন, "বাবার বাড়িতে পড়াশোনার পাশাপাশি তাঁদের কাজ করতাম। স্বামীর বাড়িতে এসেও এই কাজ করছি। এর মধ্যে দুই ছেলেকে পড়াশোনা করিয়েছি। ছোট ছেলে এখন হাইস্কুলে পড়ছে। এক বিন্দু পরিমাণ কৃষি জমি নেই আমাদের। জীবিকা চলে এই তাঁত শিল্পের ওপর নির্ভর করেই।"
মাসুমার ছেলের বউ হাবিবা খাতুনও (৩৩) বাড়িতে স্বামী মতিউর রহমানের সাথে কম্বল তৈরি করেন। হাবিবা বলেন, "সংসারে স্বামীর কাজে সহয়তা করে আজ আমরা ঘুরে দাঁড়িয়েছি। মহাজনদের কাছ থেকে সুতা নিয়ে এসে আমরা কম্বল তৈরি করি। এ থেকে আয়ের টাকা দিয়েই আমাদের সংসার চলে।"
শাঁওল এলাকা ঘুরে দেখা যায়, প্রতিটি বাড়িতে নারী পুরুষ সমানতালে কম্বল-শাল তৈরি করছেন। কেউবা সুতা তৈরি করছেন। এসব কাজে তাদের সন্তানরাও সহায়তা করছেন। তবে এর বাইরে শাঁওল মোকাম এলাকায় গড়ে ওঠা প্রতিটি দোকানে গড়ে তিন জন নারী শ্রমিক রয়েছেন। তবে, তাদের পারিশ্রমিক তুলনামূলকভাবে ছেলেদের চেয়ে কম।
শাঁওল বাজারে সুতা ব্যবসায়ীদের নিয়ে ইউনিয়ন তন্তুবায় সমবায় সমিতি গড়ে তোলা হয়েছে। বাজারের সুতা ব্যবসায়ী মাহফুজুর রহমানের দেওয়া তথ্য সমর্থন করে সমিতির সহ সভাপতি আবু বক্কর শেখ বলেন, "শীতের এই সময়ে প্রতিদিন আমাদের বাজারে কোটি কোটি টাকার লেনদেন হয়। কিন্তু এই বাজারে কোটি কোটি লেনদেন হলেও একটি সরকারি ব্যাংকের শাখাও নেই। এটি দরকার।" এছাড়া বৃষ্টি ভেজা থেকে রক্ষা পেতে বাজারে ছাউনি করে দেওয়ার আহ্বান জানান তিনি।
জানতে চাইলে জেলা প্রশাসক মো. জিয়াউল হক বলেন, "শাঁওল বাজার অর্থনৈতিক দিক থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই বিষয়টি মাথায় রেখে ব্যবসায়ী ও তাঁত শিল্পের বিকাশে আমরা কাজ করব।"